ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ বলে মনে করছে সকলে

প্রতিদিন গড়ে ২শ’ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

প্রতিদিন গড়ে ২শ’ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি

রহিম শেখ ॥ দুই বছর আগে সরকারী চাকরি থেকে অবসরে যান সিরাজুল ইসলাম। পেনশনের যে টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে কেনেন ‘পেনশনার’ সঞ্চয়পত্র। নিজের নামে কেনা সঞ্চয়পত্রের ত্রৈমাসিক মুনাফা তুলতে বুধবার মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকে আসেন তিনি। জানালেন, মালিবাগের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে যে টাকা পান তা দিয়ে বাসা ভাড়া ও অন্যান্য খরচ মেটানোর চেষ্টা করেন। সুদের হার কমানোর পরও বিনিয়োগ করছেন কেন- জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, সুদের হার কমলেও ব্যাংকের তুলনায় তো এখনও অনেক বেশি পাচ্ছি। তাছাড়া এই মুহূর্তে বিনিয়োগের আর কোন জায়গা নেই বলে তার মত। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১ লাখ টাকার বিপরীতে তিন মাস অন্তর অন্তর মুনাফা তুলেন ২ হাজার ৯৪০ টাকা। বর্তমানে ৩০ লাখ টাকা থেকে একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ এবং যৌথ নামে ৬০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা যাচ্ছে। মোট ৪ ধরনের সঞ্চয়পত্রের মধ্যে পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারছেন ১৮ বা তার বেশি বয়সের যে কোন নারীরা। কিনতে পারছেন যে কোন বয়সের শারীরিক প্রতিবন্ধী পুরুষ ও মহিলারা। যার একটা বড় অংশই রয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারের। মূলত তাদের ওপর ভর করেই প্রতিমাসেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে সরকার। প্রতিদিন এখন গড়ে ২শ’ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হচ্ছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্যমতে, গত নবেম্বরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ এসেছে ৪ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। অক্টোবর মাসে বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর মাসে বিক্রি হয়েছিল ৫ হাজার ৩৯০ কোটি ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, আগস্টে বিক্রি হয়েছিল ৬ হাজার ৩২৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। আর অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বিক্রি হয়েছিল ৪ হাজার ৯৩২ কোটি টাকার। এ হিসাবে প্রতিদিন এখন গড়ে ২০০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হচ্ছে। সবমিলিয়ে গত পাঁচ মাসে বিক্রি হয়েছে ২০,৩১৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭০৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-নবেম্বর) সঞ্চয়পত্র থেকে নিট বিক্রি এসেছিল ১১ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদ হার কমে আসায় মানুষ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। স্থায়ী আমানতের বিপরীতে বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে, যা সঞ্চয়পত্রের সুদের তুলনায় অনেক কম। আগে পাঁচ বছর মেয়াদী এক লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনলে মাসে এক হাজার ৭০ টাকা মুনাফা পাওয়া যেত। ২০১৫ সালের মে মাসে সুদ হার কমানোর পর পাওয়া যাচ্ছে ৯১২ টাকা। তারপরও সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ এ খাতে বিনিয়োগ কমেনি; উল্টো বাড়ছে। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। সুদের হার কমানোর পরও বিক্রি না কমায় সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। অর্থবছর শেষে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকার ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা ধার করেছিল। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে এই লক্ষ্য ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিক্রি বাড়ায় সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি তার চেয়েও ৫ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা বেড়ে ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকায় পৌঁছায়। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ-আসল পরিশোধে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে সরকারকে। জানা যায়, দেশে বর্তমানে ৪ ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। এর মধ্যে ৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, ৩ বছর মেয়াদী ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, ৫ বছর মেয়াদী পরিবার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ ও ৫ বছর মেয়াদী পেনশনার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। পরিবার সঞ্চয়পত্রের মাসিক মুনাফা ৯১২ টাকা, ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ২ হাজার ৬২২ টাকা, পেনশনার সঞ্চয়পত্রের তিন মাস অন্তর অন্তর মুনাফা ২ হাজার ৯৪০ টাকা। সর্বশেষ গত বছরের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার ২ শতাংশ কমানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক দয়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকার সঞ্চয়পত্রে ঋণের সুদ বাড়িয়েছে দরিদ্র মানুষের সঞ্চয়ের কথা বিবেচনা করে। কিন্তু সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়া মানে সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়া। সুদ পরিশোধের কারণে সরকারে উন্নয়ন বাজেট কমে আসবে। সুদ হার কমানোর পরও ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হারের চেয়ে বেশি মুনাফা পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকেই ঝুঁকছে মানুষ বলে মনে করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমলেও ব্যাংকের আমানতে সুদ হারের তুলনায় অনেক বেশি। এ জন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। এই গবেষকের মতে, শেয়ার বাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই। জানা গেছে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে সরকার ৪৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নেয়া হবে ২৮ হাজার কোটি টাকা, আর স্বল্পমেয়াদী ঋণ ১৫ হাজার কোটি টাকা। আশার তুলনায় সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেশি হওয়ায় গত অর্থবছর জুড়েই ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার চাহিদা ছিল কম। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুন পর্যন্ত সরকারের মোট ব্যাংক ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ৮ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ছয় মাসে সরকারের ব্যাংক ঋণের মোট স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯৮ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। ফলে এ সময় সরকারের নিট ব্যাংক ঋণের স্থিতি কমেছে ১০ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গেল অর্থবছরের জুন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেয়া সরকারের ব্যাংক ঋণের মোট স্থিতি ছিল ২১ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা, যা ২৯ ডিসেম্বর শেষে কমে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার কোন ঋণই করেনি। উল্টে আগের নেয়া ঋণের প্রায় ১০ হাজার ১২৩ কোটি টাকা শোধ করেছে। অন্যদিকে গেল অর্থবছরের জুন শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেয়া ঋণের স্থিতি ছিল ৮৬ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা, যা ১৫ ডিসেম্বর শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৭ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময় সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে মাত্র ৭১৯ টাকার মতো ঋণ নিয়েছে সরকার।
×