ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘শীর্ষাসাই বিজনেস’ এই বই ছাপার দায়িত্ব পায়

নতুন বছরের ১৮ দিন পার, তবু আসেনি ৪৫ লাখ বই

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

নতুন বছরের ১৮ দিন পার, তবু আসেনি ৪৫ লাখ বই

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বছরের ১৮ দিন চলে গেলেও এখন পর্যন্ত আসেনি আন্তর্জাতিক টেন্ডারে ছাপা প্রাথমিক স্তরের প্রায় অর্ধ কোটি পাঠ্যবই। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘শীর্ষাসাই বিজনেস’ মুম্বাই ও পুনেতে ৬০ লাখ বই ছাপার কাজ করলেও এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৫ লাখ কপি পৌঁছাতে পারেনি প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের কাছে। প্রতিষ্ঠানটির লোকাল এজেন্টের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলসহ বেশ কিছু এলাকার শিশুরা সকল বই হাতে পায়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ১৫ দিন ধরে বই প্রায় চলে এসেছে বলে দাবি করলেও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এদিকে মাতৃভাষায় বই দেয়া হলেও সকল বই না পাওয়া ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাবে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কিছুটা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, আন্তর্জাতিক টেন্ডারে প্রাথমিক স্তরের বই ছাপা হলেও এখন প্রায় অধিকাংশ কাজই পাচ্ছে দেশীয় মুদ্রাকররা। এবার মোট বই ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫ কপি। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপিয়েছেন দেশী টেন্ডারেই ছাপা হয়। আর প্রাথমিক স্তরের ১১ কোটি ৫৫ লাখ ২৬ হাজার ৯৫২টি বই ছাপানো হয়েছে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে, দেশে-বিদেশে। দেশের পাশাপাশি এবার ভারত ও চীনে প্রাথমিক স্তরের বই ও উপকরণ ছাপানো হয়েছে। সাড়ে ১১ কোটি প্রাথমিকের বইয়ের মধ্যে ভারতীয় চারটি প্রতিষ্ঠান এক কোটি ৮০ লাখের মতো বই ছাপার কাজ করে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান আগেই বই পাঠিয়েছে। তবে শীর্ষাসাই বিজনেস নামের প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬০ লাখ কপি বইয়ের কাজ নিলেও এখন পর্যন্ত অধিকাংশ বই দিতে পারেনি। ভারতে প্রতিষ্ঠানটির কাজের সক্ষমতা দেখতে গিয়েছিলেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ন চন্দ্র সাহা। দেখে তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে ভারতের নামী প্রতিষ্ঠান বলেই জানিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে লোকাল এজেন্টের সক্ষমতা নিয়ে। ঢাকার বাইরের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্নধার মিঠু লোকাল এজেন্ট বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান। সদস্য (টেক্সট) অধ্যাপক রতন সিদ্দিকী জানিয়েছেন, মিঠু আমাদের টেলিফোনে জানিয়েছে তাদের বই নাকি জাহাজে করে চলে এসেছে। কোন লিখিত কাগজ এখনও আমরা পাইনি। গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে প্রতিষ্ঠানটি একই কথা বলছে বলে অভিযোগ করেছেন কর্মকর্তারা। বিষয়টি নিয়ে মিঠুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা নির্দিষ্ট সময়েই বই জাহাজে তুলেছি। কিন্তু ভারত মহাসাগরে দুর্যোগ ও শ্রীলঙ্কায় জাহাজে সমস্যা হওয়ায় দেরি হয়েছে। জাহাজ তো আর আমরা চালাইনা মন্তব্য করে তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই অধিকাংশ বই এসে গেছে। আগামী রবি-সোমবারের মধ্যে সকল বই তারা পৌঁছাতে পারবেন। জানা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানের বই দেয়ার কথা দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ অঞ্চলেরর জেলা-উপজেলায়। প্রথমেই সংকট টের পেয়ে এনসিটিবি দেশের অন্য এলাকা থেকে দুটো করে বই নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ওই এলাকায় বই উৎসব করে। এ কারণে চট্টগ্রাম ও রংপুর বিভাগের অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীদের দুই বা তিনটি করে বই দেয়া হয়। ভোলা, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, কক্সবাজারসহ অনেক জেলায় সব শ্রেণীর শতভাগ বই পৌঁছেনি। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে এনসিটিবিতে। চট্টগ্রাম ও রংপুর বিভাগের একাধিক প্রাথমিক উপজেলা শিক্ষা অফিসার জানিয়েছেন, অনেক উপজেলায় এখনও বাংলা, ইংরেজী ও অঙ্ক বই পাঠানো হয়নি। প্রতিদিন বই নিতে বিভিন্ন স্কুল থেকে শিক্ষক তাদের কাছে এসে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন। শিক্ষা অফিসাররা বারবার বইয়ের জন্য এনসিটিবির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বই যাচ্ছে, যাবে বলেই তাদের বোঝানো হচ্ছে। বিষয়টি স্বীকার করে প্রাথমিক বই সরবরাহকারী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল মজিদ বলেন, অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতে কিছু বই আটকে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি, দ্রুত এসব বই দেশে পৌঁছে যাবে। এদিকে সংকট আছে প্রথমবারের মতো দেয়া পাঁচটি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বই ও সেই বই পড়ানোর মতো প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়েও। মাতৃভাষায় বই দেয়া হলেও সকল বই না পাওয়া ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাবে আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কিছুটা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। খাগড়াছড়িতে স্ব স্ব মাতৃভাষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখনও পৌঁছেনি স্ব স্ব মাতৃভাষার সকল পাঠ্যপুস্তক। জাতিভিত্তিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করা ও পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় খোদ উদ্যোক্তারাই চ্যালেঞ্জের আশঙ্কা করছেন চলতি বছরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু নিয়ে। আদিবাসী এলাকার শিক্ষা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সকল পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হয়নি। স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রমে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও গারো সম্প্রদায়ের খাতা ও শিক্ষক নির্দেশিকা সরবরাহ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে চাকমা সম্প্রদায়ের তিন হাজার ৮৩৩টি, মারমা সম্প্রদায়ের এক হাজার ৯৭০টি, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের এক ৬২২টি ও গারো সম্প্রদায়ের ৯টি খাতা এবং তার বিপরীতে চাকমা ও মারমা সম্প্রদায়ের মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য এক হাজার ২০০টি শিক্ষক নির্দেশিকা এসেছে। শিক্ষকরা বলছেন, এর সঙ্গে বড় সমস্যা শিক্ষকরা প্রশিক্ষণও পায়নি। শিক্ষকরা কীভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাবেন তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন তারা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার জন্য বই ছাড়াও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রয়োজন বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের সূত্র জানায়, শিক্ষক প্রশিক্ষণ শুরু করারও প্রক্রিয়া চলছে। তবে প্রাকপ্রাথমিক পর্যায়ে পড়ানোর মতো শিক্ষক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে অনেক আছেন বলে বলছেন কর্মকর্তারা। জাতীয় আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলছিলেন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে যারা শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন, তারা হয়ত প্রশিক্ষণ ছাড়াও প্রাক-্রাথমিক স্তরে শিক্ষাদান করতে পারবেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম। সব জায়গায় তো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষক নেই। বিভিন্ন সময় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকদের কোটা অনুযায়ী নিয়োগ না দেয়ায় এ অবস্থা হয়েছে। তাই মাতৃভাষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষা শুরু করতে হলে বিশেষ ব্যবস্থায় জরুরীভিত্তিতে এই জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার। দেশে সরকারী হিসাবে ৩৭টি এবং বেসরকারী হিসাবে ৪৫টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থাকলেও অধিকাংশই নিজস্ব লিপি নেই। অনেকে তাই বাংলা ও আবার অনেকে রোমান হরফে তাদের ভাষার বই পড়তে রাজি হয়েছেন। এবার প্রথমবারের মতো চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ওরাও ও গারো জগগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য তাদের মাতৃভাষায় পাচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই ও শিক্ষা উপকরণ। পরবর্তী শিক্ষা বর্ষ থেকে পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরে অন্যান্য আদিবাসী শিশুরাও মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। জানা গেছে, পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভের অধিকার থাকলেও গত দুই দশক তা ছিল স্বপ্ন। সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মাতৃভাষায় শিক্ষা লাখের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি জাতীসংঘেও স্বীকৃত। তার পরেও এতদিন দেশের আদিবাসীদের জন্য ছিল একটি কেবলই স্বপ্ন। এনসিটিবি জানিয়েছে, চার বছর আগে প্রাথমিক স্তরে পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের জন্য মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষী শিক্ষা (এমএলই) বিষয়ক জাতীয় কমিটিও গঠন করেছিল সরকার। পুস্তক ছাপানোর প্রস্তুতির নানা ধাপ ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে এখন তা ছাপিয়ে বই দেয়া হচ্ছে। বিষয়টির প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখছেন এনসিটিবির সদস্য (টেক্সট) অধ্যাপক ড. মিয়া ইনামুল হক সিদ্দিকী। তিনি বলছিলেন, মোট ২৪ হাজার ৬৪৬ জন শিশুর জন্য বই ও শিক্ষা উপকরন ছাপানো হয়েছে। এ বিশেষজ্ঞ জানান, আমাদের পবিত্র সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মাতৃভাষায় শিক্ষা লাখের অধিকারের কথা সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। বিষয়টি জাতীসংঘেও স্বীকৃত। তারপরও এতদিন দেশের আদিবাসীদের জন্য ছিল একটি কেবলই স্বপ্ন। তবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের হাতে দ্রুত মাতৃভাষায় পাঠ্যবই তুলে দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে তাগাদা দিয়েছেন। নজর রাখেন সব সময়। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগের কারণেরই আমরা আজ এ কাজটি করতে পেরেছি। অন্যথায় এক কাজ সফল করা সম্ভব হতো না বলে জানান এনটিসিটিবির এ সদস্য।
×