ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নেপাল ও ভুটানের পিছুটান;###;প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা-দিল্লী;###;সরকার এখনও আশাবাদী

অনিশ্চয়তার মুখে

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

অনিশ্চয়তার মুখে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দুই দেশের আপত্তির মুখে এশিয়ার চার দেশের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ দিন দিন অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের (বিবিআইএন) মধ্যে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালের ১৫ জুন চার দেশের মধ্যে সড়কপথে যাত্রীবাহী, ব্যক্তিগত ও পণ্যবাহী যান চলাচলে মোটরযান চুক্তিও (এমভিএ) হয়েছিল। ২০১৬ সালের শুরু থেকেই এ সার্ভিস চালুর কথা ছিল। এরপর পেছানো হয় দিনক্ষণ। একের পর এক আসতে থাকে অনিশ্চয়তার সংবাদ। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর মোটা ভেহিক্যাল এগ্রিমেন্ট (এমভিএ) কার্যকরে চার দেশের মধ্যে যৌথ সমীক্ষা শুরুর কথা ছিল। নেপালের আপত্তিতে তা স্থগিত করতে হয়েছে। অথচ পরীক্ষামূলকভাবে ৪ দেশের মধ্যে এ সার্ভিস চালুর জন্য দরকার যৌথ সমীক্ষা। এর আগে ভুটানের সংসদও বিষয়টি অনুমোদন দেয়নি। সব মিলিয়ে এখন চার দেশের সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের পুরো প্রক্রিয়াটি কার্যত স্থবির বলা চলে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নেপালের দেয়া সময়সূচী অনুযায়ী সমীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন প্রস্তুতির অভাবের কথা বলে পিছিয়ে পড়েছে দেশটি। এর আগে গত বছরের নবেম্বরে ভুটান সংসদের উচ্চকক্ষে অনুমোদন পায়নি এমভিএ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আমরা আশাবাদী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আঞ্চলিত সহযোগিতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নেপাল ও ভুটান আবারও চার দেশের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনে আগ্রহী হবে। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও ঐক্য এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আরও একধাপ এগিয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক করিডরে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের আটটি মহাসড়কের প্রতিটি চার থেকে ছয় লেন পর্যন্ত করার উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৮ সালে এর কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নেপাল, ভুটান ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৬০০ কিলোমিটার মহাসড়ক যুক্ত হওয়ার কথা। এরমধ্যে এশিয়ান হাইওয়ের মূল সংযোগটি যাবে চট্টগ্রাম দিয়ে। তবে তামাবিল দিয়েও একটি পথ যুক্ত হবে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের টানেলটি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। ২০০৯ সালের ১০ আগস্ট এশিয়ান হাইওয়ের মাধ্যমে আন্তঃদেশীয় ও আঞ্চলিক যোগাযোগ স্থাপনে ‘দ্য ইন্টারগবর্নমেন্টাল এগ্রিমেন্ট অন দ্য এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্ক’ পক্ষভুক্ত হয়। ওই সময়ে একটি রুটকে প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা হয় এশিয়ান হাইওয়ের নক্সা। নানা জটিলতায় ওই নক্সা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এর পরও সংশ্লিষ্ট জাতীয় সড়কগুলো দুর্বল হওয়ায় চার লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয় সরকার। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি মহাসড়ক চার লেন নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। একাধিক প্রকল্প চলমান। সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা কারণে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হচ্ছে। বিশ্বের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সম্পন্ন অঞ্চলসমূহের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া অন্যতম। এমন বাস্তবতায় বিশ্ব বাণিজ্যের তুলনায় দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য তুলনামূলক কম। এ লক্ষ্যে মুক্তবাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগের প্রসার ত্বরান্বিত হওয়া প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টরা জানান, পুরো প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে নেপাল থেকেই যৌথ সমীক্ষা শুরুর কথা ছিল। ৫ ডিসেম্বর নেপালের কাঠমান্ডু থেকে শুরু করে ভারত হয়ে ৮ ডিসেম্বর তা শেষ হওয়ার কথা। এজন্য বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের নেপাল যাওয়ার কথা ছিল ৪ ডিসেম্বর। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে দেশটি জানায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখনও ‘ক্লিয়ারেন্স’ না পাওয়ায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। এজন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এদিকে গত বছর থেকে ভারত ও নেপাল সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছে। ভারত-নেপালের ™ি^পক্ষীয় সম্পর্কে প্রভাব পড়েছে বিবিআইএনে। নেপালের সংবিধান সংশোধন ও নানা ইস্যুতে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ১৩৫ দিন অবরোধ ছিল নেপাল-ভারত সীমান্তে। তবে নেপালের সংসদ ২০১৫ সালেই এমভিএ চুক্তি অনুমোদন দেয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মন্ত্রিসভাও চুক্তিটি অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ২০১৬ সালের শুরু থেকেই চার দেশের মধ্যে পণ্য ও যাত্রীবাহী যান চলাচল শুরু করা সম্ভব হবে। সূত্র জানায়, ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে গত বছরের ১৫ জুন সড়ক যোগাযোগ চুক্তি (এমভিএ) সই হয়। তখন জানানো হয়েছিল, এই চুক্তির আওতায় চার দেশের মধ্যে বিনা বাধায় সড়ক পথে সরাসরি যানবাহন চলবে। অর্থাৎ চুক্তিতে নির্ধারিত পথে ঢাকা থেকে ভারতের ওপর নিয়ে নেপাল ও ভুটান যাওয়া যাবে। ভারতের চারটি শহরেও বাংলাদেশের যানবাহনের প্রবেশাধিকার থাকবে। অথচ ওই স্বাগতিক দেশের সংসদের উচ্চকক্ষ ‘সোংডু’তে অনুমোদন পায়নি যান চলাচল চুক্তি। গত ২০ নবেম্বর ২০ সদস্যের উচ্চকক্ষে চুক্তির পক্ষে ভোট পড়ে মাত্র দুটি। চুক্তির বিপক্ষে ভোট দেন ১৩ সদস্য। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভুটানের উচ্চকক্ষের অভিমত চার দেশের মধ্যে সরাসরি যান চলাচল চালু হলে দেশটিতে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এতে বাড়বে পরিবেশ দূষণ। সীমান্ত থেকে থিম্পুগামী সড়কগুলো বনের ভেতর দিয়ে গেছে। এসব সড়কে অতিরিক্ত যান চলাচলের কারণে বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভুটানের সড়কগুলোয়ও অধিকসংখ্যক যান চলাচলের উপযোগী নয়। এসব যুক্তিতে উচ্চকক্ষ এমভিএ অনুমোদন করেনি। তাই বিবিআইএন কার্যকরে বাংলাদেশ ও ভারত প্রস্তুত থাকলেও ভুটানের প্রত্যাখ্যানের পর নেপালের আপত্তিতে অনিশ্চয়তায় পড়ছে চার দেশের মধ্যে সড়ক পথে যান চলাচল পরিকল্পনা। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ জানায়, ভুটানের আপত্তি অবশ্য নতুন নয়। এর আগে গত মার্চে দেশটি বিবিআইএন-এমভিএয়ে জন্য নির্ধারিত পথ নিয়ে আপত্তি জানায়। চার দেশের মধ্যে যান চলাচলে যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি ১৮ রুট নির্ধারণ করলেও ভুটান তখন নেপাল ও বাংলাদেশের যানবাহন থিম্পু পর্যন্ত চলাচলে আপত্তি জানিয়েছিল। শুধু ভারতীয় গাড়ি থিম্পু পর্যন্ত চলাচলের সুযোগ দিতে রাজি ভুটান। গত বছরের মার্চে এমভিএর প্রটোকলের খসড়া প্রণয়নের সময় এ আপত্তি জানায় ভুটান। প্রসঙ্গত চুক্তিতে নির্ধারিত পথে ঢাকা থেকে ভারতের ওপর নেপাল ও ভুটান যাওয়া যাবে। ভারতের চারটি শহরেও বাংলাদেশের যানবাহনের প্রবেশাধিকার থাকবে। এরই মধ্যে প্রটোকলের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এমভিএ চার দেশের অনুমোদন পেলে প্রটোকল অনুমোদন করার কাজ শুরুর কথা ছিল। বিনা বাধায় যান চলাচলের কথা বলা হলে খসড়া প্রটোকল অনুযায়ী, যানবাহনের সংখ্যা ও পথ নির্দিষ্ট থাকবে। শুল্ক নির্ধারণ ও আদায় করা হবে বিবিআইএনভুক্ত দেশগুলোর নিজস্ব আইনে। এ প্রকল্প প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএন সিদ্দিক সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা পর্যায়ক্রমে সড়কগুলো ফোর লেনে নিয়ে যাব। ইতোমধ্যেই ১ হাজার ৫০১ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুর উভয়পাশে এ্যাপ্রোচ সড়ক ফোর লেনে উন্নীত করতে যাচ্ছি। সিরাজগঞ্জের হাঁটিকুমরুল, রংপুরের বুড়িমারী পর্যন্ত ২৯৫ কিলোমিটার সড়ক ফোর লেনে উন্নীতকরণ কাজ আগেই শুরু হয়েছে। বাকি সড়কগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্পের আওতায় ফোর লেনে নেয়া হবে। ৬০০ কিলোমিটার ফোর লেনে নিয়ে যাওয়া অনেক সময়ের বিষয়। তবে নক্সার কাজ শেষ হলে পর্যায়ক্রমে ফোর লেন হবে। এশিয়ান হাইওয়ে সাউথ এশিয়া সাব রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) ও বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডরে (বিসিআইএম) এই নক্সা করা হবে। দুই লেন থেকে চার লেন এমনকি স্থান ভেদে ছয় লেনেও রূপান্তর করা হবে সড়কগুলো। জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন (ইউএন-এসকাপ) তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলছে, প্রাইমারি সড়কের শর্ত পূরণ হয়, এমন কোন সড়ক-মহাসড়ক বাংলাদেশে নেই। মূলত এক্সপ্রেসওয়েগুলো প্রাইমারি সড়ক হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে কোন এক্সপ্রেসওয়ে নেই। এশিয়ান হাইওয়ের রুটভুক্ত ১ হাজার ৭৪১ কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র ৭২ কিলোমিটার সড়ক চার লেনের। এগুলো প্রথম শ্রেণীর আওতাভুক্ত। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে, এশিয়ান হাইওয়েভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সড়ক উন্নয়নে সবচেয়ে এগিয়ে চীন, জাপান, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক ও মালয়েশিয়া। ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডও সংশ্লিষ্ট সড়কগুলো দ্রুত উন্নয়ন করছে। গবেষকরা বলছেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক করিডরে যুক্ত হওয়ার জন্য দ্রুত মহাসড়কগুলো উন্নত করছে। পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান এমনকি মিয়ানমারও এ্যাকসেস কন্ট্রোলড (প্রবেশ সংরক্ষিত) সড়ক নির্মাণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন একটি সড়কও নেই। চার লেনের কিছু সড়ক থাকলেও সেগুলোয় দ্রুতগতির যানবাহনের সঙ্গে রিক্সা, ভ্যান, বাইসাইকেল, নসিমন, করিমন চলছে। এশিয়ান হাইওয়ের রুটভুক্ত প্রতিটি মহাসড়কেরই একই অবস্থা। এগুলোর উন্নয়নে কার্যকর কোন পদক্ষেপ এখনও নেয়া হয়নি। সম্প্রতি দেশের ২২ মহাসড়কে অযান্ত্রিক পরিবহনসহ সিএনজিচালিত অটোরিক্সা, নসিমন, করিমন ও ভটভটি সরকারীভাবে চলাচল নিষিদ্ধ করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
×