ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

পাঠ্যবইয়ের হেজাবিকরণ

প্রকাশিত: ০৩:৫৪, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

পাঠ্যবইয়ের হেজাবিকরণ

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) পাঠ্যপুস্তকে প্রতিবছর একজনের কবিতা বা গল্প থাকবে এটি কোন যুক্তির কথা নয়। বদল হতেই পারে। কিন্তু অভিযোগ পাঠ্য বদল, ভুল এবং হেজাবি বা আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে হেফাজতের নির্দেশে এসব করা হয়েছে। পাঠ্য বদলের বিষয়ে আমার বক্তব্য বলেছি, ভুল দু’ধরনের হতে পারে- বানান ও ইচ্ছাকৃত সংশোধন। বানান ভুল হতেই পারে কেননা একেক সময় একেক রকম বানান রীতি আমরা গ্রহণ করি বা ব্যবহার করি। সেটি সংশোধন করে এখনও সব স্কুলে পাঠানো যেতে পারে। কিন্তু বলা হচ্ছে, যেসব ভুল চিহ্নিত হচ্ছে সেগুলো অমার্জনীয়। তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা বইয়ে কুসুম কুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতা এতদিন বইয়ে ঠিকভাবে থাকলেও এবার বেশ কয়েকটি লাইন বিকৃত করা হয়েছে। মূল কবিতায় আছে ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’। আর বইয়ে ছাপা কবিতায় লেখা হয়েছে ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে?’ এছাড়া ‘মানুষ হইতে হবে- এই তার পণ’ এর বদলে লেখা হয়েছে ‘মানুষ হতেই হবে’। বিকৃতি কেবল একুটুই নয়, কবিতার চতুর্থ লাইনে কুসুম কুমারী লিখেছেন, ‘মানুষ হইতে হবে’- এই তার পণ। বিকৃত কবিতায় ‘হইতে’ শব্দটিকে ‘পা-িত্য’ দেখিয়ে ‘সম্পাদনা’ করে ‘হতেই’ লিখেছেন পাঠ্য রচয়িতারা। [জনকণ্ঠ, ১০.১.১৭] মূল রচয়িতার পাঠ বদলাবার ক্ষমতা কোন সম্পাদক বা সংকলকের নেই। তিনি ফুটনোটে ব্যাখ্যা দিতে পারেন কিন্তু সেটি যদি স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে হয়। কিন্তু আমি দারুণভাবে অবাক হয়েছি, যখন একজন সম্পাদক মাহবুবুল হক বলেছেন, ‘একটি মৌলিক কবিতার পঙক্তি এভাবে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করা যায় না। ‘হইলে’ শব্দটি ব্যবহারে যদি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাধু ও চলিতের মিশ্রণ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে হয়, সেক্ষেত্রে সম্পাদক তা পরিবর্তন করতে পারেন। তবে অবশ্যই মূল কবিতার নিচে ফুটনোট দিয়ে ‘পরিমার্জিত’ কথাটি লিখতে হবে। একইভাবে যুক্ত বর্ণ সম্পর্কে ধারণা নেই এমন শিক্ষার্থীর জন্য বানান ভেঙে ফেলা যেতে পারে। তবে, এ কথা আবারও বলছি, এসব ক্ষেত্রে লেখক, সম্পাদক বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে তা করবে। [প্রথম আলো, ১৫.১.১৭] তার বক্তব্যের প্রথম লাইনের সঙ্গে বক্তব্যের বাকি অংশ সাংঘর্ষিক। প্রিয় মাহবুব ভাই, পাকিস্তান আমলে নজরুল ইসলামের কবিতায় শব্দ পরিবর্তন নিয়ে এত হৈ চৈ হলো কেন? আপনি নিজেও তো উদাহরণ হিসেবে এ কথা বলেছেন, হয়তো লিখেছেনও। নজরুলের কবিতার শব্দ বদল করে ‘পরিমার্জন’ লিখলে কি তা গ্রহণযোগ্য হবে? তা’হলে কি পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় সম্পাদকরা জড়িত? এভাবে প্রতিটি স্তর বিশ্লেষণ করলে দেখবেন কারো কথার সঙ্গে কারো কথা মিলছে না। সে বিষয়ে পরে আসছি। বলছিলাম প্রতিটি শ্রেণীর বইয়েই গ-গোল আছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এবারের পাঠ্যবইয়ের মলাটে কি কি স্লোগান ব্যবহার করা হবে তা এনসিটিবিকে ওপর থেকেই অনুমোদন করে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দু ধর্ম বইয়ের শেষ মলাটের স্লোগান ছিল- ‘পরনিন্দা ভালো নয়’। কিন্তু পাঠ্যবই ছাপানোর পর দেখা গেছে, এই বইয়ের স্লোগান বাংলার পরিবর্তে ইংরেজীতে লেখা হয়েছে ‘ডু নট হার্ট এনিবডি’। মজার বিষয় হচ্ছে- প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অনুমোদিত এ স্লোগানটি কে বাদ দিল- তার নাম এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি, পাঠ্যবই থেকে বাদ দেয়া হয়েছে হিন্দু ও প্রগতিশীল লেখকদের অনেক রচনা। কেন এসব বাদ দেয়া হয়- তা নিয়ে কার্যত কেউ মুখ খুলছেন না।’ [ঐ] উল্লেখ্য, এখানে ব্যবহৃত ইংরেজি ‘হার্ট’ শব্দটির বানান ভুল। শিক্ষার মান নিয়ে কথা উঠছে তাই এটি উল্লেখ করলাম। পঞ্চম শ্রেণীর ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’-এর প্রথম অধ্যায়ের ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’-এর কথা বলি। চলবে...
×