ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডাভোস সম্মেলন, নতুন অতিথি ও এ মুহূর্তের পৃথিবী -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৫২, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭

ডাভোস সম্মেলন, নতুন অতিথি ও এ মুহূর্তের পৃথিবী -স্বদেশ রায়

ডাভোস রিসোর্টের বাইরে এখন মাইনাস ২২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা। গভীর ঘুমে মগ্ন সুইজারল্যান্ড। তখনই ওই ডাভোস রিসোর্ট থেকে অনেক দূরে বসে এ লেখা লিখছি। ভোর হতেই ডাভোসের চারপাশের তাপমাত্রা বেড়ে মাইনাস ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে গিয়ে দাঁড়াবে। সঙ্গে থাকবে মেঘ ও হিম বাতাস। কিন্তু তারপরেও বিখ্যাত এ রিসোর্টে ক্লাউস সোয়াব সৃষ্ট ওয়ার্ল্ড ইকোনমি ফোরামের সম্মেলনে জড়ো হবে ২৫০০ হাজার পৃথিবীর নেতা। তারা কেউ রাজনৈতিক নেতা, থিয়োরি অর্থনীতির সুপ-িত, কেউ প্রাকটিক্যাল অর্থনীতির সফল ব্যক্তি, অর্থাৎ শিল্পপতি আর সঙ্গে থাকবেন নন্দিত সাংবাদিক যারাও বক্তব্য রাখবেন পৃথিবীর অর্থনীতির এই পরিবর্তনে। যাহোক, এ লেখা যখন প্রকাশ হবে তখন ডাভোস সম্মেলন শেষ হতে আর মাত্র একদিন বাকি থাকবে। ততক্ষণে অধিকাংশ নেতার বক্তব্য শেষ হয়ে যাবে। তারা একটি সিদ্ধান্তের দিকে যাবেন। তারপরে তাদের সামনে সময় থাকবে সেগুলো বাস্তবায়ন করার কাজ। এতক্ষণে সবাই জানেন, এই সম্মেলনের সেøাগান হচ্ছে, ‘রেসপনসিভ এ্যান্ড রেসপনসিবল লিডারশিপ’ এই দ্রুত এ্যাক্ট করার ও দায়িত্ববান নেতার ক্যাটাগরিতে এবারের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এবারের এ সম্মেলনে আকর্ষণীয় দুই নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব হচ্ছেন চায়নার প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চায়নার কোন প্রেসিডেন্টের এই প্রথম ডাভোস সম্মেলনে যোগদান এবং বাংলাদেশের কোন প্রধানমন্ত্রী গেলেন এই প্রথম। ডাভোস সম্মেলনে কোন্ ধরনের নেতারা আমন্ত্রণ পান সেটা সকলেই জানেন। তাদের দেয়া বেশ কিছু কোয়ালিটি মেইনটেইন করে এই আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে এক কথায় সে কোয়ালিটিকে প্রকাশ করা যায়, সেই সব নেতৃত্বকে আমন্ত্রণ জানানো হয়- যারা পৃথিবীকে, পৃথিবীর অর্থনীতিকে এবং মানব সমাজ ও সভ্যতাকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখেন। সে হিসেবে শেখ হাসিনার এ যোগদান বাংলাদেশকে গর্বিত করেছে। এবারের সম্মেলনটা নিঃসন্দেহে একটি পরিবর্তিত পৃথিবীতে হচ্ছে। কারণ, ২০০৮ ও ২০০৯-এর অর্থনৈতিক মন্দার রেশ কিছুটা সঙ্গে নিয়ে এগোনো পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় ২০১৫ ও ১৬-এর মাইগ্রেশন সমস্যা। এই সমস্যায় যখন পৃথিবী অনেকখানি জর্জরিত, তখনই ঘটে ব্রেক্সিটের ঘটনা। তার পর পরই আমেরিকার রিপাবলিকান পার্টির নেতা ‘পপুলিস্ট’ ও অনেকখানি ‘আইসোলেশন’ অর্থনীতির ঘোষণা দিয়ে ল্যান্ড সøাইড বিজয় অর্জন করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের আইএস, তার কারণে সৃষ্ট মাইগ্রেশন আবার তার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক্সিট ও আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্টের অনেকটা এন্টি গ্লোবালাইজেশন ও ব্রেক্সিটের মতো এন্টি ওয়ার্কার মাইগ্রেশনের পক্ষে রায় পাওয়া। এ সবই কিন্তু পৃথিবীতে অনেক বড় বড় এক একটি ভূমিকম্প। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে যে মাইগ্রেশন হয়েছে এর শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইমপ্যাক্ট কী হবে তা এখনও কেউ বলতে পারছেন না। অন্যদিকে ব্রেক্সিট আরেক ভূমিকম্প ইরোপের জন্য। কারণ, তিন দশক ধরে গড়ে উঠেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যেখানে ২৮টি দেশ সীমান্ত ছাড়া গড়ে তুলেছে তাদের অর্থনীতি ও মানুষের যোগাযোগ। এখন যদি হঠাৎ করে বর্ডারের পর বর্ডার দিয়ে একটি ইউরোপের যাত্রা শুরু হয়, তাহলে শুধু ইউরোপের অর্থনীতিতে নয়, বিশ্ব অর্থনীতিতে তা সত্যিই একটা ভূমিকম্প হবে। কারণ, নতুন করে আবার যাত্রা করতে হবে ইউরোপীয় অর্থনীতিকে, বিসর্জন দিতে হবে গ্লোবালাইজেশনকে (অর্থাৎ পায়ের পাতাকে পেছনমুখী করতে হবে, ইউরোপীয়দের কল্পনায় তৈরি ভূতের পায়ের মতো)। অন্যদিকে আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী কর্মসূচী ছিল অনেকখানি এন্টি গ্লোবালাইজেশন ও এন্টি মাইগ্রেটেড ওয়ার্কার। এর ভেতর দিয়ে তিনি তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ সেøাগান এনেছেন। ডাভোস সম্মেলনে নেতাদের বক্তব্য শুরু হওয়ার আগেই এ লেখা লিখছি, তাই সেখানে এ বিষয়ে কী বক্তব্য আসবে তা জানি না। তবে এই একটি সম্মেলনের বক্তব্য দিয়ে তো আর ইউরোপের ও আমেরিকার এই পরিবর্তনকে বন্ধ করা যাবে না। বাস্তবতা হলো এটা বন্ধ করতে হবে। আর এ জন্যই রেসপনসিভ এ্যান্ড রেসপনসিবল লিডারশিপই এখন পৃথিবীতে প্রয়োজন। কারণ, আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট যদি মনে করেন, তিনি আইসোলেশনের মাধ্যমে আমেরিকাকে গ্রেট করবেন তাহলে সেটা হবে তার বর্তমান বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সব থেকে বড় ভুল। বড় দেশের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের একটি ভুল যে শুধু সে দেশের নয়, বিশ্ব অর্থনীতির জন্য কত বড় ক্ষতিকর হতে পারে তার সাম্প্রতিক প্রমাণ, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ শ’ ও এক হাজার টাকার নোট বাতিল করার সিদ্ধান্ত। এই ছোট্ট একটি সিদ্ধান্ত যে সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ক্ষতি টেনে এনেছে তা ভারত ও তার সঙ্গে জড়িত যাবতীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের দেশগুলোর ওপর পড়বে। তাই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যদি প্রোটেকশন ও আইসোলেশনের পথে যান তাহলে তা যেমন তার দেশের জন্য, তেমনি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য একটা ভয়াবহ দুর্যোগ হবে। কারণ, চীন ও রাশিয়ার যতই উন্নতি হোক, এখনও পর্যন্ত আমেরিকা গ্লোবালাইজড বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি। এমনকি, আমেরিকা সেই ধরনের অর্থনৈতিক শক্তি যে হয়ত পৃথিবীকে বাদ দিয়ে কিছু সময়ের জন্য টিকে থাকবে কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে পৃথিবীর অর্থনীতি এগোনো এ মুহূর্তে অনেক অসাধ্য বিষয়। এমনকি যে থিওসিডাইডিস ট্রাপ হিসেবে আমেরিকা চীনকে ভয় পাচ্ছে (বিশেষ করে আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট) ওই চীনেরও কিন্তু আমেরিকাকে এখনও বহুদিন প্রয়োজন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বাস্তবে গ্লোবালাইজেশনের পরে এ মুহূর্তে পৃথিবীতে যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে; যেগুলো নিয়ে অনেকে ভীত হচ্ছেন। আমেরিকার মতো দেশ আইসোলেশনের কথা ভাবছে। তাদের ভেবে দেখা দরকার বাস্তবে এ মুহূর্তে যা ঘটছে তা আদৌ গ্লোবালাইজেশনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া, না পৃথিবীর অভাবনীয় টেকনোলজিক্যাল, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ফল। বাস্তবে এটা পৃথিবীর অভাবনীয় টেকনোলজিক্যাল অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের ফল। এই পরিবর্তনের গতিটাই ভেবে দেখলে কিন্তু গ্লোবালাইজেশনের ভয় না পেয়ে বরং পরিবর্তনের গতির সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে গ্লোবালাইজেশনের সুফল ভোগ করতে পারবে সকলে। আর সে গতির পরিমাপটা কেমন তা ছোট্ট একটা উদাহরণ থেকে বোঝা যায়, আগে একটি জেনারেশন বা প্রজন্মকে ধরা হতো বারো বছর। এখন আইফোনের নিউ জেনারেশন আসে ছয় মাস পরে। অর্থাৎ জেনারেশন এখন পরিবর্তন হচ্ছে ছয় মাসে, বারো বছরে নয়। তাই বারো বছরের কাজ ছয় মাসে করার গতিতেই এখন পৃথিবীকে চলতে হবে। প্রস্তুত হতে হবে এই ভেবে যে, এ গতি আরও বাড়বে। এখানে স্থির হয়ে, বিচ্ছিন্ন হয়ে বসে থাকার কোন উপায় নেই। যে কারণেই বর্তমানের এই দ্রুতগতির জটিল পৃথিবীতে যে কোন ক্ষেত্রের নেতাকে অনেক বেশি সজাগ, আধুনিক ও তথ্য সমৃদ্ধ হতে হবে। কারণ, এখনও পৃথিবী বহু ইমোশনাল ওলট পালটের চিন্তা ধারাকে ধারণ করে বসে আছে। এখান থেকে পৃথিবীকে বের করে এনে পৃথিবীর জন্য একটি বাউন্ডারি শূন্য ম্যাপ তৈরি করতে হবে; যে পৃথিবীর ম্যাপটিতে রেখা থাকবে, দেশ চিহ্নিত হবে কিন্তু ওই রেখা কোন বাধা দেয়া বাউন্ডারি হিসেবে চিহ্নিত হবে না। যারা দারিদ্র্যকে মোকাবেলা করার জন্য পপুলিস্ট নীতি গ্রহণ করছেন, তাদের আরও বেশি গ্লোবালাইজেশনকে গ্রহণ করতে হবে। তবেই কিন্তু দারিদ্র্য থেকে মুক্তি আসবে। বাস্তবে ইউরোপীয় ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন এ্যান্ড ডেপেলপমেন্ট এর প্রেসিডেন্ট সুমা চক্রবর্তীর কথাই বলা যেতে পারে যে, ‘নানা ধরনের বক্তব্যের মতামতের বা এ্যাপ্রোচের ভেতর দিয়ে পৃথিবী আরও অনেক দূর যেতে পারে, তাই বলে তো কোন শিশুকে বাথটাবের পানি থেকে বাইরে ছুড়ে ফেলে দেয়া সম্ভব নয়।’ সত্যি অর্থে গ্লোবালাইজেশনের আরও অনেক পরিবর্তন হবে, আরও আধুনিক ভার্সান আসবে। তবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সময়ের পরিবর্তনে তা হবে। কিন্তু তার মানে কখনও এই নয় যে, এ মুহূর্তে পৃথিবীকে গ্লোবালাইজেশনের থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এবং আশার কথা, গ্লোবাল ইকোনমি গত কয়েক বছরের থেকে এ মুহূর্তে অনেক ভাল। প্রায় সব বড় বড় স্টক মার্কেটের কার্ব এখন ওপরের দিকে দ্রুত যাচ্ছে, তেলের দাম আবার বাড়ছে, এমনকি চীনে যে মন্দা এসেছিল সে মন্দাও কেটে যাচ্ছে। অর্থাৎ এ তিনই বলে দেয়, পশ্চিমা, মধ্যপ্রাচ্য এবং পূর্ব ও দক্ষিণ এশীয় সব দেশের অর্থনীতি আবার ভালোর দিকে যাবে। সর্বোপরি ওয়ার্ল্ড ইকোনমি ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সোয়াবের কথা থেকে নিয়েই শেষ করা যায়, আমরা যেন গ্লোবালাইজেশনকে বলিরপাঁঠা (স্কেপগোট) না করি, বরং বেরিয়ে আসি আবেগের ঝড় থেকে। [email protected]
×