ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ

দুঃস্বপ্নের ওয়েলিংটন টেস্ট

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭

দুঃস্বপ্নের ওয়েলিংটন টেস্ট

ভাগ্য বিধাতা শেষ পর্যন্ত হেসেছেন প্রতিপক্ষের দিকে চেয়ে। অনেক ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও ওয়েলিংটনে চারদিন পর্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানটা ছিল বাংলাদেশেরই। কিন্তু মানুষ যা ভেবে রাখে সেটার বাস্তব প্রতিফলন ঘটানোর নিয়ন্ত্রণটা তো বিধাতার হাতে। আর সে কারণেই বেসিন রিজার্ভে ১২২ বছরের পুরনো রেকর্ড ভেঙ্গে গেছে। দারুণ অবস্থানে থাকার পরও ভাগ্য বদলে গিয়ে বাংলাদেশের কপালে তিলক এঁটেছে ৭ উইকেটে পরাজয়ের। এর পেছনে শুধু কি পঞ্চম দিনে দলের ব্যাটিং বিপর্যয়টাই দায়ী? হয়ত বা এমনটা নাও হতে পারত। চারদিন পর্যন্ত যে টেস্টে সবাই অবশ্যম্ভাবীভাবে ড্র দেখছিলেন তাদের জন্য বিস্ময় হয়ে গেছে বাংলাদেশের পরাজয়। ১৮৯৪ সালে সিডনি টেস্টে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৫৮৬ রান করেও ইংল্যান্ডের কাছে হেরে গিয়েছিল। বাংলাদেশ দল ৮ উইকেটে ৫৯৫ রান তুলে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করেও হেরেছে। নতুন রেকর্ড! দলে ইনজুরির অনবরত আঘাতটাই এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ হিসেবে উঠে এসেছে। সবমিলিয়ে দুর্দশা, হতাশা আর বিপর্যয়ে পরিপূর্ণ একটি টেস্ট পার করেছে বাংলাদেশ দল এক অভাবনীয় কষ্টের অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে। ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভ ভুলে যাওয়াটাই ভাল বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য। শুরু থেকেই সফরকারী বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি ছিল প্রতিকূলতায় পরিপূর্ণ। তীব্র শীতের সঙ্গে অচেনা পরিবেশ ও ভিন্নধর্মী উইকেটে এবার নিউজিল্যান্ডে প্রথম থেকেই সংগ্রামের মধ্যে পড়ে যায় বাংলাদেশ। এর সঙ্গে ক্রিকেটারদের লড়তে হয়েছে ইনজুরির সঙ্গে। ফলশ্রুতিতে গত দুই বছরে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যে ঈর্ষণীয় সাফল্য সেটা পুরোপুরি টলে যায়। ওয়ানডে ও টি-২০ উভয় সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হয় বাংলাদেশ দল। টেস্ট সিরিজে এ কারণে খুব বেশি প্রত্যাশার কিছু ছিল না। তাছাড়া অধিনায়ক ও অন্যতম ব্যাটিং নির্ভরতার নাম মুশফিকুর রহীম তীব্র হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি নিয়ে একটিমাত্র ওয়ানডে ছাড়া খেলতেই পারেননি বাকি সীমিত ওভারের ম্যাচগুলো। টেস্ট খেলবেন কিনা সেটাও ছিল সংশয়ে! তবে সেই মুশফিক খেললেন পুরোপুরি ফিটনেস অর্জন না করেও। টস হার দিয়ে প্রথম ব্যাকফুটে চলে যাওয়া দিয়ে শুরু বাংলাদেশের। বেসিন রিজার্ভে শীতের সঙ্গে ছিল ঝড়ো হাওয়া। বলের গতিপ্রকৃতি বুঝে ওঠাটাই দায়। এমনকি একজন মানুষের পক্ষেও ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছিলনা। ব্যাটিংয়ের সময় সেই বাতাসের ঝাপটাকেও সামাল দিয়ে ক্রিজে থাকতে হয়েছে। পায়ের ব্যথা নিয়ে মুশফিক ব্যাটিংয়ে নেমে দুই হাতে বলের আঘাত পেয়েছেন। বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও বা হাতের তর্জনিতে প্রচ- আঘাত পান। মাঠেই কয়েকবার চিকিৎসা নিতে হয়েছে ফিজিওর কাছ থেকে। এরপরও সাকিব আল হাসানের সঙ্গে ৩৫৯ রানের রেকর্ড জুটি গড়েন পঞ্চম উইকেটে। যে কোন উইকেটে বাংলাদেশের পক্ষে এটিই সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড। দেশের পক্ষে তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে টেস্টে সর্বাধিক ব্যক্তিগত ২১৭ রানের ইনিংস উপহার দেন সাকিব। আর মুশফিক ব্যথা সয়েও খেলেন ১৫৯ রানের অসাধারণ একটা ইনিংস। ৮ উইকেটে ৫৯৫ রান তুলে টেস্টে নিজেদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। তখন ম্যাচের তৃতীয় দিন। নিউজিল্যান্ড ৩ উইকেটে ২৯২ রান তুলে শেষ করলেও ৩০৩ রানের বড় ব্যবধানে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ। বেশ কয়েকটা সহজ ক্যাচ ছাড়ার কারণে আরও ভাল চেহারা পায়নি বাংলাদেশের বোলিং। চতুর্থ দিনে সেই সুযোগে ৫৩৯ রান পর্যন্ত করে গুটিয়ে যায় কিউইরা। তবে ৫৬ রানে এগিয়ে থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে কিন্তু সফরকারীরাই, চাপে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে গেল এরপরই। ছক উল্টে বিপদ ঘনিয়ে আসল বাংলাদেশ শিবিরে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামার পর। তারপর থেকে যা ঘটল কোনটাই বাংলাদেশের ক্রিকেট মনে রাখতে চাইবে না। দুঃস্বপ্ন আর দুর্ভাগ্যের ভেন্যু ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভ। চারদিনের উজ্জ্বলতা প্রথম টেস্টের পঞ্চমদিনে যেভাবে বিপর্যয়ে মলিন হয়েছে সেটা ভুলেই যেতে চাইবে বাংলাদেশ ক্রিকেট। কারণ নিউজিল্যান্ডের কাছে এই শেষদিনের ব্যর্থতায় ৭ উইকেটে হেরে গেছে বাংলাদেশ দল। টেস্ট ক্রিকেটে এটা অবিশ্বাস্যই, কারণ ১২২ বছরে এমনটা ঘটেনি। ম্যাচের চারদিন পর্যন্ত ছিল বাংলাদেশেরই দখলে। কারণ ১২২ রানের লিড নিয়ে ফেলেছিল সফরকারীরা। যদিও দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৬ রান তুলতেই ৩ উইকেট হারানোর কারণে পরাজয়ের ডঙ্কা বাজছিল নেপথ্যে। শঙ্কাটা তীব্র হয়েছিল ইনজুরি আক্রান্ত মুশফিকুর রহীম ও ইমরুল কায়েস ব্যাট করতে পারবেন কিনা সেই সংশয়ে। ঘটনাবহুল একটি টেস্ট- যেখানে সবগুলো দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের কপালেই লেখা হয়েছে। কিন্তু সব প্রতিকূলতাকে জয় করে দুর্দান্ত ব্যাটিং নৈপুণ্য দেখায় বাংলাদেশ। ৫৬ রানে এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর পরও স্বাগতিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল বাংলাদেশের। ৪৬ রান পর্যন্ত টিকে ছিলেন তামিম ইকবাল ও ইমরুল। কিন্তু মুশফিকের অনুপস্থিতে টানা ১৪২ ওভার উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব পালন করা ইমরুল কোমরের ব্যথায় মাঠ ছাড়েন স্ট্রেচারে করে। তারপরই বিপদ- দিনশেষে ৩ উইকেটে ৬৬ বাংলাদেশ। ১২২ রানের লিড থাকলেও পঞ্চম দিনে চ্যালেঞ্জটা কঠিণ ছিল বাংলাদেশের দুই ব্যাটসম্যান মুমিনুল হক ও সাকিবের ওপর। কিন্তু সাকিব দিনের অষ্টম বলেই সাজঘরে ফেরেন ০ রানে। টেস্ট ইতিহাসে প্রথম ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরির পর দ্বিতীয় ইনিংসে শূন্য রানে সাজঘরে ফেরার ঘটনা এটি সপ্তম। তবে কোন বাঁহাতির জন্য প্রথম। মুমিনুলও মাত্র ২৩ রান করে সাজঘরে ফিরলে বিপদে পড়ে বাংলাদেশ। সাব্বির বেশ ধৈর্য নিয়ে খেলছিলেন। তাকে সঙ্গ দিতে বাধ্য হয়েই নামেন মুশফিক ফোলা আঙ্গুলের ব্যথা নিয়ে। কিন্তু আরও বড় বিপত্তি ঘটে ইনিংসের ৪৩তম ওভারে। টিম সাউদির হঠাৎ উঠে আসা বল থেকে বাঁচতে মাথা ঘুরিয়ে নেন ১৩ রান করা মুশফিক। সেটা তার হেলমেটের পেছনে ঘাড়ে আঘাত করে সরাসরি। উইকেটে লুটিয়ে পড়ার পর কিছুক্ষণ মাঠেই চিকিৎসা করে এ্যাম্বুলেন্সে তাকে পাঠানো হয় ওয়েলিংটন হাসপাতারে স্ক্যানের জন্য। ওই অবস্থা থেকেও লড়াই করছিলেন সাব্বির, তাকে সঙ্গ দিতে পারেননি আর কেউ। তবে ক্যারিয়ারের তৃতীয় অর্ধশতক হাঁকিয়ে (১০১ বলে ৯ চারে ৫০) সাব্বির সাজঘরে ফেরার পর ইমরুলও ব্যাট হাতে নামেন। তবে তার সঙ্গী ছিলনা কেউ। ১৬০ রানেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। ইমরুল অপরাজিত থাকেন ৩৬ রানে। মাত্র ২১৬ রানের লিড। ২১৭ রানের ছোট টার্গেট হলেও বাংলাদেশ বোলারদের দারুন শুরুটা চাপেই রেখেছিল নিউজিল্যান্ডকে। দলীয় ৩৯ রানেই সাজঘরে ফেরেন প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান টম লাথাম (১৬) ও জিত র‌্যাভাল (১৩)। প্রথম ইনিংসে সুবিধা করতে না পারলেও তরুণ অফস্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ জ্বলে উঠে জোড়া আঘাত হানেন। কিন্তু তৃতীয় উইকেটে উইলিয়ামসন ও অভিজ্ঞ রস টেইলর আগ্রাসন চালিয়েছেন। তাদের ঝড় বয়ে গেছে মেহেদি আর তাসকিন আহমেদের ওপর। মাত্র ১৫২ বলে তারা জুটিতে যোগ করেন ১৬৩ রান। টেইলর ৭৭ বলে ৬ চারে ৬০ রান করার পর শুভাশিষ রায়ের পেসে সাজঘরে ফেরেন। কিন্তু ততোক্ষণে জয়ের সন্নিকটে চলে গেছে কিউইরা। উইলিয়ামসন ক্যারিয়ারের ১৫তম শতক হাঁকিয়ে ১০৪ রানে অপরাজিত (৯০১ বলে ১৫ চার) থেকে সেই জয় নিশ্চিত করেন। ১৮৯৪ সালে ৭দিনের টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার দুর্ভাগ্যের পর ১৯৭২ সালে মেলবোর্নে পাকিস্তান দল ৫ দিনের টেস্টে আক্ষেপের পরাজয় দেখেছিল। প্রথম ইনিংসে ৫৭৪ রান করেও ৯২ রানে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারে তারা দ্বিতীয় ইনিংসে ২০০ রানে গুটিয়ে গিয়ে। আর বাংলাদেশ দল এমন দুর্ভাগ্যের সঙ্গী হয়েছে দ্বিতীয়বার। ২০১২ সালে মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৫৫৬ রান করেও হেরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ওয়েলিংটন সবচেয়ে বড় আঘাত দিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। কারণ এর আগে ৮বার ইনিংস ঘোষণা করে কখনও হারেনি তারা। এবারও প্রতিটি মুহূর্তে সার্বিক পরিস্থিতিতে লড়েছেন ক্রিকেটাররা। তীব্র লড়াইটা ছিল নিজের শরীরের সঙ্গেও। কিন্তু এত সংগ্রামের মধ্যেও শেষটায় গোলমেটে পরিস্থিতি। তাই আক্ষেপ আর হতাশায় এবার বেসিন রিজার্ভে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নই বাংলাদেশের সঙ্গী হয়েছে।
×