ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

‘৭ খুন মামলার রায়ে নারায়ণগঞ্জের কলঙ্ক মোচন হবে’

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭

‘৭ খুন মামলার রায়ে নারায়ণগঞ্জের কলঙ্ক মোচন হবে’

স্টাফ রিপোর্টার/ নিজস্ব সংবাদদাতা, নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার এই রায়ের মাধ্যমে সন্ত্রাসের জনপদ খ্যাত নারায়ণগঞ্জের কলঙ্ক মোচন হবে বলে জানিয়েছেন এখানকার বাসিন্দারা। রায়ের পরদিন মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষ স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন এই রায় অপরাধীদের জন্য মেসেজ হিসেবে থাকবে। রায়ের দ্রুত কার্যকরও দাবি করেন তারা। নিহতদের স্বজনদের দাবি শুধুই দ- কার্যকর। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণের তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে নারায়ণগঞ্জবাসী। তারা হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনে নামেন। গণমাধ্যম ও সারাদেশে ঘটনাটি আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। আলোচিত এই হত্যাকা-টির পর বাণিজ্য নগরী নারায়ণগঞ্জ পরিচিতি হয়ে ওঠে আতঙ্কের শহর হিসেবে। আর এই আলোচনার প্রধান কারণ হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র‌্যাবের সরাসরি সম্পৃক্ত থাকা। আলোচিত এ হত্যাকা-ের পর অবনতি ঘটে জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। মাত্র আড়াইবছরের মধ্যে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায়ে সোমবার ২৬ জনকে মৃত্যুদ- ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে দ- প্রদান করা হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভী জনকণ্ঠকে বলেন, সাত খুন মামলার এই যুগান্তকারী রায়ে নারায়ণগঞ্জবাসীর সঙ্গে আমিও আনন্দিত। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে এখনও যারা জনপ্রতিনিধির লেবাস লাগিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চায় তাদের এই রায় থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। সুন্দর এই রায়ের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে মেয়র বলেন, প্রতিটি মামলারই এমনভাবে বিচার হওয়া উচিত। তাহলেই আইনের শাসন রক্ষায় পাবে। সাত খুন মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর এস এম ওয়াজেদ আলী খোকন জনকণ্ঠকে বলেন, সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল আদালত। সব কিছুর পরেও মানুষ আশা করে আদালতে গেলেই তারা বিচার পাবেন। তবে এতদিন মানুষের এই আস্থা ছিল নড়বড়ে। কিন্তু এই সাত খুন মামলার রায়ের পর আদালতের ওপর মানুষের আস্থা আরও বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, এই রায়ের পর নারায়ণগঞ্জবাসী স্বস্তিতে আছে। এই হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের মধ্যে ২৫ জনই র‌্যাবের সদস্য। এদের মধ্যে সরকারের মন্ত্রীর জামাতাও রয়েছে। রায়ের আগে মানুষ ভেবেছিল, অপরাধীরা হয়তো পার পেয়ে যাবে। তবে আদালত তার রায়ের মাধ্যমে আবারও প্রমাণ করে দিয়েছে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবেই কাজ করছে। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আমরা যে কাজটি করতে পেরেছি, এটা অপরাধীদের জন্য একটি বড় মেসেজ যাবে, অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে। তিনি আরও বলেন, এতদিন সারাদেশের মানুষ নারায়ণগঞ্জকে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, এই রায়ের মাধ্যমে সারাদেশের সঙ্গে সারাবিশ্ব নারায়ণগঞ্জকে বিচার প্রাপ্তির জনপদ হিসেবেও চিনবে। এই মামলায় সর্বাত্মক সহযোগিতার জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, জেলা পুলিশ, র‌্যাবসহ সংশ্লিষ্ট সকলকেও ধন্যবাদ জানান পিপি। সাত খুন মামলায় নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের পরিবারের হয়ে এ মামলা লড়েন আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান। মঙ্গলবার তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, সাত খুন মামলার বিচারটা যেভাবে হয়েছে, তা নারায়ণগঞ্জের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন দিকে সুুদূরপ্রসারী ফলাফল বয়ে আনবে। সন্ত্রাসের নগরী হিসেবে পরিচিত নারায়ণগঞ্জের কলঙ্ক মোচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ রায়। তিনি বলেন, যে কোন অপরাধের বিচার পাওয়া ক্ষতিগ্রস্তের অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানেই নাগরিককে এই অধিকার দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে হত্যাকা-সহ বিভিন্ন কারণে নারায়ণগঞ্জ দেশব্যাপী আলোচনায় এসেছে। সাত খুনের ঘটনার পর থেকে নারায়ণগঞ্জের মানুষ প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছিল। নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে আইনী লড়াই চালানো হয়েছে। এই আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের মানুষের আশা পূরণ হয়েছে। এই আইনজীবী আরও বলেন, এই রায়ে দ-প্রাপ্ত ৩৫ জন আসামির মধ্যে ২৫ জনই র‌্যাবের সদস্য। এই রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে শৃঙ্খলবাহিনীর মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল কিছু সদস্য থাকে। এই রায়ের মাধ্যমে সেইসব উচ্ছৃঙ্খলদের প্রতি মেসেজ যাবে, অপরাধ করলে বিচার হবেই। তিনি আরও বলেন, সাত খুনের এই মামলাটিকে নজীর হিসেবে ধরে যদি প্রতিটি মামলাই এমনভাবে দ্রুত সমাপ্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা যায় তাহলে দেশ থেকে অপরাধপ্রবণতা অনেকটাই কমে যাবে বলেও মন্তব্য এই আইনজীবীর। নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক আবদুল হাই বলেন, ‘এ রায় আমাদের প্রত্যাশিত ছিল। একটি সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ায় আমরা সন্তুষ্ট। এতে আবারও প্রমাণ হলো আইনের উর্ধে কেউ নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছে আইনের উর্ধে কেউ নয়। এ বক্তব্য সবারই একমত। এটা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য এটি একটি মেসেজ। নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রায়ে প্রমাণিত হয়েছে গডফাদার থেকে শুরু করে বড় কর্মকর্তা যেই খুন করুক না কেন বিচারে তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হয়। নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ রায়ে খুশি। মানুষ আশা করে সর্বোচ্চ আদালতেও আসামিদের এই দ-াদেশ বহাল থাকবে। তবে নারায়ণগঞ্জের মানুষ এখন আশা করে চাঞ্চল্যকর ত্বকী, আশিক, ভুলু, চঞ্চল, হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচার এবং খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি ও মানবাধিকার কমিশনের নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি এ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, সন্ত্রাসী অপধারী যেই হোক না কেন, অপরাধ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে কেউ রেহাই পাবে না। সাত খুনের রায়ের মধ্য দিয়ে একটি মেসেজ নারায়ণগঞ্জবাসীর মাধ্যমে সারা বাংলাদেশের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হলাম। এখানে কোন গডফাদার, সন্ত্রাসী থাকবে না। তিনি বলেন, কেউ সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিবে, সন্ত্রাসী বানাবে, ক্যাডার বানাকে এবং অশান্তি জনপথ সৃষ্টি করবে। এটা হবে না। আগামী দিনে রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল হতে হবে সন্ত্রাসীদের যাতে দল ঠাঁই না দেয়। রায়টি অলম্বে কার্যকর করতে হবে। হাইকোর্টে যে প্রসেস আছে এই প্রসেসটা দ্রুত করতে হবে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর কাছে আহ্বান জানাই। কোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানাই দেরি না করে দ্রুত হাইকোর্টে রায়ের নথি প্রেরণ করা হোক। তাড়াতাড়ি মামলাটি আপীল হলে নিষ্পত্তি করে রায় কার্যকর করা হোক। নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আনিসুর রহমান দিপু বলেন, সাত খুনের যে রায় হয়েছে এতে আমরা খুশি। এখন অতি দ্রুত রায়টি কার্যকর হলেই আমরা স্বস্তি পাব। নগর খানপুরের বাসিন্দা নাজমূল বলেন, এ রায় যুগান্তকারী রায় হয়েছে। এ রায় কার্যকর হলেই নারায়ণগঞ্জ কলঙ্কমুক্ত হবে। সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজির বাসিন্দা মানবাধিকার কর্মী লুৎফর রহমান জানান, এ রায়ে আমরা খুবই খুশি। আমাদের আবেগের জায়গাটি হলো এতোগুলো নিরীহ লোক মেরে ফেলেছে। এটা মর্মান্তিক। আসামিরা বের হওয়ার চেষ্টা করেছে। এ রায় যেন সুপ্রীমকোর্ট পর্যন্ত বহাল থাকে। তবেই আমরা পুরোপুরি খুশি হতে পারব। স্বজনদের দাবি শুধুই কার্যকর ॥ সাত খুনে নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই মিজানুর রহমান রিপন বলেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ হলেও রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানান, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এটাতো নিম্ন আদালতের রায়। তারাতো উচ্চ আদালতেও যেতে পারে। যতদিন রায় কার্যকর না হবে ততদিন আমাদের নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা থেকে যাবে। নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের বাবা শহীদ চেয়ারম্যান জানান, রায়ে তিনি আংশিক খুশি। মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মামলার এজাহারে যাদের নাম দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম কেটে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। সাত খুনে নিহত তাজুল ইসলামের বাবা আবুল খায়ের বলেন, রায়ে আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি। রায়টা যাতে উচ্চ আদালতে বহাল থাকে এবং দ্রুত কার্যকর হয় সে দাবি জানাচ্ছি। নিহত তাজুল ইসলামের ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম রাজু বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন ৭ খুনের আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। প্রধানমন্ত্রী এখন বিদেশে সফরে আছেন। তিনি ফিরলে আমাদের তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিবেন এ প্রত্যাশা। নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ভাই মিজানুর রহমান রিপন বলেন, আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। আমরা চাই উচ্চ আদালতেও যাতে রায়টি বহাল থাকে এবং রায়টি দ্রুত কার্যকর হয়। নিহত গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমের ভাই শাহজাহান সাজু, নিহত গাড়িচালক ইব্রাহিমের স্ত্রী হনুফা বেগম ও বাবা আব্দুল ওহাব বলেন, রায়ে তারা সন্তুষ্ট। তারাও চান উচ্চ আদালতেও যাতে রায়টি বহাল থাকে এবং রায়টি দ্রুত কার্যকর হয়।
×