ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আলোকচিত্রে আগুন সন্ত্রাসের দিন

মানুষ পুড়িয়ে মারার নিষ্ঠুর রাজনীতি, কলঙ্কের ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭

মানুষ পুড়িয়ে মারার নিষ্ঠুর রাজনীতি, কলঙ্কের ইতিহাস

মোরসালিন মিজান ॥ শিল্পকলা একাডেমির দেয়ালজুড়ে ছবি। একটি দুটি নয়। শতাধিক। কিন্তু কোন ফ্রেমের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। ভেতরটা ধক্ করে উঠছিল। কান্নায় বুজে আসছিল কণ্ঠ। মানুষ হয়ে আরেক মানুষকে এভাবে পোড়াতে পারে কেউ? এই ভাইয়ের দেশে, মায়ের দেশে মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়? কবে থেকে হলো? ছবির দিকে তাকালেই এমন হাজারটা প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছিল। সকালে সন্তানের কপালে চুমু খেয়ে ঘর থেকে বের হওয়া বাবা দুপুরের আগেই কাঠকয়লা! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে কলেজে যাওয়া মেয়েটি নিজের মুখ দেখে চিনতে পারে না। চিৎকার করে কাঁদে। এইটুকুন বাচ্চা মায়ের কোল ছেড়ে ভর্তি হয় বার্ন ইউনিটে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ জানে না, তার কী অপরাধ। দেয়ালে সাজানো ছবিতে এমন অগণিত ট্র্যাজেডি। নির্মম সে সময়, হ্যাঁ, পার করে এসেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ক্ষত শুকোয়নি। রাজনীতির নামে আগুন সন্ত্রাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়টি মনে করিয়ে দিচ্ছিল প্রদর্শনী। ছবি দেখার প্রতিক্রিয়ায় প্রতিটি মানবিক মানুষ বলেছেন, এমন ছবি আর দেখতে চাই না। আর কোনদিন যেন এইদিন ফিরে না আসে। প্রায় সকলেরই জানা, ২০১৫ সালে হরতাল অবরোধ ডেকেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। রাজনৈতিক কর্মসূচী বটে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় অন্য রূপ। হরতাল অবরোধ কার্যকর করতে পেট্রোলবোমা ছুড়তে থাকে ২০ দলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা। চোখের সামনে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় মানুষ। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ছটফট করে। তবু থামে না আগুন সন্ত্রাস। সেই দুঃসহ দিনের কথা বলতেই গত সোমবার জাতীয় চিত্রশালায় আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দুই দিনব্যাপী আয়োজনের সমাপনী দিনে মঙ্গলবার গ্যালারি ঘুরে দেখা যায় ভয়ঙ্কর সেই অতীত। মানুষ হয়ে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কলঙ্কজনক ইতিহাস সামনে এসে দাঁড়ায়। ভীষণ লজ্জা দেয়। কেন এই বর্বরতা? গ্যালারির প্রবেশমুখেই উত্তরটি পাওয়া হয়ে যায়। এখানে শিল্পী প্রদ্যোত কুমার ভাস্কর্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন আগুনে পোড়া মানুষ। ব্যান্ডেজে ঢাকা শরীর। সবই মেঝেতে। আর উপরে ক্ষমতার চেয়ার। ইনস্টলেশন আর্টের ভাষায় শিল্পী বলার চেষ্টা করেন, ক্ষমতার জন্যই এত অন্যায় অপকর্ম। গদিতে বসা চাই। সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে আগুন দেয়া। একই বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে গ্যালারির ভেতরের অংশ। বিভিন্ন আলোকচিত্রীর তোলা ছবি দেখতে দেখতে অন্ধকার সময়টিকে দেখা হয়ে যায়। প্রতিটি দেয়ালে আলোকচিত্র। সেখানে আগুনে পোড়া মানুষ। বহু আলোকচিত্রে আগুনের দাউ দাউ। চলন্ত বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। বাস ডিপোতে আগুন। বিশাল ট্রেনের বগি জ্বলছে। জ্বলছে সিএনজি অটোরিকশা। সবখানে মানুষ। মানুষ পুড়ছে। দগ্ধ শরীর নিয়ে ছটফট করছে। প্রদর্শনীতে ঘুরে ফিরে আসে বার্ন ইউনিট। এখানে আহত মানুষের কান্না। আর্তচিৎকার। প্রতিটি ছবিতে পোড়া শরীর। কারও দুই হাত পুড়ে গেছে। কারও দুই পা। ঝলসে যাওয়া শরীর নিয়ে শুয়ে থাকা অনেকেই আর বেঁচে নেই। চিরতরে ছবি হয়ে গেছে! ভুল রাজনীতির আগুন কত ভয়ঙ্কর, কত বীভৎস হতে পারে তার সবচয়ে বড় প্রমাণ সোহাগ হাওলাদারের পোড়া শরীরটি। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। বাসের হেল্পার। না, তার প্রতিও দয়া হয় না। ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি বরিশাল-ঢাকা মহাসড়ে পেট্রোলবোমার আক্রমণে তাদের বাসে আগুন ধরে যায়। বাসের ভেতরেই পুড়ে মরে হেলপার ছেলেটি। তার পুড়ে যাওয়া দেহ কাঠামো এমনভাবে দৃশ্যমান যে, গা শিউরে ওঠে। ছবিটি একবার দেখা যায়। দ্বিতীয়বার সেদিকে তাকানোর সাহস হয় না। আগুন সন্ত্রাসের শিকার হন আরও অনেক বাস ও ট্রাক চালক। ড্রাইভার হেলপারের মতো খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে পুড়িয়ে মারা হয়। তেমন একটি ছবিতে দেখা যায়, সিলেট ওসামানী মেডিক্যাল কলেজের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে এক ট্রাকচালকের সহকারী। আহারে! মুখ হা করে একটু পানি খাওয়ার অবস্থা তার নেই। মুখের ওপর বোতল উপুর করে ধরা হয়েছে। সেভাবেই পান করতে হচ্ছে পানি। আগুন থেকে রেহাই পায়নি এমনকি শিশুরা। একটি ছবিতে ফুলের মতো ফুটফুটে শিশুর মুখ। মুখটিই দেখা যায় শুধু। সমস্ত শরীর ব্যান্ডেজ করা। মাত্র ৬ বছর বয়সী মেয়েটির নাম রূপা। মানুষের অধপতনের সাক্ষী যেন সে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ক্ষমা পায়নি। একই বছরের ১৮ জানুয়ারি মিরপুর থেকে বাসে উঠেছিলেন ইডেন কলেজের এক ছাত্রী। কলেজে আর পৌঁছা হয়নি তার। স্থান হয় বার্ন ইউনিটে। প্রদর্শনী মনে করিয়ে দেয়, বিএনপি-জামায়াতের দেয়া আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে এমনকি গবাদিপশুদের। একটি ছবিতে মুরগি ভর্তি খাঁচা। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত করতে আগুন দেয়া হয়েছে চালের ট্রাকে। পেঁয়াজ ভর্তি ভ্যানে। বিভিন্ন ছবিতে আক্রান্ত পুলিশ সদস্যদের চেহারা। রক্তাক্ত। এমন অসংখ্য ছবিতে আগুন সন্ত্রাসের খ-চিত্র। একত্রিত করলে বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির চেহারাটিও দেখা হয়ে যায়। রাজনীতিতে স্খলন ছিল। আছে। রাজনীতি খারাপ হয়। পথভ্রষ্ট হন নেতারা। কর্মীরা উশৃঙ্খল হন। পতনের এই ইতিহাস নতুন নয় বাংলাদেশে। তাই বলে যে মানুষের নামে রাজনীতি, সে মানুষকেই পুড়িয়ে মারতে হবে? এও সম্ভব? এতটা বর্বর কী করে হয় রাজনীতি? প্রদর্শনী এমন বহু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায় দর্শনার্থীদের।
×