আরাফাত মুন্না/মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার রায়ে নূর হোসেনের সঙ্গে তার ৯ সহযোগীও দ-িত হয়েছে। তবে মামলায় চার্জশিটভুক্ত না হওয়ায় এই মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া নূর হোসেনের অন্য সহযোগীরা এখনও বহাল তবিয়তে। মামলা থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সহযোগীরাই এখন নূর হোসেনের আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। রায়ের আগে এই সহযোগীরা জেলে থাকা নূর হোসেনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো বলেও অভিযোগ স্থানীয়দের।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, একসময় ১৫ থেকে ২০টি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করা নূর হোসেনের ছিল বৈধ-অবৈধ অস্ত্রের বিশাল ভা-ার। সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়, ট্রাক স্ট্যান্ড, সিদ্ধিরগঞ্জ হাউজিং, কাঁচপুরের বালুমহাল, মৌচাক, বিদ্যুতকেন্দ্র, আদমজী ইপিজেড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তার দাপট। এখন আর নূর হোসেনের কোনও দাপট না থাকলেও তার সম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে সহযোগীরা। নূর হোসেনের অবৈধ অস্ত্রও রয়েছে এসব সহযোগীদের হাতেই। সাত খুন মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, সাত খুনের আগে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার ট্রাক স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজিসহ মাদক ব্যবসা, জুয়া ও অশ্লীল নৃত্য পরিচালনা করতো নূর হোসেন। এই অবৈধ উপার্জন থেকে প্রায় ১০ লাখ টাকা বিভিন্ন সংস্থাকে উপঢৌকন হিসেবে দেয়া হতো। সাত খুন মামলার আসামিদের জবানবন্দী ও চার্জশিটে উঠে এসেছে এসব তথ্য। নূর হোসেনের যেসব অনুসারী এই সেক্টরগুলো নিয়ন্ত্রণ করত, তারা পুনরায় নিজ নিজ এলাকায় শক্ত অবস্থান গড়ে তুলছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, বিগত নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে এবং জেলা পরিষদ নির্বাচনে সদস্য পদে নূর হোসেনের কয়েকজন সহযোগী নির্বাচিতও হয়েছেন। সহযোগীদের কেউ কেউ দাপটের সঙ্গে এলাকায় অবস্থান এবং চাঁদাবাজিসহ অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে।
সোমবার ঘোষিত চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার রায়ে নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী প্রধান বডিগার্ড মর্তুজা জামান চার্চিল, প্রধান ক্যাশিয়ার আলী মোহাম্মদ, ক্যাশিয়ার সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহপ্রচার সম্পাদক আবুল বাশার, মাদক স্পট, জুয়া ও অশ্লীল নৃত্য পরিচালনাকারী রহম আলী ও মিজানুর রহমান দ-িত হয়েছে।
এর আগে মামলার শুনানির সময় চার্জশিটভুক্ত না হওয়ায় ছাড়া পেয়েছে ১০ সহযোগী। তারা হলো-বডিগার্ড মহিবুল্লাহ, তানভীর, ইয়াসিন, আলমগীর, গাড়িচালক সোনা মিয়া, জুয়েল আহম্মেদ, মিজান, আবদুর রহিম, আরিফুজ্জামান ও রফিকুল ইসলাম। এ ছাড়া এজাহারভুক্ত কিন্তু চার্জশিট থেকে অব্যাহতি পাওয়া আরও পাঁচজন হলো- সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী ইয়াসিন মিয়া, কাউন্সিলর ইকবাল, হাসমত আলী হাসু, থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক রাজু ও আনোয়ার। তারা সবাই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারলেও আছে বহাল তবিয়তে।
সূত্র জানায়, নূর হোসেনের শ্যালক নূরে আলম খান পুলিশের খাতায় সন্ত্রাসী। ২০১৫ সালে রাজধানীর মহাখালীতে নূর হোসেনের (লাইসেন্স বাতিলকৃত) পিস্তলসহ ধরা পড়ার পরও চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি পালিয়ে যান। গত ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনি সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এদিকে, নাসিক নির্বাচনে ২ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছিলেন নিহত সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। তিনি সাত খুন মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া আসামি ইকবাল হোসেনের কাছে হেরেছেন। ইকবাল থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা। ২০১৪ সালে নজরুলের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে কাউন্সিলর হয়েছিলেন বিউটি। ওই সময় নূর হোসেনের অনেক সহযোগী ছিল পলাতক। তবে এবার তারা এলাকায় বীরদর্পে কাজ করেছে ইকবালের পক্ষে এবং বিউটির বিরুদ্ধে।
৩ নম্বর ওয়ার্ডে এবারও জিতেছেন নূর হোসেনের ভাতিজা শাহজালাল বাদল। সাত খুনের পর তিনি দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এলাকায় ফিরে এলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে নূর হোসেনের ক্যাশিয়ার আরিফুল হক হাসান জিতেছেন। গত বছরের ২৮ এপ্রিল মদসহ আরিফুলকে র্যাব গ্রেফতার করেছিল। ৬ নম্বর ওয়ার্ডে থানা যুবলীগের আহ্বায়ক মতিউর রহমানও নির্বাচিত হয়েছেন। সাত খুনের পর তিনিও অনেক দিন পলাতক ছিলেন। নূর হোসেনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সাত খুনের ঘটনায় নজরুলের সঙ্গে নিহত স্বপনের ভাই মিজানুর রহমান খান রিপন সাত নম্বর ওয়ার্ডে নির্বাচন করে হেরেছেন। এখানে জিতেছেন নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠ আলী হোসেন আলা।
সূত্র মতে, নূর হোসেনের ভাই নুরুজ্জামান জজ এলাকায় ফিরেই কাঁচপুর সেতুর ঢালে ‘মেসার্স জেরিন ট্রেডার্স’ নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বালুর ব্যবসা শুরু করেন। শিমরাইল ট্রাক টার্মিনালটির নিয়ন্ত্রণ ছিল মনিরের ভাই ছোট নজরুলের হাতে। কাউন্সিলর আরিফুল ও কাউন্সিলর বাদল এখন ট্রাকস্ট্যান্ডটি নিয়ন্ত্রণ করছেন। নূর হোসেনের ভাতিজা আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু এলাকায় ফিরে লেগুনা ও টেম্পোস্ট্যান্ড দখলে নিয়েছেন। সেখানে ৩০০ লেগুনা থেকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। নূর হোসেনের ভগ্নিপতি রতন মোল্লা পরিবহন সেক্টরের দখল নিয়েছেন।
সাত খুন মামলার বাদী ও নিহত নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, ‘নূর হোসেন না থাকলেও তার লোকজন এলাকায় সক্রিয় আছে। শুনেছি রায়ের আগে সে জেলে বসে নাকি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত। তার লোকজন আমাকে নির্বাচনে হারিয়েছে। কিন্তু রায়ের পর এখন স্বস্তি পেয়েছে মানুষ। তাদের অপরাধের দুর্গ এবার ভাঙতে পারে বলেও মনে করছে লোকজন। ‘আমি শুধু ন্যায়বিচার পেতে চাইছি। কার কী দখল থাকল তা আমার দেখার বিষয় নয়’, বলেন বিউটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘নূর হোসেন যেখানেই থাক তার লোকজন এলাকায় আছে। অনেকে পরিবহনে চাঁদাবাজি, মাদক স্পট, জুয়ার আসরসহ অনেক কিছু করছে। তারা এখন ভয় পাবে। নূর হোসেন না ফিরতে পারলে তার রাজত্ব সবই শেষ হবে। আমরা ভাবছিলাম তার কিছু হবে না। এখন দেখি তার চেলারাও (সহযোগী) ধরা খাইছে!’
তিনি বলেন, তার যে সহযোগীরা জেলে ছিল তাদের শাস্তি হয়েছে। তবে যারা বাইরে আছে তারাতো আগের মতোই তাদের কাজ কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এলাকায় শান্তি ফিরবে বলে মনে হয় না। এই ব্যবসায়ী আরও বলেন, এখন রায় হয়েছে, কিছুদিন শান্ত থাকবে কয়েকটা দিন গেলে আবার সব একই রকম হয়ে যাবে।
বিপুল সম্পদের মালিক নূর হোসেন ॥ নূর হোসেনের সম্পত্তির খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, ঢাকার অভিজাত সব এলাকায় তার ফ্ল্যাট আছে, আছে জমি, বিশাল ব্যাংক ব্যালেন্স। রাজধানীর গুলশান-২ এ দু’টি ফ্ল্যাটেরও মালিক নূর হোসেন। বনানী ও ধানম-িতে আরও ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। অন্তত ৫০ বিঘা জমিরও মালিক সাত খুন মামলার প্রধান আসামি। এছাড়া শিমরাইলে ১১ শতাংশ জমির ওপর প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ তলা বাড়ি, ১০ শতাংশ জমির ওপর প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬ তলা বাড়ি, আরেকটি ৬ তলা ভবন, রসুলবাগে সাড়ে ৮ কাঠা জমির ওপর ৭তলা ভবনসহ ৫টি বিলাসবহুল বাড়ি ও ৪টি ফ্ল্যাটের মালিক সে। শিমরাইলের টেকপাড়ার বাড়ির পেছনে প্রায় ৪০ বিঘা জায়গা জুড়ে মৎস্য খামারও আছে তার।
১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক ছিল নূর হোসেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ায় তার পরিচয় হয় হোসেন চেয়ারম্যান। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পরই গা-ঢাকা দেয় সে। শুধু বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়াই নয়, সম্পত্তি লুকিয়ে আয়কর ফাঁকি দিতেও সে ছিল সিদ্ধহস্ত।
দুদকের অনুসন্ধানে নূর হোসেনের মোট ৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে পাঁচতলা একটি বাড়ি এবং নূর হোসেন ও তার সন্তানদের নামে এবিএস পরিবহনের ৩০টি বিলাসবহুল বাসের কথা জানা গেছে। একসময় বাসগুলো নারায়ণগঞ্জ-সিমরাইল রুটে চলাচল করলেও এখন বন্ধ রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধানে ওই সব সম্পদের বৈধ কোনও উৎস পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, নূর হোসেনের আয়কর ফাইল অনুসারে তার মোট আয় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। যেখানে আয়ের উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে বিভিন্ন জলাশয়ে মাছ চাষ। তবে আয়কর ফাইলে কোথাও তার বাড়ি কিংবা বাসের কথা উল্লেখ নেই।