ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৫ মার্চ ২০২৪, ৩১ ফাল্গুন ১৪৩০

সপ্তম শ্রেণীর বইয়ে ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ কবিতা থেকে লাইনটি বাদ দেয়া হয়

‘মন্দির’ শব্দ থাকায় গত বছর রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন বাদ যায়

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭

‘মন্দির’ শব্দ থাকায় গত বছর রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন বাদ যায়

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ‘তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতার এ লাইনটিতে ‘মন্দির’ শব্দ আছে বলে গত বছর অবিশ্বাস্যভাবে এ লাইন বাদ দিয়েই স্কুলের পাঠ্যবইয়ে কবিতাটি পড়ানো হয়েছিল! ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ নামের এ কবিতা বিকৃত করে ছাপা হওয়ার পর সমালোচনার মুখে তদন্ত হলে ঘটনার প্রমাণও মেলে। কিন্তু সেই তদন্ত রিপোর্ট অনুসারে নেয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা। রিপোর্ট দেখেনি আলোর মুখ। বরং উল্টো এবার জামায়াত মদদপুষ্ট মৌলবাদী গোষ্ঠী হেফাজতের চাওয়া অনুসারে রবি ঠাকুরের পুরো কবিতায়ই বাদ দেয়া হচ্ছে বই থেকে। রবি ঠাকুর হিন্দু ও কবিতায় মন্দিরের কথা বলা আছে তাই বাদ দিতে হবে। মৌলবাদীদের এমন আব্দারই এবার পূরণ করা হয়েছে। গেল বছরের পাঠ্যবই নিয়ে সরকারের করা তদন্ত রিপোর্ট একটি মহল এতদিন ধামাচাপা দিয়েই রেখেছিল। শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একটি মৌলবাদী চক্র গত বছরের তদন্ত ধামাচাপা দিয়ে রক্ষা করেছিল বিকৃতি ও ভুলের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের। দায়ী প্রায় প্রতিটি কর্মকর্তাই এখনও বহাল আছেন এনসিটিবিতে। কেউ কেউ আরও বড় পদেও পদোন্নতি পেয়েছেন। তদন্তে এনসিটিবি ও দুই মন্ত্রণালয়ের বাইরে যে লেখকদের কথা উঠে আসে তারা প্রায় সকলেই বলেছেন, বই লেখার পরে কর্মকর্তারাই এসব বিকৃতি করেছেন। তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই না জানিয়ে এসব করা হয়েছিল। তদন্ত রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল শিশুদের বইয়ে ভুল ও বিকৃতি আছে। কোথায় কোথায় ভুল আছে এবং এর জন্য কারা দায়ী তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছিল তদন্ত রিপোর্টে। মঙ্গলবার তদন্ত রিপোর্টের একটি কপি জনকণ্ঠের হাতে আসে। রিপোর্টে দেখা যায়, কেবল রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশের হৃদয় কবিতাই নয়। এমন অনেক বিখ্যাত কবিতার লাইন বিকৃত করে পড়ানো হয়েছে কেবল সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণে। ভুলগুলো তদন্তে ধরা হলেও এবার ভুল সংশোধন করে বই না ছাপিয়ে মৌলবাদীদের কথায় প্রতিটি কবিতাই বাদ দেয়া হয়েছে বই থেকে। এভাবে এবার ভুল সংশোধন ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো লেখা ও কবিতাই বাদ দেয়া হয়েছে। নামকাওয়াস্তে ছোটখাটো কিছু ভুল ঠিক করা হলেও তদন্ত রিপোর্ট ধামাচাপা দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে দায়ী প্রতিটি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞকে। কিন্তু এমন কেন হলো? এ প্রশ্নে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জনকণ্ঠকে বলেছেন, ‘দেখেন এ ঘটনা যখন হয়েছে কিংবা যখন তদন্ত হয়েছে তখন আমি এ পদে আসিনি। মানে আমি তখন দায়িত্বে ছিলাম না। যারা করেছেন তারা বলতে পারবেন। তবে বিষয়টি যেহেতু মন্ত্রণালয়ে জমা হয়েছিল, দেখতে হবে তারা কোন ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা। মন্ত্রণালয়ে কথা বলে পরবর্তীতে এ বিষয়ে মন্তব্য করবেন বলে জানান চেয়ারম্যান। গত বছরের বই ও কারিকুলামের ভুলের জন্য যাদের কথা বলা হয় তাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন প্রধান সম্পাদক ও বর্তমানের কারিকুলাম সদস্য (প্রাথমিক) সরকার আবদুল মান্নান। এবারের কারিকুলামের সঙ্কটের জন্যও অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। আগের রিপোর্ট সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এসব বিষয়ে এখন কোন কথা বলতে রাজি হননি। বলেন, এবারের বই নিয়ে তদন্ত চলছে। এখন কোন কথা বলা যাবে না। ওই তদন্ত সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। ছয় পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাঠ্যবইয়ে দেখা গেছে বেশ কিছু মারাত্মক তথ্য বিভ্রাট। যেখানে পঞ্চম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং সপ্তম শ্রেণীর বাংলা বই সপ্তবর্ণার ভুলগুলো এবং এর জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এ বছরের বইতে নামকাওয়াস্তে কিছু ভুল সংশোধন করা হলেও দোষীদের বিষয়ে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে শাস্তি না হওয়ায়ই বছর বছর নতুন নতুন ভুল আরও বাড়ছে বলে বলছেন শিক্ষাবিদরা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইতে ‘ও’ তে ‘ওড়না চাই’ ২০১৩ সাল থেকেই রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর হিন্দু ধর্ম বইয়ের শেষ কভারে এবার কাউকে কষ্ট দিও না-র ইংরেজি লেখা হয়েছে, উঙ ঘঙঞ ঐঊঅজঞ অঘণইঙউণ. যদিও ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই ভুলেই কভার ছাপা হয়েছে। তবে গত বছর হার্ট বানান সংশোধিত হয়ে ছাপা হয়। এবার আবারও সেই আগের ভুল। প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইয়ে ছবি দিয়ে দেখানো হয়েছে ছাগল গাছে উঠে আম খায়। তবে ছাগলের বদলে দুষ্প্রাপ্য শব্দ ‘অজ’ ব্যবহার করা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর বাংলা বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতায় ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’ এর বদলে এবার লেখা হয়েছে ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে’। অথচ গত বছরের বইতে এটা ঠিকই ছিল। পঞ্চম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং সপ্তম শ্রেণীর বাংলা বই সপ্তবর্ণার ভুলগুলো চিহ্নিত করে এবং এর জন্য দায়ীদের নাম উল্লেখ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয় এনসিটিবি। সেখানে পঞ্চম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ১৯ পৃষ্ঠায় বাহাদুর শাহ পার্কের নির্মাণ সময় ১৯৫৭ এর বদলে ১৯৪৭ লেখা হয়। এছাড়াও লেখা হয় ‘১৯ শতকে এই পার্কের নাম পরিবর্তন করে ভিক্টোরিয়া পার্ক রাখা হয়’। সঠিক তথ্য হবে ‘বিশ শতকে’। তবে এবারের বইতেও সেই ভুল সংশোধন হয়নি। এবারও ১৯ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘১৯ শতকে এই পার্কের নাম ভিক্টোরিয়া পার্ক রাখা হয় কেন?’ এছাড়া আরও কিছু ভুল চিহ্নিত করলে তা সংশোধন করা হয়। তবে এবার আবার নতুন কিছু ভুল করা হয়। গত বছরের সপ্তম শ্রেণীর সপ্তবর্ণা (বাংলা) বইতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলাদেশের হƒদয় কবিতায় সপ্তম লাইনের পর এক লাইন বাদ দেয়া হয়েছিল কারণ সেখানে ‘মন্দির’ লেখা ছিল। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বভারতী গ্রন্থ বিভাগ থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা সমগ্রতে কবিতাটি ছিল ২২ লাইনে। কিন্তু পাঠ্যবইয়ে ছাপা হয়েছে ২১ লাইন। এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, গত বছর যখন এটা করা হয় তখনও মৌলবাদী গোষ্ঠী এনসিটিবিতে এসে হুমকি দিয়েছিল যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বাদ দিতে হবে। পরে তাদের সঙ্গে মিলে একটি চক্র একটি লাইন বাদ দেয়। এবার তার চেয়েও বেশি করা হয়েছে। কারণ, এবার পুরো কবিতাই বই থেকে তুলে দেয়া হয়েছে। কবি সুকুমার রায়ের আনন্দ কবিতার লাইগুলো সঠিকভাবে সাজানো হয়নি। কবি কালিদাস রায়ের ‘অপূর্ব প্রতিশোধ’ কবিতার তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন বাদ দেয়া হয়েছে। এসব ভুল সংশোধনের জন্য তদন্তে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে এবারের বইতে এই ভুল সংশোধন না করেই তিনটি কবিতাই বাদ দেয়া হয়েছে। গত বছরের বইতে ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন’ লেখা হয়েছিল। সঠিক তথ্য হবে ‘১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি’। তবে এবারের বইতে এই অংশই খুঁজে পাওয়া যায়নি। তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, পঞ্চম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের রচনা ও সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ড. মাহবুবা নাসরীন, ড. আব্দুল মালেক, ড. ইশানী চক্রবর্তী ও ড. সেলিনা আক্তার। আর পরিমার্জনের দায়িত্বে ছিলেন এনসিটিবির উর্ধতন বিশেষজ্ঞ লানা হুমায়রা খান, বিশেষজ্ঞ মোঃ মোসলেহ উদ্দিন সরকার, মোঃ মোস্তফা সাইফুল আলম। পরিমার্জনকারী ও বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন মোঃ আবু সালেক খান। সপ্তম শ্রেণীর সপ্তবর্ণা বইতে রচয়িতার তালিকায় ছিলেন অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারি, ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ ও শামীম জাহান আহ্সান। সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক ড. রফিকউল্লাহ খান ও এনসিটিবির বর্তমান সদস্য ড. সরকার আবদুল মান্নান। ড. সৌমিত্র শেখর ছিলেন ও সম্পাদক ও পরিমার্জনকারী হিসেবে। সম্পাদক ছিলেন ড. শোয়াইব জিবরান। পরিমার্জনকারী হিসেবে ছিলেন মোরসেদ শফিউল হাসান, অধ্যাপক শ্যামলী আকবর ও মোঃ মামুনুর রশিদ। আর পরিমর্জনকারী ও বিষয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে ছিলেন এনসিটিবির গবেষণা কর্মকর্তা সৈয়দ মইনুল হাসান। তদন্ত প্রতিবেদনের সার্বিক মন্তব্যে লেখা হয়, পঞ্চম শ্রেণীর বাহাদুর পার্কের নির্মাণকাল ও শতাব্দী ভুলসহ অন্যান্য ভুলের জন্য লেখক, সম্পাদক, বিষয় বিশেষজ্ঞ ও পরিমার্জনকারীগণ কোনভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। সপ্তম শ্রেণীর সপ্তবর্ণা বইয়ের কবিতার পদবিন্যাসে অসংগতির জন্য লেখক ও সম্পাদনা পরিষদ দায়ী। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই বইটির বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পালন করা এনসিটিবির কর্মকর্তা মোঃ হান্নান মিয়া ও সৈয়দ মইনুল হাসান কবিতার ত্রুটি চিহ্নিত ও সংশোধন করতে ব্যর্থ হয়েছে বিধায় তারাও এ ত্রুটির জন্য দায়ী। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস সম্পর্কিত ভুল তথ্য বইতে সন্নিবেশ করায় এনসিটিবির গবেষণা কর্মকর্তা সৈয়দ মইনুল হাসান তার কর্তব্য কাজে অবহেলাসহ চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয় তদন্ত রিপোর্টে। সপ্তম শ্রেণীর সপ্তবর্ণা এবং পঞ্চম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বই দুটিতে ভুল তথ্য দেয়ার জন্য এর লেখক, সম্পাদক, বিষয় বিশেষজ্ঞ ও পরিমার্জনকারীগণের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থায় গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল এনসিটিবিতে ॥ এবারের পাঠ্যবই কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত টিম মঙ্গলবার দিনভর এনসিটিবিতে কাজ করেছে। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রুহী রহমানের নেতৃত্বে কমিটিতে আছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মাহমুদুল ইসলাম, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নেছার আহমেদ ও মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) মোঃ এলিয়াস হোসেইন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা এবারের বইয়ে যেসব ভুল সামনে এসেছে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেন। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে সাক্ষ্য নেয়া হয় তাদের।
×