ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনিয়ম, দুর্নীতি ও দায়িত্বহীনতা

১৯ বছরে পাবনা চিনি মিলের লোকসান ৩০২ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭

১৯ বছরে পাবনা চিনি মিলের লোকসান ৩০২ কোটি টাকা

তৌহিদ আক্তার পান্না, ঈশ্বরদী ॥ গত ১৯ বছরে পাবনা চিনি মিলে পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০২ কোটি টাকা। ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রয়োজনীয় আখ না পাওয়া, আখ চাষের উপযোগী জমিতে ফলমূল ও সবজি চাষ করা এবং শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে এ লোকসান হয়েছে। মিলের শ্রমিক কর্মচারী, কৃষক, এলাকাবাসী ও মিলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রের দেয়া অভিযোগে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্রমতে, ১৯৯৭-৯৮ মাড়াই মৌসুমে পাবনা চিনি মিলে প্রথম আখ মাড়াই শুরু হয়। মাড়াই শুরুর পর থেকেই কতিপয় সিবিএ নেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার যোগসাজশে শুরু করা হয় নানা প্রকার অনিয়ম দুর্নীতি। অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত নানা খাতে বিল ভাউচার করে অতিরিক্ত বিল তোলা, আখ ওজনের ওয়ে ব্রিজে ঘাপলা করে মিলকে ও কৃষককে ফাঁকি দেয়া, আখ বহনকারী ট্রাক্টরের অতিরিক্ত তেলের ভাউচার করে বিল তোলাসহ নানাভাবে মিলের চাকা লোকসানের দিকে ঠেলে দেয়া হয়। প্রয়োজনমতো আখ চাষীদের আখচাষে উৎসাহিত করা হয়নি। আখের মূল্য কম দিয়ে কৃষকদের আখ চাষে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটি আখক্রয় কেন্দ্রে ওজনে ঘাপলা করে মিল ও চাষীদের ঠকানো হয়েছে। অনেক কর্মচারী ডিউটি না করে খাতা স্বাক্ষর করে বেতনসহ নানাবিধ সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। প্রকৌশলী শাখায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উর্ধতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বিভিন্ন উন্নয়মূলক কাজে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সিস্টেম করে টেন্ডার ছাড়াই কাজ করানো হয়েছে। একইভাবে গ্যারেজ ইঞ্জিনিয়ারের যোগসাজশে তেল কেনা থেকে শুরু করে নানা প্রকার যন্ত্র পাতি ক্রয়ে অতিরিক্ত মূল্যের ভাউচার দাখিল করে মোটা অংকের টাকা আত্মসাত করেছেন। এমনিভাবে মিলের মুলাসেস ও উন্নয়নমূলক কাজের ক্ষেত্রেও নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হয়েছে। পুর্জি নিয়েও কৃষকদের সাথে বেইমানি করে সিন্ডিকেডের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। আখ চাষীদের সুযোগ সুবিধা না দেওয়া ও আখ চাষে সঠিকভাবে উৎসাহিত করতে না পারায় মিল কোন মৌসুমেই প্রয়োজনীয় আখ সংগ্রহ করতে পারেনি। এতে উৎপাদনে মার খেয়েছে মিল কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও নগরায়নও অন্যতম কারণ। উন্নতজাতের আখ উদ্ভাবন না করতে পারায় চাষীরা ক্ষগ্রিস্ত হয়েছে। একইভাবে মিলের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সুবিধা না পেয়ে চাষীরা আখের পরিবর্তে বিভিন্ন প্রকার সবজি ও ফল চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। এটাও মিলের লোকসানের একটি কারণ। নিচু জমিতে আখ চাষ করায় মিলের চিনি আহরণের হার ক্রমেই কমে যাচ্ছে। গত ১৫-১৬ মাড়াই মৌসুমে চিনি আহরণের হার ছিল শতকরা ৫ দশমিক ৯৩। চলতি ১৬-১৭ মাড়াই মৌসুমে চিনি আহরণের হার শতকরা ৫ দশমিক ৩৫ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মিলকে সচল রাখতে হলে কমপক্ষে চিনি আহরণের হার শতকরা ৮ এর অধিক হওয়া দরকার। এসব কারণে মিল কর্তৃপক্ষ লাভের মুখ দেখেনি। ফলে অদ্যাবধি মিলের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০২ কোটি টাকা। ১৯ বছরে মিল মোটা অঙ্কের টাকা লোকসান দিলেও মিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকেই আলিশান বাড়ি গাড়ির মালিক বনে গেছেন। অনেকেই মোটা অঙ্কের টাকা ব্যাংক ব্যালান্স করেছেন। দুর্নীতিমুক্ত সৎ ও দায়িত্বশীল এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দিয়ে তদন্ত করলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। পাবনা চিনি মিলের বর্তমান এমডি তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী জানান, মিলকে বিশাল পরিমাণ লোকসানের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আখের উন্নত জাত প্রয়োজন। আখের মূল্য বাড়ানো দরকার। বহুমুখী উৎপাদন কৌশল এবং নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজন। মিলে রিফাইন সুগার দিয়ে জুস তৈরির কারখানা করা দরকার। বোতলজাত পানি উৎপাদন করা যেতে পারে। কো-জেনারেশনের মাধ্যমে বিদ্যুত উৎপাদন করতে হবে। বায়ো ফার্টিলাইজার ও বায়োগ্যাস প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। পাল্প ও মিনি পেপার মিল এবং ডিস্টিলারি ফ্যাক্টরি করা যেতে পারে। আখের দাম অবশ্যই কুইন্টাল প্রতি ৩৭৫ টাকা থেকে ৪শ’ টাকা করা দরকার। ভিন্ন একটি সূত্রমতে, দেশের মোট চিনির চাহিদা ১৬ লাখ মে. টন। দেশের সব মিলের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার মে. টন। অবশিষ্ট ১৪ লাখ মে. টন চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এই বিশাল পরিমাণ চিনির ঘাটতি পূরণের অজুহাতে একটি সুবিধাবাদী চক্র বিদেশ থেকে র-সুগার আমদানি করে মিলগুলোর মারাত্মক ক্ষতি করেছে। তবে শিল্পমন্ত্রী ও বিএফএসআইসির বর্তমান চেয়ারম্যানের বিশেষ কৌশলের কারণে সব মিলে রক্ষিত অবিক্রীত চিনি বিক্রি করা সম্ভব হয়েছে। এ কারণে মিলগুলোও অনেকটা রক্ষা পেয়েছে।
×