ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের কোটি টাকা গচ্চা

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭

সরকারের কোটি টাকা গচ্চা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহারের মাধ্যমে মুজিব নগর কর্মচারী হিসেবে চাকরি নেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর কমিশনার ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম। অবৈধভাবে সরকারী পদে থাকার মাধ্যমে দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন তিনি। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হয় সরকারের। তার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের তদন্ত প্রতিবেদনেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও অবৈধ সরকারী সুবিধা গ্রহণের অভিযোগ সত্যতা পাওয়া যায়। এছাড়া চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠে এনবিআরের সাবেক ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এছাড়া তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময়ে ২০০৩ সালে দলটির অঙ্গসংগঠন জিয়া সাংস্কৃতিক সংগঠন (জিসাস) ও ২০০৪ সালে জাতীয় যুব সাংস্কৃতিক সংস্থা (যুসাস) কর্তৃক স্বর্ণপদকে ভূষিত হন এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম। এসব অভিযোগে বিভিন্ন নথিপত্র রয়েছে জনকণ্ঠের কাছে। বর্তমান সরকারের আমলে নিজেকে ‘কর গবেষক’ হিসেবে বিভিন্ন মহলে পরিচয় দিয়ে তদবির বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। জাহাঙ্গীর আলমের নির্দেশে বিভিন্ন সময়ে কর্মকর্তার নামে-বেনামে ভুয়া, মিথ্যা, ভিত্তিহীন চিঠি দেয়ায় সম্প্রতি বরখাস্ত হন এনবিআর কর অঞ্চল-৮ এর সাঁটলিপিকার বাবর আলী। বিভিন্ন নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাবেক কর কমিশনার (কর আপীল অঞ্চল-৪, ঢাকা) ড. এসএম জাহাঙ্গীর আলম জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করে তা দিয়ে চাকরি জীবনে সুবিধা ভোগ করছেন। মুজিব নগর সরকারের একজন কর্মচারী হিসেবে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন তিনি। জাহাঙ্গীর আলম প্রথমে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের কর বিভাগে অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান। পরে ১৯৯১ সালের ২ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা কোটা কাজে লাগিয়ে সরাসরি সহকারী কর-কমিশনার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। পরে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে তার বিরুদ্ধে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ গ্রহণের অভিযোগ আসলে তা আমলে নিয়ে ২০০২ সালের ১ জুলাই কুমিল্লা জেলা প্রশাসক বরাবর অনুসন্ধানের জন্য চিঠিও পাঠানো হয়। কিন্তু সেই অনুসন্ধান আর হয়নি। এস এম জাহাঙ্গীর আলমের এসএসসি সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ১৯৫৫ সালের ১০ জুলাই। মুজিব নগর সরকারের সময় তার বয়স ছিল ১৬ বছরেরও কম। সে সময়েও চাকরিতে যোগদানের সর্বনিম্ন বয়স ছিল ১৮ বছর। সেই হিসেবে ওই বয়সে মুজিব নগর সরকারের আমলে তার চাকরি হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এছাড়া মুজিব নগর সরকারের যে ৫০৯ জনের কর্মচারী তালিকা আছে সেখানেও তার নাম নেই। অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর সুবাধে বিভিন্ন সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে প্রথমে তিনি মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের সাধারণ সম্পাদক হন। পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান, এরপর তিনি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় ৪৭ লাখ ৬৮ হাজার ১৬৮ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পায় তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো। পরে এ অভিযোগে ২০০২ সালের ২০ আগস্ট দুর্নীতি দমন ব্যুরো বাদী একটি মামলাও দায়ের করে। ২০০৩ সালে হাইকোর্ট ওই মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে। বর্তমানে এ মামলার কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি, তারপর তদবিরের বিনিময়ে পদোন্নতি পেয়ে কমিশনার! এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, এভাবে অনৈতিকভাবে চাকরি নেয়ার পরও শাস্তি না হলে অন্য কর্মকর্তারা ভবিষ্যতে অনিয়ম করার সাহস পাবেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের এক প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীর আলম সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি জালিয়াতির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট গ্রহণ করেছেন। মুজিবনগর কর্মকর্তা ও কর্মচারীর তালিকায় থাকায় ৫০৯ জন কর্মকর্তার মধ্যে জাহাঙ্গীর আলমের নাম নেই। ওই তালিকায় নাম না থাকা সত্ত্বেও তিনি মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে চাকরি নেন। পরবর্তী সময়ে তদবির বাণিজ্য চালিয়ে পদোন্নতি নেন সাবেক কর কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম। বিভিন্ন সার্কেলে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে ২৭টি অভিযোগ তুলে ধরেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সাবেক সচিব খায়রুজ্জামান চৌধুরী। এসব অভিযোগনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জাহাঙ্গীর আলম বিভিন্ন ব্যক্তিকে কর ফাঁকির সুযোগ করে দিয়ে আর্থিক সুবিধা নিতেন। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে বলে খায়রুজ্জামান চৌধুরী অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে এস এম জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, দুর্নীতি, হয়রানি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ গ্রহণ করেছে এনবিআর। এ নীতির আলোকে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধেই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা গেছে, নিজেকে বর্তমানে সরকারের অন্যতম কর গবেষক পরিচয় দিলেও জাহাঙ্গীর আলম ২০০৩ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সম্মাননা (জিয়া স্বর্ণ পদক) মনোনীত হন। তৎকালীন বিএনপি সরকারের অঙ্গ সংগঠন জিয়া সাংস্কৃতিক সংগঠন (জিসাস) কর্তৃক স্বর্ণ পদক গ্রহণ করেন জাহাঙ্গীর আলম। পরের বছর জাতীয় যুব সাংস্কৃতিক সংস্থা (যুসাস) কর্তৃক স্বর্ণ পদকে ভূষিত হন রাজস্ব বোর্ডের তৎকালীন উপ-কর কমিশনারের দায়িত্বে থাকা এসএম জাহাঙ্গীর আলম। জাহাঙ্গীর আলম কর আপীল অঞ্চল-৪ এর কমিশনার থাকা কালীন সময়ে নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন কর্মকর্তার নামে-বেনামে ভুয়া, মিথ্যা, ভিত্তিহীন চিঠি দেয়ায় সম্প্রতি বরখাস্ত হন এনবিআর কর অঞ্চল-৮ এর সাঁটলিপিকার বাবর আলী। কর অঞ্চল-৮ এর কর্মকর্তারা জানান, সাঁটলিপিকার বাবর আলী সাবেক কর কমিশনার জাহাঙ্গীর আলমের নির্দেশে এনবিআরের বিভিন্ন কর্মকর্তার নামে দুদকসহ বিভিন্ন দফতরে তার ব্যবহৃত কম্পিউটার থেকে নামে-বেনামে ভুয়া, মিথ্যা, ভিত্তিহীন চিঠি দিয়েছেন। যার ফলে সম্প্রতি বাবর আলীর ব্যবহৃত কম্পিউটার জব্দ এবং তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তারা বলেন, এ দায়ভার শুধু বাবর আলীর কেন, এজন্য সাবেক কর কমিশনার জাহাঙ্গীর আলমেরও শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।
×