ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাঠ্যবইয়ের হেজাবিকরণ

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭

পাঠ্যবইয়ের হেজাবিকরণ

নরেন্দ্র মোদির আমলে ভারতের কি উন্নতি হয়েছে? এই প্রশ্ন শুধু বিজেপিকে করতে হবে। কারণ, তারা প্রবলভাবে ক্ষমতায় এসেছে। তারা যা যা বলছে তা তা করছে। আমি অবাক হবো না, যদি ভারতের সব রাজ্যে আমিষ বন্ধ করে দেয়া হয়। কারণ গরু আমিষভোজী নয়। অন্য ধর্মাবলম্বীদের দেশ ছাড়তে না হলেও প্রকাশ্যে তাদের ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ হবে। পাঠ্যবই আবারও বদল হবে। এমনকি সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি আছে তাও বাদ যেতে পারে। বিজেপিবিরোধী দলগুলোকেও হিন্দুত্ববাদের কথা বলতে হবে। এবং কপালে চন্দন সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে দিন শুরু করতে হবে। বিজেপি নেতা ও মন্ত্রী অনিল বিজ বলেছেন, ‘মহাত্মা গান্ধীর চেয়ে নরেন্দ্র মোদি অনেক বড় ব্র্যান্ড।’ গান্ধীজীর কথা বলে খাদি বিক্রি বাড়ানো যায়নি। মোদির কথা বলার পর খাদি বিক্রি বেড়েছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান কেভিআইসি তাদের ক্যালেন্ডারে গান্ধীর চরকা কাটা ছবির বদলে মোদির চরকা কাটা ছবি ছেপেছে। মন্ত্রী আরও দাবি করেছেন, নোটে গান্ধীর বদলে মোদির ছবি ছাপানোর। অনেকে হয়ত অবাক হবেন এ ধরনের বক্তব্যে বা কর্মকা-ে। ভারতে শক্তিশালী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী একটি সিভিল সমাজ থাকার পরও তারা এ স্রোত বাধা দিতে পারছে না। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত একজন বললেন, পশ্চিমবঙ্গেও একই বিষয়। আপনাদের এখানে তো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বললেও জেলে যেতে হবে না বা হাঙ্গামা পোহাতে হবে না [বক্তব্যটি সঠিক]। পশ্চিমবঙ্গে বলে দেখুন, তারপর বুঝবেন কত ধানে কত চাল। ক্ষমতার বিরোধী হওয়ায় দৈনিক স্টেটসম্যান থেকে মানস ঘোষকে বিদায় নিতে হয়েছে। আনন্দবাজারের মতো পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক অভীক সরকারকেও বিদায় নিতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের মিশনের একজন কর্মকর্তা বলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাতকার পাওয়া যায় কিন্তু অভীক সরকারের এমনই দম্ভ যে, তার সঙ্গে দেখা করা যায় না। সেই অভীক সরকারকেও যেতে হয়েছে। শেখ হাসিনা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পছন্দ করেন না। কিন্তু সম্পাদকদের কোথাও যেতে হয়নি। তারা তাদের মতো পত্রিকা চালাচ্ছেন। শুধু শেখ হাসিনার অনুষ্ঠানে তাদের যেতে দেয়া হয় না। এটি অবশ্য যৌক্তিক নয়। অন্তত শেখ হাসিনা যে পর্যায়ে গেছেন সে পর্যায়ে এগুলো তুচ্ছ বিষয়। তাছাড়া আওয়ামী লীগারদের প্রিয় পত্রিকা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার। তাহলে প্রথমে এই আওয়ামী লীগারদের গণভবনে আসা বন্ধ করতে হবে। যাক, প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু যেতে হয়েছে। আরেকটু বলি, মার্কিন হবু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কথা। তিনি আরও কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করে মার্কিনীদের মন জয় করেছেন। নারীদের বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের কারণে অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ নারী তাকে ভোট দিয়েছে। তাদের বলে দোষ কী। খালেদার আমলে, রোকেয়া হলের মেয়েদের বেধড়ক নাজেহাল করেছিল, অশ্লীল গালিগালাজ করেছিল ছাত্রদলের যুবকরা। হল নির্বাচনে প্রবলভাবে ছাত্রদল জিতেছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মনোবিকারে সবাই ভোগে। বেশি ভোগে ক্ষমতায় থাকলে। তখন মাথা ঝিমঝিম রোগে আক্রান্ত হয় সবাই। নিজেকে সবচেয়ে জ্ঞানী সবচেয়ে বিজ্ঞ মনে হয়। সমালোচনাকে মনে হয় বিরোধিতা। যে সমালোচনা লেখে তার হাত কেটে দিতে ইচ্ছে হয়। যে বলে তার জিহ্বা ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এ পটভূমি দিতে হলো আমাদের পাঠ্যবই ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে। ॥ দুই ॥ পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্কের রেশ এখনও মিলিয়ে যায়নি, যাবেও না। এ বিতর্ক দেখে মনে হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যেন প্রথম এ ধরনের একটি কাজ করল। আদৌ তা নয়। প্রায় প্রতিবছরই পাঠ্যবই নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু, কিছু কি বদলেছে? বদলায়নি, বদলাবেও না। কেন বদলাবে না তার পটভূমি আগেই দিয়েছি। পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন শুধু প্রাথমিক পর্যায়ের বইগুলো নিয়ে। তাও বাংলা বই নিয়ে। যারা প্রতিবেদক, তারা বাংলা বই নিয়ে আগ্রহী। কারণ, তার সমালোচনা সহজ। এবং বাংলা বইয়ে যে কটি ভুল তারা পেয়েছেন তাই বার বার উল্লেখ করছেন। কিন্তু, তারা জানেন না, প্রতিটি পর্যায়ে পাঠ্যবইয়ে শুধু ভুল নয়, বিশেষ একটি আদর্শ প্রচার করা হচ্ছে। সেটি হচ্ছে হেজাবি আদর্শ [হেফাজত+জামায়াত+বিএনপি]। এবং জেনেশুনে বুঝেই তা করা হচ্ছে। পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকতেই পারে। সেটি নিয়ে সমালোচনা হতে পারে। এবং কর্তৃপক্ষ সেই ভুল শুধরে সবাইকে জানিয়েও দিতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বানান ভুলই না, মূল লেখকের রচনাবলীও বদলে দেয়া হচ্ছে। অপরাধ সেটিই। অথচ পাঠ্যবই বিতরণ মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে। ১ জানুয়ারি পাঠ্যবই উৎসব পালন করা হয়। এটি মন্ত্রণালয়েরই কাজ এবং তা নিয়ে এতো হৈচৈয়েরও প্রয়োজন নেই। তারা সুচারুভাবে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন সে জন্য তারা ধন্যবাদার্হ। এর অর্থ, অনেক মন্ত্রণালয় সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। কিন্তু, শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে। সেটি মন্ত্রী বা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মানতে নারাজ। এ কারণে, এখন খুব বেশি কথা কেউ বলতে চাচ্ছেন না। কারণ, বাংলাদেশে এটি সবাই বুঝে গেছেন, প্রধানমন্ত্রী নারাজ হলে, অনেক ঝামেলা হতে পারে। সুতরাং চুপচাপ থেকে পয়সা বানানো অনেক ভাল। কিন্তু, শিক্ষা সেক্টরে যে সব তুঘলকি কা- হচ্ছে তা বলার নয়। প্রধানমন্ত্রী নারাজ হয়ে বলেছেন, শিক্ষার মানটা কি? সেটা তো কেউ কিছু বলছেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রাথমিক পাঠ্যবইয়ে যা ভুল সেটিই কি মান তুলে ধরে না? কই, পৃথিবীর আর কোন দেশে পাঠ্যবইয়ে এত ভুল হয়? এত বিতর্ক হয়? বিতর্কটা শুরু হয়েছে প্রথম শ্রেণীর ‘আমার বাংলা’ বই নিয়ে। এ বইটি আমি যোগাড় করেছি। আমি আরও বলি, খোলা বাজার থেকেই আমি এক সেট বই কিনেছি। অর্থাৎ, বিনামূল্যে বিতরণের জন্য হলেও কেউ চাইলে বইগুলো কিনতে পারেন। আরেকটি বিষয় জেনে রাখা ভাল। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড [জাশিপাবো] এসব বইয়ের লোক/সংকলক/সম্পাদক বাছাই করে। তারপর পরিমার্জন ইত্যাদি, তারপর ছাপা এবং বিতরণ। এ কথা কিন্তু কেউ বলছেন না, জাশিপাবোর পক্ষে এতগুলো দায়িত্বপূর্ণ কাজ করা সম্ভব কিনা? প্রথম শ্রেণীর বা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যবই রচনায় কি প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছে তা লিখেছেন জাশিপাবোর চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহাÑ ‘পাঠ্যপুস্তকটি শিক্ষার্থীদের উপযোগী হয়েছে কিনা তা যাচাই করার জন্য ২০১৩ শিক্ষাবর্ষে দেশের সাতটি বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত বত্রিশটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ট্রাই-আউট সম্পন্ন করা হয়। ট্রাই-আউট থেকে প্রাপ্ত ফল এবং পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু ও চিত্রসমূহ অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিষয়বস্তু পরিমার্জন করা হয়। সমগ্র বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এই প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞগণ সহযোগিতা করেছেন।’ তাহলে প্রশ্ন ওঠে, ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞগণের’ নির্দেশনা মেনে কি চলতি বছরের পাঠ্যবইগুলো ছাপা হয়েছে? যদি তাই হয়ে থাকে তা’হলে দায়-দায়িত্ব অন্তত প্রাথমিকভাবে তাদের। পত্র-পত্রিকার দাবি অনুযায়ী, গত বছরে যা ছিল পাঠ্যবইয়ে এ বছর তা নেই। কিন্তু জাশিপাবোর বইয়ে লেখা হয়েছেÑ ‘প্রথম মুদ্রণ : সেপ্টেম্বর, ২০১২ পুনর্মুদ্রণ : সেপ্টেম্বর, ২০১৬।’ পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে যা ছিল তার হুবহু মুদ্রণ। এক্ষেত্রে তো তা দেখা যাচ্ছে না। তাহলে বলতে হয়, জাশিপাবো প্রকাশ্যে এমন তথ্য দিচ্ছে যা সত্য নয়। কর্তৃপক্ষ যদি এটাকেই প্রথম মুদ্রণ বলতেন তাহলে অসুবিধা ছিল না। বা নতুন সংস্করণ বললেও ভুল হতো না। কিন্তু মুদ্রিত অক্ষরে ভুল তথ্য দিলে তার দায়িত্ব কে নেবে? আমি শুধু প্রথম শ্রেণীর বাংলা বইটি নিয়েই বলছি। বইটির সংকলন, রচনা ও সম্পাদনা করেছেন- শফিউল আলম, মাহবুবুল হক, সৈয়দ আজিজুল হক এবং নূরজাহান বেগম। প্রথম তিনজনকে দীর্ঘদিন ধরে চিনি। পাঠ্যপুস্তক রচনার সঙ্গে তারা দীর্ঘদিন জড়িত এবং তারা বাংলা সাহিত্যে উচ্চ ডিগ্রীধারী। তারা সাম্প্রদায়িক মননের চর্চা করেন এ কথা কেউ বলবে না। সুতরাং, পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন দেখে বিস্মিত হয়েছি। বিভিন্ন শ্রেণীতে যারা সংকলক, লেখক হিসেবে আছেন তারাও কেউ হেজাবি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। তাদের অনেকের সঙ্গে সাংবাদিকরা যোগাযোগ করেছেন। তারা বলেছেন, এ পরিবর্তনের সঙ্গে তারা যুক্ত নন। কিন্তু, তারা এ বিষয়টি তো প্রকাশ্যে জানাননি। এমনকী সারা জীবন অসাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে যুক্ত থেকে, শেষ জীবনে হেজাবি বা সাম্প্রদায়িক হিসেবে যে তারা বিবেচিত হচ্ছেন এতেও মনে হচ্ছে তারা বিচলিত নন। এর কারণ কী? ভয় না পরবর্তী পাঠ্যবইয়ের রচনা-সম্পাদনা থেকে বাদ পড়ে যাবেন তার ভয়। তারা যে এ কাজে যথাযোগ্য সম্মানী পান তাও নয়। তারা যদি প্রতিবাদ না করেন, তাহলে সম্পূর্ণ দায় কিন্তু তাদেরই। এবং চিরজীবন তারা চিহ্নিত হবেন সাম্প্রদায়িক বা হেজাবি হিসেবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবশ্যই বলতে পারে, এরা দেশের বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অধ্যাপক হিসেবে পরিচিত। তারা যা দিয়েছেন তা আমরা ছেপেছি। তাহলে তারাই দোষী সাব্যস্ত হবেন। ধরে নেয়া গেল, তাদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেন এবং জানালেন মূল পা-ুলিপি দেখা হোক, আমরা এর সঙ্গে জড়িত নই। তাহলে, দায় পড়বে যারা পরিমার্জন করেছেন তাদের ওপর। পরিমার্জক হিসেবে নাম আছে পাঁচজনের। তাহলে, ধরে নিতে হবে বদল তারা করেছেন। কিন্তু, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এদের জন্য দায়ী বলে যাদের সাময়িক বরখাস্ত করেছে, তাদের মধ্যে এরা নেই। খুব সম্ভব এরা জাশিপাবোর কর্মকর্তা। যদি এরা পরিমার্জন করে না থাকেন পা-ুলিপির, তাহলেও এরা প্রতিবাদ করতে পারবেন না। কিন্তু যদি তারা তা করে থাকেন তাহলে কি নির্দেশিত হয়ে করেছেন? এ কারণেই কি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? চলবে...
×