ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

ট্রাম্প-পুতিন মিতালি কি স্টালিন-হিটলার মিতালির পরিণতি ঘটাবে?

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭

ট্রাম্প-পুতিন মিতালি কি স্টালিন-হিটলার মিতালির পরিণতি ঘটাবে?

আমেরিকার রাজনীতিতে উল্টাপুরাণ শুরু হয়েছে মনে হয়। আগে একক সুপার পাওয়ার আমেরিকা বিশ্বের ছোটবড় তাবৎ দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাত; নির্বাচন প্রভাবিত করত, দেশটিতে কে ক্ষমতায় বসবে তা নেপথ্যে বসে নির্ধারণ করত। এখন বিস্ময় বিস্ময়! আমেরিকারই আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে রাশিয়ার মতো দেশ, যে এখন আর সুপার পাওয়ার নয়, তার হস্তক্ষেপের অভিযোগ দিন দিন জোরালো হচ্ছে। রুশ নেতা পুতিনের বিরুদ্ধে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অভিযোগ তুলেছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালে রাশিয়া হ্যাকিং চালিয়েছে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জয়লাভে সাহায্য করেছে। ট্রাম্প এই অভিযোগের মুখে নরম হতে এখনও রাজি নন। তিনি পুতিনের প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, পুতিন সন্ত্রাস দমনে সাহায্য করলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ তিনি তুলে নেবেন। এই দৃশ্যটি কয়েক বছর আগে দেখা গিয়েছিল রাশিয়ায়, সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের সময়। আমেরিকা প্রায় প্রকাশ্যেই সোভিয়েট ইউনিয়নের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছিল। গর্বাচভকে হটিয়ে ইয়েলতসিনকে ক্ষমতায় বসতে সাহায্য জুগিয়েছিল। বাক্যে ও কার্যে রাশিয়ায় ইয়েলতসিন ও বর্তমান আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে কতটা পার্থক্য আছে, তা অনেকে বুঝতে পারেন না। কয়েক দশক আগে অভিযোগটা ছিল, সোভিয়েট ইউনিয়নের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমেরিকা হস্তক্ষেপ করেছে এবং মস্কোতে নিজেদের পছন্দ মতো ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসতে সাহায্য দিয়েছে। এখন অনেকের মনে প্রশ্ন, কয়েক দশক পর এই দৃশ্যটাই পরিবর্তিত হয়ে আমেরিকার নির্বাচনে ডোনাল্ডকে জয়ী করতে পুতিনের হস্তক্ষেপ রূপে দেখা দিয়েছিল কিনা? রাশিয়া অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে চলেছে। ট্রাম্প এই অভিযোগগুলোকে কোন পাত্তা দিচ্ছেন না। প্রেসিডেন্ট পদে তার অভিষেকের দিন (শুক্রবার) হোয়াইট হাউসের সামনে বিশাল গণ-বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছে। তা অবশ্য আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে নয়, এই বিক্ষোভ ট্রাম্পের বর্ণবাদী, নারী ও বহিরাগত-বিদ্বেষী কথাবার্তার বিরুদ্ধে। তবে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়লাভের পেছনে পুতিনের কারসাজি সম্পর্কে প্রকাশ্যেই মুখ খুলেছে। সিআইএ’র বিদায়ী প্রধান কর্মকর্তা জন ব্রেনান তার সংস্থার যে রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করতে যাচ্ছেন তাতে বলা হয়েছে, ‘রাশিয়ান হ্যাকার্স ডেমোক্রাট প্রার্থীকে এমনভাবে টার্গেট করেছিলেন, যাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হন।’ এখানেই শেষ নয়। গত সপ্তাহে একটি ডকুমেন্ট প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, রাশিয়াতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ব্যবসা সম্প্রসারণের লোভনীয় প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল এবং মস্কোতে তাকে সুন্দরী পতিতাদের সংশ্রবে দেখা গেছে (ঈধাধৎঃরহম রিঃয নবধঁঃরভঁষষ ঢ়ৎড়ংঃরঃঁঃবং রহ গড়পড়)ি । ট্রাম্প এই অভিযোগ সম্পর্কে তার টুইটারে লিখেছেন ‘আমার দিকে শেষ তীর নিক্ষেপ করা হয়েছে। আমরা কি নাৎসি জার্মানিতে বাস করছি?’ ট্রাম্প যাই বলুন, পুতিনের সঙ্গে তার দহরম মহরম সম্পর্কিত অভিযোগ আমেরিকায় বড় রকমের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। সিআইএ’র বিদায়ী চীফ জন ব্রেনান আরো বলেছেন ‘রাশিয়ার হুমকি সম্পর্কে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কোনো ধারণাই নেই এবং টুইটারে দায়িত্বহীন সব কথাবার্তা লিখে চলেছেন। রাশিয়ার ভøাদিমির পুতিন আমেরিকার জন্য যে কতো বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন তা বোঝার ক্ষমতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেই।’ আমেরিকার কোনো কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত নিজেকে একজন ভালো প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রমাণিত করতে পারবেন কিনা তা বলা এখন কষ্টকর। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদে তার বিজয় মার্কিন জাতিকে শুধু নয়, তার প্রশাসনকেও দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেছে। এটা মার্কিন জাতির জন্য এক গুরুতর বিপদ সঙ্কেত। মার্কিন এস্টাবলিসমেন্টেও এই দ্বিধাবিভক্তি প্রসঙ্গে তারা বলছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকালে আরেকটি গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের ভূমিকার কথা। নির্বাচন প্রচারণার শেষ দিকে যখন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন অনেক রাজ্যে জনমত জরিপে এগিয়ে যাচ্ছেন তখন এফবিআই তার বিরুদ্ধে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে গুরুতর অনিয়মের একটি অভিযোগ তোলে। নির্বাচন শুরু হওয়ার প্রাক্কালেও এই অভিযোগটি প্রচার করা হয় এবং ভোট গণনা শেষ হওয়ার সময় এই অভিযোগটি তুলে নেয়া হয়। অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন, এটা ছিল ওই গোয়েন্দা সংস্থার উদ্দেশ্যমূলক সাবোটাজ। হিলারিকে তারা প্রেসিডেন্ট পদে চাননি। এস্টাবলিস্টমেন্টের যে অংশ হিলারিকে প্রেসিডেন্ট পদে দেখতে চেয়েছিলেন তারা এখন ট্রাম্পের রুশ কানেকশন ফাঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তুলে ধরে তার প্রেসিডেন্সিকে আঘাত করতে চাইছেন। একশ্রেণীর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের এ ধরনের মতামত কতোটা সঠিক আরো কিছুদিন গেলে বোঝা যাবে। তবে মার্কিন জাতি যে এখন ডিভাইডেড এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে বিভক্ত এস্টাবলিসমেন্টের একটা প্রভাবশালী অংশের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় হোয়াইট হাউসে বাস করতে হবে এটা প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার যাত্রারম্ভের শুরুতেই বোঝা যায়। বারাক ওবামা আমেরিকার মানুষের মনে যে বিশাল প্রত্যাশা সৃষ্টি করে হোয়াইট হাউসে ঢুকেছিলেন তা তিনি পূরণ করে যেতে পারেননি। বিদায়কালে সভায় দাঁড়িয়ে তাকে কাঁদতে হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার ব্যর্থতার মূলে রয়েছে গায়ের রঙ কালো হওয়া এবং সাদা এস্টাবলিসমেন্টের সঙ্গে যুদ্ধে ক্রমাগত পশ্চাৎপসরণ করা। ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেকটাই এস্টাবলিসমেন্ট বিরোধী ভূমিকা নিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে বসতে যাচ্ছেন বলে মনে হয়। এ ক্ষেত্রে তার শক্তি এন্টি মুসলিম রেটোরিক, হোয়াইট সুপ্রিমেসির সেøাগান, নারী ও ইমিগ্রেশনবিরোধী কথাবার্তা। এটা তার কৌশল, না আসল মনোভাব তা বোঝা যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। এস্টাবলিসমেন্টের সঙ্গে তিনি সরাসরি যুদ্ধে নামবেন, এতোটা দুর্মতি তার হবে মনে হয় না। দুর্মতি হলে আমেরিকার রাজনীতিতে আরো একটি ট্রাজিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ায় ‘ফাররাইট’ মহলে যেমন উল্লাস, তেমন উল্লাস ‘ফারলেফট’্ একটি ক্ষুদ্র মহলেও দেখা যায়। রাশিয়ার প্রতি ট্রাম্পের উষ্ণ মনোভাবে তারা খুশি। তারা মনে করেন, ট্রাম্প এখন যতোই আবোল তাবোল বকুন, তাঁর হাতে বিশ্ব রাজনীতির বর্তমান ধারা বদলাবে। ভালোর দিকে অথবা মন্দের দিকে। তবে মন্দের দিকে আর কতোটা এগুবে? আমার এক বাম সাংবাদিক বন্ধু বললেন, ট্রাম্পের যে এতো নিন্দা, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরু থেকে কোন্ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাইতে ভালো ছিলেন? ট্রুম্যান জাপানের নাগাসাকি হিরোশিমাতে এটম বোমা মেরে লক্ষ লক্ষ নরনারী হত্যা করেছেন। আইসেন হাওয়ার রুশ মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধকে উচ্চমার্গে তুলে দেন। কেনেডি ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু করেন, কিউবা সঙ্কটে বিশ্বকে তৃতীয় মহাযুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ করার জন্য অভিযুক্ত। বুশ-প্রেসিডেন্সি কলঙ্কিত অধ্যায় গাল্ফ যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যকে কিলিং ফিল্ডে পরিণত করার জন্য। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদের তুলনায় আর কতোটা সর্বনাশের পথে এগুবেন? ট্রাম্প-প্রেসিডেন্সি সম্পর্কে আশাবাদী এই বাম বন্ধুকে একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের এই মিতালি সম্পূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিক কৌশল হতে পারে। এমনও হবে পারে রাশিয়ার প্রতি নরম মনোভাব দেখিয়ে ট্রাম্প মার্কিন এস্টাবলিসমেন্টের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চান, যাতে তারা তার অন্যান্য কাজে বাধা না দেয়। শেষ পর্যন্ত তিনিই হয়তো সবচাইতে বেশি রুশ-বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করে গোটা পশ্চিমা জগতে তার সমর্থনের ভিত্তি শক্ত করতে চাইবেন। এর উদাহরণ গত শতকেও রয়েছে। ট্রাম্প যেমন মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার ও হোয়াইট সুপ্রিমেসির সেøাগান আউড়ে ক্ষমতায় এসেছেন, গত শতকের জার্মানিতে হিটলার তেমনি ইহুদী বিদ্বেষ প্রচার ও জার্মান সুপ্রিমেসির ধুয়া তুলে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ক্ষমতায় এসেই তিনি কম্যুনিস্ট রাশিয়ার দিকে মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দেন এবং স্টালিনের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি করেন। দানিয়ুব নদীতে হিটলার ও স্টালিন নৌবিহারে যান এবং তাদের কোলাকুলির ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে দারুণ ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। স্ট্যালিন-হিটলারের মিতালিতে তারা আতঙ্কিত হয়ে ভাবতে থাকেন, এই দুই ডিক্টেটর সম্ভবত: গোটা বিশ্ব জয় করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে চান। হিটলার ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে অর্ধেক দখল করে নেন, বাকি অর্ধেক স্ট্যালিন দখল করন। ফলে পশ্চিমা জগতে ভীতি আরও ছড়িয়ে পড়ে। হিটলার অস্ট্রিয়া গ্রাস করেন। তাতে তারা বাধা দেননি। অতঃপর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের টনক নড়ে। তারা হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হন। হিটলারের ফ্রান্সসহ ইউরোপ দখলের পর সরাসরি ব্রিটেনে অভিযান চালানোর কথা। কিন্তু তা না করে ১৯৪১ সালে মিত্র স্ট্যালিনকে বিস্মিত করে বিশাল সীমান্তজুড়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন। ব্রিটেন স্বস্তির শ্বাস ফেলে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। বামপন্থী বন্ধুকে বলেছি, ইতিহাসের কী বিচিত্র ধারা; বর্তমান শতকে ট্রাম্প ও পুতিন মিতালি চলছে। কিন্তু এর পরিণতি কি? গত শতকের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কি? আজকের রুশপ্রেমী ডোনাল্ড ট্রাম্প কি কাল চরম রুশ-বিরোধী হয়ে উঠবেন? রুশ-বিরোধী কঠোর কার্যক্রম গ্রহণ করবেন? মার্কিন হোয়াইট এস্টালিসমেন্ট এবং পশ্চিমা শক্তি শিবিরের কাছে প্রমাণ করতে চাইবেন, ক্রমাগত বেড়ে ওঠা ভয়ঙ্কর রুশ হুমকির মুখে তিনিই তাদের একমাত্র ত্রাতা? এই প্রশ্নটির জবাবের মধ্যেই রয়েছে ট্রাম্প-প্রেসিডেন্সির ভবিষ্যতের ছবি। তা এখনই দেখা বা জানা যাবে না। হোয়াইট হাউসের পাকাপোক্ত হয়ে বসার পরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আসল চেহারাটা দেখা যাবে, উদ্দেশ্য বোঝা যাবে। তাই আরো কিছু সময় আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, বিশ্ব রাজনীতির স্রোত কোনদিকে গড়ায় তা জানা এবং বোঝার জন্য। লন্ডন ১৭ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১৭।
×