ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যোগাসন করুন নিরোগ ও দীর্ঘজীবী হোন

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭

যোগাসন করুন নিরোগ ও দীর্ঘজীবী হোন

যোগ শব্দের অর্থ দেহ ও মনের প্রগাড় সংযোগ বা ঐকান্তিক মিলন। ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার (নফস ও রুহুর মিলন) যোগ বা মিলনকে যোগ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সংযোগ যোগ ইত্যাক্তো জীবাত্মা পরমাত্মানমঃ’ । যোগ বলতে কি বোঝায়, কার সঙ্গে কার যোগ, সেই যোগ ঘটাবে কে- এ সব বুঝতে হলে নিজের সীমাবদ্ধ গ-ি ছেড়ে ‘বিশ্ব ঐক্যতাবাদ’ তথা সৃষ্টির মূলের দিকে তাকাতে হবে। কারণ যোগ মানেই আদির সঙ্গে প্রান্তের যোগ, মূলের সঙ্গে শাখার যোগ, বৃহত্তের সঙ্গে ক্ষুদ্রের যোগ। স্বাস্থ্যের উদ্দেশ্যে বিধিসম্মতভাবে অঙ্গ সঞ্চালনই ব্যায়াম। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষেরই সুস্থ থাকার জন্য কিছু না কিছু যোগ ব্যায়াম করা দরকার । বলতে হয়, ‘সুষম খাদ্য খাও, যোগাসন কর, লাইফ স্টাইল পাল্টাও, টেনশন (স্ট্রেস্) মুক্ত জীবনযাপন কর।’ টেনশন বা স্ট্রেস্ েমানুষের যে কত রোগ হতে পারে এবং আয়ু কমে যেতে পারে আধুনিক বিজ্ঞানীরা তা অনেকভাবে দেখিয়েছেন। যোগাসনকে অনেকে যোগ ব্যায়াম বলেন। আসন আর ব্যায়ামে কিছুটা পার্থক্য আছে। ব্যায়াম হচ্ছে খেলাধুলা, সাঁতারকাটা, হাঁটা, জগিং, সাইক্লিং, জিম, এ্যক্রোবিক ইত্যাদি। খালি হাতে ব্যায়াম করা যায় আবার যন্ত্রযোগেও ব্যায়াম করা হয়। এর মাধ্যমে অঙ্গ সঞ্চালন হয় বটে। এতে যেমন দ্রুতি আছে তেমন শারীরিক পরিশ্রমও আছে। শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক পূর্ণ প্রশান্তির জন্য যোগাসনের বিকল্প নেই। বলা হয়, জগিংয়ে দশভাগ উপকার হয়, টেনিস খেলায় হয় পনেরো ভাগ, সাঁতারে হয় পনেরোভাগ। কেবল যোগাসনের মাধ্যমে এক শ’ ভাগ উপকারিতা পওয়া যায়। যোগাসন ছাড়া এমন কোন ব্যায়াম নেই যাতে শরীরের অস্থি সন্ধিতে এবং ফুসফুস, প্লীহা, পাকস্থলী, মূত্রথলী, যকৃৎ, বৃক্ক ইত্যাদি অন্ত্রে ভালভাবে রক্ত সঞ্চালন হতে পারে। যোগাসন ছাড়া এমন কোন ব্যায়াম নেই যাতে মেরুদ-ে আড়াআড়ি আর লম্বালম্বী চাপ পড়তে পারে এবং মেরুদন্ড দুইদিকে স্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারে। যোগাসন ছাড়া আর কোন ব্যায়ামই নেই যাতে শরীরের প্রয়োজনীয় গ্রন্থিগুলো অধিক সতেজ ও সক্রিয় হতে পারে। তাই যোগাসনকেই সর্বোত্তম বলে ধরা হয়। প্রশ্ন হলো কেন আপনি যোগাসন করবেন? এর প্রথম ও প্রধান কারণ হলো যোগাসন কখনও আপনাকে কিছু করতে বাধ্য করে না, আপনার সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু করতে বলে না। অর্থাৎ আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছা বা স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে না। শুধু আপনাকে পথ দেখিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই পথে চললে তুমি সহজে তোমার লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে।’ যোগাসন আপনাকে হিরো হতে বলে না আবার পালাতেও বলে না। শুধু বলে ‘শুধু একটু সুস্থ থাক।’ যোগাসনে চাই নিষ্ঠা, আন্তরিকতা। আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে যোগাসন কাউকে হতাশ করে না। কিছু-না কিছু ফল পাওয়াই যায়। বলা হয়ে থাকে, ‘স্থিরসুখাসনম্্ আসনমঃ।’ অর্থাৎ স্থির শান্ত ও সহজ ভঙ্গিমায় তথা যথাযথ শ্বাস-প্রশ্বাসসহ যে শারীরিক-মানসিক বিভিন্ন অনুশীলন করা হয় তারই নাম আসন। মানব শরীরের প্রতিটি স্নায়ুকোষ ও স্নায়ুতন্ত্র, টিস্যু, পেশী, গ্রন্থি-উপগ্রন্থিসহ প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যথোপযুক্ত ব্যায়ামই আসন। আসন অভ্যাসকারী অনুশীলনের সময় অবশ্যই শারীরিক সুখবোধ ও আরাম তথা মানসিক প্রশান্তি অনুভব করেন। আসনের দৈনন্দিন অভ্যাস শরীরকে প্রশান্তি দেয়। মনোদৈহিক রোগ নিরাময় করে। আসন যেহেতু গ্রন্থি-উপগ্রন্থি তথা গ্রন্থিরস (যড়ৎসড়হবং) নিঃসরণকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই আসনের মাধ্যমে মনের বৃত্তিগুলোর নিয়ন্ত্রণ হয়ে যায়। তাই আসন সাধকের শারীরিক ভারসাম্য রক্ষা ও মনের একাগ্রতা বৃদ্ধি পায়। আসনের উপকারিতা ১) দেহের নমনীয়তা বাড়ায়। ২) দেহ ও মনের সমতা রক্ষা করে। ৩) অবাঞ্ছনীয় চিন্তা মনে আসতে দেয় না । ৪) সূক্ষ্মতর ও উচ্চতর সাধনার জন্য মনকে প্রস্তুত ও সাহায্য করে। ৫) গ্রন্থিগত ত্রুটি দূর করে আর গ্রন্থিরস ক্ষরণে সমতা আনে। এইভাবেই আসনের মাধ্যমে বৃত্তি নিয়ন্ত্রণ স¤ভব হয় । আসনের নামকরণ ক) কিছু কিছু আসনের ভঙ্গিমা প্রাণীদেহের বিশেষ চলাফেরার মতো। তাই তাদের নামকরণ সংশ্লিষ্ট প্রাণীটির নামানুসারে রয়েছে যেমন - মৎস্যমুদ্রা, গরুড়াসন ইত্যাদি। খ) কিছু আসন প্রাণীর- সংরচনার বৈশিষ্ট্য বা স্বভাবের সমান। তাদের নামকরণ সে অনুযায়ী হয়েছে, যেমন- কুর্মাসন, শলভাসন (শলভা মানে পঙ্গপাল) ইত্যাদি। গ) কিছু আসন বিশেষ গুণসম্পন্ন হওয়ায় তাদের নামকরণ সেভাবেই হয়েছে। যেমন-সর্বাঙ্গাসন। এতে সমগ্র দেহযন্ত্র উপকৃত হয়। ঘ) কিছু আসন যিনি প্রথম আবিষ্কার করেছেন তার নামানুসারে হয়েছে। যেমনÑ মৎস্যেন্দ্রাসন (যোগী মৎস্যেন্দ্রনাথ কর্তৃক আবিষ্কৃত)। এই আসনটিও সমগ্র দেহযন্ত্রকে প্রভাবিত করে। আসনের প্রকার আসন প্রধানত দুই প্রকারের-স্বাস্থ্যাসন আর ধ্যানাসন। স্বাস্থ্যাসনের অভ্যাস করা হয় মুখ্যত দৈহিক স্বাস্থ্যের জন্য আর কিছু করা হয় আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য। ধ্যানাসনের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো মনের একাগ্রতা আর সাধনা। ধ্যানাসনের উদাহরণÑ পদ্মাসন, বদ্ধ পদ্মাসন, সিদ্ধাসন, বীরাসন। দুই প্রকারের মধ্যেই বহুসংখ্যক আসন আছে। যোগীরা সব মিলিয়ে ৫০,০০০ আসন ভঙ্গি আবিষ্কার করেছেন। কোন আসন করলে কি উপকার হয় বা কোন আসন কার করা উচিত একজন যোগাভ্যাসকারীর পক্ষে বুঝে ওঠা অসম্ভব। তাই আসনের ক্ষেত্রে একজন অভিঙ্গ আচার্যের মূল নির্দেশনা অপরিহার্য। বই দেখে আসন করা ও কোন চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া শক্তিশালী ওষুধ সেবন করার একই। আচার্যের বিনা নির্দেশনায় আসন অভ্যাস করলে উপকারের চেয়ে বিপদের ঝুঁকি থাকবে। আজকের লেখায় একটি আসনের বর্ণনা দেয়া হলো। সর্বাঙ্গাসন সর্ব অঙ্গের জন্য উপকারী বলে এমন নামকরণ হয়েছে। যারা সবসময় অন্য আসন করতে পারেন না তাদের পক্ষে এই আসনটি অবশ্যই করা উচিত। এতে অন্যান্য আসনের উপকারিতা পাওয়া য়ায়। যাঁরা নিয়মিত আসন করেন তাঁদের কাছে এই আসনটি অতি প্রিয়। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ুন। দু’হাত দু’পাশে রাখুন। এবার শ্বাস নিতে নিতে দু’পা উপরে তুলুন। এবার ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়ুন। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখুন। দু’হাতের করতল দিয়ে কোমরের উপরের অংশ ধরুন যেন পা দুটি সোজা থাকে। চিবুক ঠেকে থাকবে বুকের সঙ্গে। এভাবে এক মিনিট থেকে সর্বাধিক ৫ মিনিট পর্যন্ত থাকবেন। ধীরে ধীরে সময় বাড়াতে হবে। ৪/৫বার আসনটি করতে হবে। দু’বেলা আসনটি করতে পারলে ভাল হয়। উপকারিতা ১. বদহজম, অজীর্ণ, কোষ্ঠবদদ্ধতা সেরে যায়। ২. পেটের ও অন্ত্রের গোলযোগ দূর হয়। ৩. নারীর গর্ভাশয়ের রোগ নিরাময় হয়। গর্ভাশয় সবল হয়। ৪. পা-ুরোগ ও গলিত কুষ্ঠরোগের পক্ষে পরম উপকারী। ৫. চুলকানি, জ্বালাপোড়া ও পদতলের রোগ সেরে যায়। ৬. মূত্রাশয়ের সকল রোগ নিরাময় হয়। ৭. পাচনতন্ত্র ও নাড়ীতন্ত্রের পক্ষে উপকারী। ৮. মেরুদ- নমনীয় হয়। জড়তা ও দুর্বলতা সেরে যায়। ৯. শ্বাসকষ্ট, বুক ধরফড়ানি, ব্রঙ্কাইটিস্, টনসিলাইটিস বিশেষ করে থাইরয়েডের বিশেষ উপকার হয়। ১০. শরীরকে সুস্থ সবল রাখে। মনে স্ফুর্তি আসে। ১১. অকাল বার্ধক্য রোধ করে এবং যৌবন দীর্ঘস্থায়ী করে।
×