ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত ॥ আইএমডি রিপোর্টে তথ্য

আট হাজার বেসরকারী মাধ্যমিকে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নেই

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭

আট হাজার বেসরকারী মাধ্যমিকে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নেই

বিভাষ বাড়ৈ ॥ দেশের আট হাজার বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নেই। যেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রেণীকক্ষও নেই। এতে ছাত্রছাত্রীর বসার জায়গার সংকুলান হচ্ছে না। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই কাঁচা ও সেমিপাকা স্থাপনায় শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী শিক্ষা অনুপযোগী পরিবেশে অধ্যয়ন করছে। অবকাঠামো স্বল্পতার কারণে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। গত দশ বছরে সারাদেশের প্রায় দশ হাজার বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেই ছাত্রছাত্রীর জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রেণীকক্ষ নেই। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে শিক্ষার সঙ্কটের এ চিত্র উঠে এসেছে। আইএমইডির ওই প্রতিবেদন ইতোমধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবছর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে শতভাগ ছেলেমেয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে। সেই অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ চলমান থাকলেও তা ছাত্রছাত্রী বৃদ্ধির তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো সংস্কারে প্রয়োজনীয় সরকারী বরাদ্দও নেই। এদিকে চরম শিক্ষক-কর্মচারী সঙ্কটে পড়েছে তিন পার্বত্য জেলার সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে একাডেমিক কার্যক্রম। প্রায় ৩০ বছর ধরে নতুন পদ সৃষ্টি না হওয়া, বিদ্যমান পদের চেয়ে জনবল কম থাকায় এবং শিক্ষকরা এসব জেলায় চাকরি করতে অনীহা দেখানোয় এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার ১৮ সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মোট ৪৫২ শিক্ষক-কর্মচারীর পদের মধ্যে ১৫৩ পদই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। মাধ্যমিক স্তরে গড়ে প্রতি শ্রেণীতে ১৪/১৫ আবশ্যক বিষয় থাকলেও তিন জেলার সাতটি স্কুলে শিক্ষক-কর্মচারী আছেন মাত্র ৫/৯ ও ১০ জন করে। বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষসহ অবকাঠামো সঙ্কট নিয়ে আইএমইডির প্রতিবেদনে ‘প্রায় আট হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন অনুযায়ী ভৌত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত নয়’ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১৮ হাজার ৪৫৩ মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে ৩১৭ সরকারী (জাতীয়করণ ছাড়া) এবং অবশিষ্ট ১৮ হাজার ১৩৬ বেসরকারী বিদ্যালয়। বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে অধিকাংশ বিদ্যালয়ে ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধা অপ্রতুল। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার বিগত দশ বছরে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রায় দশ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাডেমিক বা ভৌত অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর (ইইডি)। আইএমইডির প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইইডির প্রধান প্রকৌশলী দেওয়ান মোঃ হানজালা বলেন, প্রতিবছর ছাত্রছাত্রী বাড়ছে। বাড়ছে অবকাঠামোগত চাহিদাও। সরকারের নানা পদক্ষেপ এবং শিক্ষামন্ত্রীর নিরলস প্রচেষ্টায় বর্তমানে প্রায় শতভাগ ছাত্রছাত্রী স্কুলে আসছে। এসব কারণেই একদিকে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন করছে, আরেকদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা দেখা দিচ্ছে। তবে বিগত যেকোন সরকারের তুলনায় বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ ভাল হচ্ছে এবং উন্নয়নমূলক কাজও চলমান। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষার মানোন্নয়নে ছয়টি বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নির্বাচিত বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ক্রমবর্ধমান ছাত্রছাত্রী ভর্তির সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, ছয়টি মেট্রোপলিটন শহরে ৬তলা ফাউন্ডেশন বিশিষ্ট ও মেট্রোপলিটন বহির্ভূত এলাকায় ৪ তলার ফাউন্ডেশন বিশিষ্ট একতলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ, বিদ্যমান ভবনের আনভূতিক/উর্ধমুখী সম্প্রসারণ। আরও আছে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা/হাওড়/বিল/নদী বেষ্টিত এলাকায় একাডেমিক ভবন-কাম-বন্যাশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃপ্রণালী ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, ভৌগোলিক বিবেচনায় সমতা অর্থাৎ শহরাঞ্চল এবং গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত ব্যবধান হ্রাসের লক্ষ্যে নির্বাচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ভৌত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা, নির্বাচিত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসবাবপত্র সরবরাহ করা। প্রতিবেদনে বান্দরবানের রেইছা উচ্চ বিদ্যালয় ও সুয়ালক উচ্চ বিদ্যালয় সম্পর্কে পর্যবেক্ষণকারীদের মতামত তুলে ধরে বলা হয়েছে, রেইছা উচ্চ বিদ্যালয় ও সুয়ালক উচ্চ বিদ্যালয়ে নির্মিত ভবনে ওঠার জন্য তৈরি র‌্যাম্পের নেট ফিনিশিং অত্যন্ত মসৃণভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এতে বর্ষাকালে পিচ্ছিল হয়ে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। আর সুয়ালক উচ্চ বিদ্যালয় ভবনের টয়লেট ও বাথরুমের লোডাউনের হাতল ও বেসিনের গ্লাস সেলফ ভাঙ্গা অবস্থায় দেখা গেছে। ফলে টয়লেট ব্যবহারের পর ফ্লাশ করা যাচ্ছে না। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) অধীনে দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বেসরকারী এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৮ হাজার ৩৮৩। এছাড়াও কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় দেড় হাজার। এদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো বলছে, চরম শিক্ষক-কর্মচারী সঙ্কটে পড়েছে তিন পাবর্ত্য জেলার সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে একাডেমিক কার্যক্রম। প্রায় ৩০ বছর ধরে নতুন পদ সৃষ্টি না হওয়া, বিদ্যমান পদের চেয়ে জনবল কম থাকা এবং শিক্ষকরা এসব জেলায় চাকরি করতে অনীহা দেখানোর কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার ১৮ সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মোট ৪৫২ শিক্ষক-কর্মচারীর পদের মধ্যে ১৫৩ পদই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মাধ্যমিক শাখার উপ-পরিচালক একেএম মোস্তফা কামাল বলছিলেন, আশির দশকে এসব স্কুল জাতীয়করণ করা হয়। এরপর এগুলোতে আর নতুন পদ সৃজন হয়নি। আমরা পদ সৃষ্টির জন্য বার বার দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু এ সংক্রান্ত ফাইল অর্থ মন্ত্রণালয় হয়ে জনপ্রশাসনে গিয়েই আটকে যায়। আবার নতুন শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না এবং কর্মচারী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। এজন্য সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে সঙ্কটের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তাতে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার মোট ছয়টি সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারীর পদ রয়েছে ১৪৮, যার মধ্যে ৪৬ পদই দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি লংগদু সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারীর মোট পদই রয়েছে মাত্র পাঁচটি, যার মধ্যে একটি পদ শূন্য ও জুরাছড়ির ভুবনজয় উচ্চ বিদ্যালয়ে মোট ৯ পদের মধ্যে পাঁচটিই খালি এবং রাজস্থলীতাইতং পাড়া সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের মোট ৯ পদের তিনটি শূন্য রয়েছে। রাঙ্গামাটি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের মোট ৫০ পদের মধ্যে ১৮ শূন্য ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫০ পদের ১০ শূন্য এবং কাপ্তাই নারাণগিরি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৫ পদের মধ্যে ৯ পদ শূন্য রয়েছে। রাঙ্গামাটির জেলা শিক্ষা অফিসার হারুন অর রশীদ সরকার বলছিলেন, জেলা সদরের দুটি স্কুল ছাড়া বাকি চারটি হাই স্কুলের অবস্থা খুবই খারাপ। এসবে দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োজনীয় শিক্ষক না থাকায় ছাত্রছাত্রীরা সরকারী স্কুলে ভর্তিই হতে চায় না। মাত্র ৪/৫ শিক্ষক দিয়ে একটি সরকারী হাই স্কুল কীভাবে চলে? বান্দরবানের মোট সাতটি সরকারী স্কুলের ১৬১ পদের মধ্যে ৫৮ পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য।বান্দরবান সরকারী হাই স্কুলের মোট ৫০ পদের ১৪ শূন্য ও সরকারী বালিকা হাই স্কুলের মোট ৪৯ পদের ১৭ শূন্য, লামা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ২৫ পদের ১৬ খালি, রোয়াংছড়ি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের নয়টি পদের চারটি শূন্য, রুমা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে নয়টি পদের চারটি শূন্য এবং নাইক্ষ্যংছড়ি ছালেহ আহমদ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে মাত্র নয়জন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। খাগড়াছড়ির পাঁচটি সরকারী হাই স্কুলের মোট ১৪৩ শিক্ষক-কর্মচারীর পদের মধ্যে ৪৯ শূন্য রয়েছে।
×