ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার গৃহবধূ আকলিমা

আমি কোনদিন স্বামীর মুখ দেখতে চাই না, ওর শাস্তি চাই

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭

আমি কোনদিন স্বামীর মুখ দেখতে চাই না, ওর শাস্তি চাই

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘দীর্ঘ বাইশ বছর সংসার করার পরও আমার স্বামী আমার সঙ্গে এমন করল কী ভাবে? নিজের হাতে আমার মুখে এ্যাসিড মারল! যৌতুকের জন্য সে আমাকে প্রায়ই মারধর করত। কিন্তু কখনও ভাবতেও পারিনি। আমাকে এ্যাসিড মারবে। আমি আর কোনদিন আমার স্বামীর মুখ দেখতে চাই না। আমি ওর শাস্তি চাই।’ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) বার্ন (ব্লু) ইউনিটের চার নম্বর বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন আকলিমা বেগম (৩৫)। শুক্রবার দুপুরে তার স¦ামী কুদ্দুছ মিয়া তার মুখে এ্যাসিড নিক্ষেপ করে। ঘটনার পর থেকে ঢমেকের বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছে আকলিমা। তার মুখ, ডান হাত ও বুকের ডান পাশ এ্যাসিডে ঝলসে গেছে। রাজধানীর নাখালপাড়া এলাকায় স্বামী ও চার সন্তান নিয়ে বসবাস করত আকলিমা। নেশাগ্রস্ত স্বামী পরিবারের দায়ভার গ্রহণে অনীহা দেখালে বেশ কয়েক বছর আগ থেকেই পাশের এক গার্মেন্টসে চাকরিও শুরু করেন আকলিমা। তার উপার্জিত অর্থ দিয়েই সংসার চালত। তার স্বামী বেশ কয়েক বছর বিদেশ থেকে আসলেও নেশা করার কারণে টাকা সঞ্চয় করতে পারেনি। তারপর সেখানে পুলিশ গ্রেফতার করলে জেল খেটে বাংলাদেশে চলে আসে। আসার পর থেকেই ব্যবসা করবে বলে শুধু টাকা চাইত। আকলিমার পরিবার ইতোমধ্যেই চার লাখ টাকা দিয়েছে তাদের জামাইয়ের ব্যবসার জন্য। কিন্তু সব টাকা উড়িয়েছে ইয়াবা খেয়ে। এবার টাকা চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আকলিমা টাকা দিতে অস্বীকার করায় এ্যাসিডে ঝলসে গেল তার মুখ। এ ঘটনার পর থেকে তার স্বামী এখনও পলাতক রয়েছে। হাসপাতালে আকলিমাকে দেখাশুনা করার জন্য সঙ্গে আছে তার মা। তিনি বললেন, ‘আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে দিল। মাত্র ১২ বছর বয়সে আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলাম। এতকাল সংসার করার পরও অমানুষটা এমন একটা কাজ করল। একমাত্র নেশাই কাল হয়ে দাঁড়াল। ইয়াবার নেশা করত আমার জামাই। অনেক বোঝানো হয়েছে কিন্তু কে শোনে কার কথা! ঘটনার পরপরই পুলিশের কাছে মামলা করেছি। পুলিশও বেশ কয়েকবার হাসপাতালে দেখতে এসেছে আকলিমাকে। কিন্তু এখনও কুদ্দুছকে ধরতে পারেনি পুলিশ।’ এ্যাসিডে আকলিমার পুরো মুখ বীভৎস হয়ে গেছে। চোখের মধ্যেও এ্যাসিড ঢুকেছে। এরপর থেকে আর চোখ খুলতে পারেনি আকলিমা। কান্না করার শক্তিটুকুও নেই তার। এমন অবস্থাতেই সেদিনের ঘটনাটি অস্পষ্টভাবে বলতে শুরু করলেন তিনি, ‘শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করছি। রান্নাও শুরু করছি। আমার স্বামী ঘুম থেকে উঠেই টাকা চাওয়া শুরু করল। আমি স্পষ্টভাবে বলে দিলাম, আমি আর টাকা দিতে পারব না। এই কথাটাই আমার জীবনের কাল হলো। একটা স্টিলের মগে কি যেন ঢালল। আমিও ততটা খেয়াল করিনি, রান্না করছিলাম। তারপর আমার সামনে এসে দাঁড়ালো আমি তার দিকে তাকাতেই মুখে এ্যাাসিড ছুড়ে দিল। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই। আহাজারির সুরে কথাগুলো বললেন তিনি। আকলিমার সংকটাপন্ন অবস্থা প্রসঙ্গে ঢামেকের বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডাঃ সীমান্ত লাল সেন বললেন, ‘তার মুখ একেবারেই বিকৃত হয়ে গেছে। কিছু কিছু স্থান বেশি ঝলসে গেছে। এসব স্থানগুলোতে সার্জারি করতে হবে। আপাতত পোড়া ক্ষত শুকানোর জন্য চিকিৎসা চলছে। আকলিমার চোখ দুটিও মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়েছে। যতদিন সে সুস্থ না হচ্ছেন ততদিন আমাদের ট্রিটমেন্টেই থাকবে আকলিমা।’ আক্ষেপ করে কর্তব্যরত চিকিৎসক আরও বললেন, ‘এ্যাসিড সন্ত্রাস অনেকটাই কমে গিয়েছিল। আবারও কি কারণে এমন কাজ করার সাহস পাই অপরাধীরা। এ্যাসিড সহজলভ্য হওয়ার কারণে এখন যে কেউই এ্যাসিড যোগাড় করতে পারে। শুধু আকলিমা নয়, প্রতি বছরই দেশের অনেক নারীরা বিভিন্নভাবে এ্যাসিড সন্ত্রাসের মুখোমুখি হচ্ছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাষা- স্বামী ১০ হাজার টাকা যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীর পূর্ণিমার মুখে এ্যাসিড ঢেলে দেয়। জীবনের সঙ্গে টানা ২৮ দিন যুদ্ধ করে মারা যায় বগুড়ার পূর্ণিমা। আকলিমার মতো যৌতুকের কারণে পাবনার সাইমা আক্তার ডলিও (৩০) এ্যাসিড দগ্ধ হয় তার স্বামীর দ্বারা। এছাড়া, নবেম্বর মাসে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের তালতলা কলোনিতে পারিবারিক কলহের জন্য এ্যাসিড নিক্ষেপ করে স্ত্রীর গোপনাঙ্গ ঝলসে দেয় তার স্বামী। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে যশোরের শার্শায় এক বখাটে কর্তৃক সপ্তম শ্রেণীর এক স্কুলছাত্রীকে প্রেম নিবেদনে ব্যর্থ হয়ে এ্যাসিড নিক্ষেপ। এতে মেয়েটির মুখ ও শরীরের কয়েকটি স্থান ঝলসে যায়। এসব ঘটনার অপরাধীদের কেউই তাদের প্রাপ্য শাস্তি পাইনি। বরং কোন না কোনভাবে জামিন পেয়ে প্রকাশ্যে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সঠিক বিচারের অভাবে এ্যাসিড সন্ত্রাসের মতো ভয়াবহ ঘটনা বাড়ছে। সেই সঙ্গে এ্যাসিড বেচাকেনায় কড়াকড়ি কোন আইন না থাকার ফলে এসব লোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। কঠোর আইন এবং সরকারী ও বেসরকারী অনেক উদ্যোগের পরও কমেনি নারী নির্যাতনের চিত্র। নির্যাতনের মাত্রায় বরং যোগ হচ্ছে অভিনব কৌশল। তুলনামূলক হারে এ্যাসিড সন্ত্রাসের ঘটনা হ্রাস পেয়েছিল গত বছর। যা অনেকের মনেই স্বস্তি এনে দিয়েছিল। কিন্তু বছরের শুরুতেই আকলিমা এ ঘটনাটি অনেকের মনে আবার সেই ভীতির জন্ম দিয়েছে। ২০১৬ সালে ৩৪ জন নারী ও শিশু এ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। এ ঘটনায় একজন মারা যান। এর মধ্যে মাত্র ১২টি ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে। ২০১৫ সালে এর সংখ্যা ছিল ৪৫ জন। যা ২০১৪ সালের তুলনায় ২২% কম। মহিলা পরিষদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার নারী ও শিশুদের মধ্যে ২৯% প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায়, ১৮% শুক্রতার কারণে এবং ০৭% যৌতুক ও স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি না দেয়ায় অন্তত ০৭% সহিংসতার শিকার হয়েছে। এ্যাসিড সন্ত্রাস প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। ২০০২ সালে এ্যাসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগে এ্যাসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২ এবং এ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২ প্রণীত হয়। বর্তমানে এ্যাসিড মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পরিচালিত হচ্ছে। বিচারে মোট সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ৩০৫ জন। এর মধ্যে মৃত্যুদ-াদেশ প্রাপ্ত ১৩ জন যার একটিও কার্যকর হয়নি। পরবর্তী সময়ে সরকার এ্যাসিড কন্ট্রোল কাউন্সিল (এনএসিসি) এবং জেলা এ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কমিটি (ডিএসসিসি) গঠন করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ মনিটরিং সেল এবং পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের অধীনে এ্যাসিড কেস মনিটরিং সেল গঠিত হয়। এ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ) জাতীয় এ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের (এনএসিসি) সদস্য হিসেবে জাতীয় এবং জেলা পর্যায়ে এসিড সারভাইভারসদের পুনর্বাসন ও এসিড সহিংসতা নির্মূলের লক্ষ্যে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।
×