ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণঘাতী শত্রুর সঙ্গে জীবনযাপন

পলি প্লাস্টিকের বোতলে যা খাচ্ছেন, কতটা নিরাপদ

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭

পলি প্লাস্টিকের বোতলে যা খাচ্ছেন, কতটা নিরাপদ

সমুদ্র হক ॥ মিনারেল ওয়াটার পান করছেন! আপ্যায়নে কিংবা নিজে কিনে পান করছেন সফট ড্রিংকস (সেভেন আপ পেপসি কোককোলা ইত্যাদি)। সরিষার তেল জ্যাম-জেলি ও আচারসহ নানা কনজুমার পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এখন প্রায় সবই ভরানো হচ্ছে পলি প্লাস্টিকের বোতলে। কখনও ভেবে দেখেছেন, পলি প্লাস্টিকের বোতলে বিশুদ্ধ পানি, সফট ড্রিংকসসহ যা পান করছেন ও খাচ্ছেন তা কতটা বিষমুক্ত! বাজারে সওদাপাতি করছেন, দোকান থেকে নানা পণ্য কিনছেন তাও পলিব্যাগে। যা বহন করে ঘরে নিয়ে যাওয়ার পর ফেলে দিচ্ছেন। কখনও ভেবেছেন যে খালি পলি প্লাটিকের বোতল আপনি হকারদের কাছে বেঁচে দিচ্ছেন এবং পলি ব্যাগ ফেলে দিলেন তা অবচেতনে আপনারই দেহে বিষক্রিয়ায় পেঁচিয়ে ধরছে অক্টোপাশের মতো। ফলে বিপন্ন হয়ে পড়ছে মানুষ, মাটি। বিষাক্ত হয়ে পড়ছে বাতাস। যে অক্সিজেন আপনি নিচ্ছেন তা দূষিত হয়ে নিরাপদ থাকছে না। কতটা ভয়াবহতার মধ্যে পাড়ি দিচ্ছেন দিনগুলো। নিকট অতীতে লোকজন হাটবাজারে সদাইপাতি করত পাটে তৈরি চটের ব্যাগে! শহরে ও গ্রামে হাট বাজারে যাওয়ার সময় হাতে থাকত এই ব্যাগ। মাছ গোশ্ত শাক-সবজিসহ নানা পণ্য কিনে আনত এই ব্যাগে। প্রত্যেক বাড়িতে নির্দিষ্ট স্থানে ঝুলানো থাকত এই ব্যাগ। যার পরিচিতি ছিল বাজারের ব্যাগ। পণ্য আনা নেয়ার ব্যাগ তেল চিটচিটে হয়ে যেত। ধুয়ে রোদে শুকিয়ে পরিষ্কার করা হতো। গ্রামের লোক হাটে যেত ধামা কাঁধে। পানি সফট ড্রিংক সরিষার তেল, নারিকেল তেল ও আচারসহ কনজুমার পণ্য বিক্রি হতো কাঁচের বোতলে। এই চিত্র আজ আর চোখে পড়ে না। কথিত আধুনিকতায় কাঁচের বোতলের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে পলি প্লাস্টিকের বোতল। এই পলি প্লাস্টিক তৈরি হয় সাবু দানার চেয়ে আকারে একটু বড় এক রাসায়নিক যৌগ দিয়ে। ধপধপে সাদা। মনে হবে মোম গলিয়ে ফোঁটা ফেলে তৈরি করা হয়েছে। ভুল ভেঙ্গে যাবে হাতে চাপ দিলেই। খুবই শক্ত। মোটেও চ্যাপ্টা হচ্ছে না। এটা এক ধরনের গ্রানিউল। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে এগুলো আসে আমাদের দেশে। বিশেষ করে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও হংকং থেকে। এই গ্রানিউল তাপে গলিয়ে তৈরি হয় পলি প্লাস্টিকের বোতল ও ব্যাগ। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, ব্যবহারের পর যে পলি প্লাস্টিক ফেলে দেয়া হয় তা পুড়িয়ে রিসাইক্লিং করে ফের তৈরি হয় পলি প্লাস্টিক। এমন পলি প্লাস্টিক হাজারও দ্রব্যের আকার নিয়ে চারধারে ঘিরে ফেলেছে। বিশুদ্ধ পানির বোতল সফট ড্রিংকস থেকে শুরু করে থালা ঘটি বাটি এমন কি জীবন রক্ষাকারী ওষুধের মোড়ক পর্যন্ত। এক কথায় যাপিত জীবনে ব্যবহার্য এমন সব কিছুকেই গ্রাস করে ফেলেছে প্লাস্টিক পলিথিন। উন্নত দেশগুলোর মানুষ বলেছে যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। এই জঞ্জাল দূর করতে হবে। তারা তাই করেছে। উন্নত দেশে পলি প্লাস্টিকের মধ্যে কোন কিছ্ইু ভরানো হয় না। তারা বিকল্প নানা পথ বেছে নিয়েছে। এই দেশগুলোই গ্রানিউল পাঠিয়ে দিচ্ছে আমাদের দেশে। আর আমরা পলি প্লাস্টিককে কথতি আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছি। একবার পলি মলিকিউল (অণু) তৈরি করলে তা আর বিনাশ হয় না। পুড়ে ভস্ম হয় না। ডোবে না। মটিতে মেশে না। মাটির স্তর পৃথক হয়ে থাকে। মাটির অক্সিজেন শোধনের ক্ষমতা হারায়। মাটির মধ্যে অসংখ্য জৈব পদার্থের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। নগরীতে ড্রেন বদ্ধ করে দেয়। জলাশয় দূষিত করে ফেলে। এই অণু অজয় অমর অক্ষয়। এই অমর শত্রুকে আমরা ঘরে তুলেছি। এই পলি প্লাস্টিক পণ্যকে বলা হয় আনসেচুরেটেডে কম্পাউন্ড। এর বড় বৈশিষ্ট্য হলোÑ অণুগুলোরে কিছু বাহু শেষ পর্যন্ত মুক্ত অবস্থায় থাকে। মুক্ত বাহুগুলো অন্য কোন পদার্থের সংস্পর্শে এলে তার সঙ্গে যোগ হয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে। ফলে আপাত দৃষ্টিতে পলি প্লাস্টিকের নিষ্ক্রিয় নিরাপদ মনে করা হলেও মোটেও তা নয়। পলিব্যাগ ও পলি প্লাস্টিকের পাত্রে দীর্ঘ সময় তরল ও শুকনো যে কোন খাদ্যদ্রব্য বা কোন জিনিস রাখা হলে ট্রেস এ্যামাউন্টে ঢুকে পড়ে। ট্রেস এ্যামাউন্ট বলতে বোঝায় এমন রাসায়নিক যৌগ যা খালি চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই। সূক্ষ্ম পরীক্ষায় কেবল শনাক্ত করা যায়। মনে করা হয় পলি প্লাস্টিকের ভেতরে যা রয়েছে তা অবিকৃত। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। পলি ব্যাগে মাছ গোশ্ত ভরে ফ্রিজে রেখে দেয়ার পর অনেকটা সময় ধরে একটু একটু করে রান্না করে খেলে কিছুটা টের পাওয়া যায়। স্বাদের পরিবর্তন ঘটায়। যে পরিবর্তন বিষাক্ত টক্সিক।
×