ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ওয়েলিংটনে শেষ পর্যন্ত হারল বাংলাদেশই!

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭

ওয়েলিংটনে শেষ পর্যন্ত হারল বাংলাদেশই!

মোঃ মামুন রশীদ ॥ দুঃস্বপ্ন আর দুর্ভাগ্যের ভেন্যু ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভ। চারদিনের উজ্জ্বলতা প্রথম টেস্টের পঞ্চমদিনে যেভাবে বিপর্যয়ে মলিন হয়েছে সেটা ভুলেই যেতে চাইবে বাংলাদেশ ক্রিকেট। কারণ নিউজিল্যান্ডের কাছে এই শেষদিনের ব্যর্থতায় ৭ উইকেটে হেরে গেছে বাংলাদেশ দল। টেস্ট ক্রিকেটে এমনটা অবিশ্বাস্যই , কারণ ১২২ বছরে এমনটা ঘটেনি। ১৮৯৪ সালে ৭ দিন ধরে হওয়া টেস্টে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৫৮৬ রান করেও হেরে গিয়েছিল ইংল্যান্ডের কাছে। সেটাই ছিল সর্বাধিক রান করে হারের রেকর্ড। আর বাংলাদেশ ৮ উইকেটে ৫৯৫ রান করে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করেও হেরে সেই রেকর্ডকে পেছনে ফেলেছে। আগের দিনের ৩ উইকেটে ৬৬ রান নিয়ে খেলতে নেমে ১৬০ রানে দ্বিতীয় ইনিংসে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। ২১৭ রানের টার্গেট অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের বিধ্বংসী হার না মানা ১০৪ রানের সুবাদে ৩ উইকেট হারিয়ে ছুঁয়ে ফেলে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড। ম্যাচের চারদিন পর্যন্ত ছিল বাংলাদেশেরই দখলে। কারণ ১২২ রানের লিড নিয়ে ফেলেছিল সফরকারীরা। যদিও দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৬ রান তুলতেই ৩ উইকেট হারানোর কারণে পরাজয়ের ডঙ্কা বাজছিল নেপথ্যে। শঙ্কাটা তীব্র হয়েছিল ইনজুরি আক্রান্ত মুশফিকুর রহীম ও ইমরুল কায়েস ব্যাট করতে পারবেন কিনা সেই সংশয়ে। ঘটনাবহুল একটি টেস্ট- যেখানে সব দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের কপালেই লেখা হয়েছে। বৃষ্টি আর বাতাসের তীব্র দাপটের সঙ্গে ছিল কনকনে শীত। অচেনা এই পরিবেশে আবার দ্রুতগতির উইকেট। সেসবকে জয় করাটা আরও কঠিন হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ টস হেরে আগে ব্যাটিংয়ে নামার কারণে। কিন্তু এত সব প্রতিকূলতাকে জয় করে দুর্দান্ত ব্যাটিং নৈপুণ্য দেখায় বাংলাদেশ। ৮ উইকেটে ৫৯৫ রান তুলে ইনিংস ঘোষণা করে। নতুন কিছু রেকর্ডের জন্মও দেয়। সাকিব আল হাসান-মুশফিকুর রহীম ৩৫৯ রানের রেকর্ড জুটি গড়েন। সাকিবের ব্যাট থেকে আসে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ২১৭ রানের ইনিংস। আর হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির ছোবলমুক্ত না হয়েও মুশফিক ১৫৯ রান করেন দুই হাতের দুই আঙ্গুলে তীব্র ব্যথা পেয়েও। তবে নিউজিল্যান্ড মোক্ষম জবাব দিয়েছে। বিশাল রানের চাপে থেকেও ৫৩৯ রান তোলে প্রথম ইনিংসে। ৫৬ রানে এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংস শুরুর পরও স্বাগতিকদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল বাংলাদেশের। ৪৬ রান পর্যন্ত টিকে ছিলেন তামিম ইকবাল ও ইমরুল। কিন্তু মুশফিকের অনুপস্থিতে টানা ১৪২ ওভার উইকেটরক্ষকের দায়িত্ব পালন করা ইমরুল কোমরের ব্যথায় মাঠ ছাড়েন স্ট্রেচারে করে। তারপরই বিপদ- দিনশেষে ৩ উইকেটে ৬৬ বাংলাদেশ। ১২২ রানের লিড থাকলেও পঞ্চম দিনে চ্যালেঞ্জটা কঠিন ছিল বাংলাদেশের দুই ব্যাটসম্যান মুমিনুল হক ও সাকিবের ওপর। কিন্তু সাকিব দিনের অষ্টম বলেই সাজঘরে ফেরেন শূন্য রানে। টেস্ট ইতিহাসে প্রথম ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরির পর দ্বিতীয় ইনিংসে শূন্য রানে সাজঘরে ফেরার ঘটনা এটি সপ্তম। তবে কোন বাঁহাতির জন্য প্রথম। মুমিনুলও মাত্র ২৩ রান করে সাজঘরে ফিরলে বিপদে পড়ে বাংলাদেশ। সাব্বির বেশ ধৈর্য নিয়ে খেলছিলেন। তাকে সঙ্গ দিতে বাধ্য হয়েই নামেন মুশফিক ফোলা আঙ্গুলের ব্যথা নিয়ে। কিন্তু আরও বড় বিপত্তি ঘটে ইনিংসের ৪৩তম ওভারে। টিম সাউদির হঠাৎ উঠে আসা বল থেকে বাঁচতে মাথা ঘুরিয়ে নেন ১৩ রান করা মুশফিক। সেটা তার হেলমেটের পেছনে ঘাড়ে আঘাত করে সরাসরি। উইকেটে লুটিয়ে পড়ার পর কিছুক্ষণ মাঠেই চিকিৎসা করে এ্যাম্বুলেন্সে তাকে পাঠানো হয় ওয়েলিংটন হাসপাতালে স্ক্যানের জন্য। ওই অবস্থা থেকেও লড়াই করছিলেন সাব্বির, তাকে সঙ্গ দিতে পারেননি আর কেউ। তবে ক্যারিয়ারের তৃতীয় অর্ধশতক হাঁকিয়ে (১০১ বলে ৯ চারে ৫০) সাব্বির সাজঘরে ফেরার পর ইমরুলও ব্যাট হাতে নামেন। তবে তার সঙ্গী ছিল না কেউ। ১৬০ রানেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। ইমরুল অপরাজিত থাকেন ৩৬ রানে। মাত্র ২১৬ রানের লিড। ট্রেন্ট বোল্ট ৩টি এবং স্যান্টনার ও ওয়াগনার ২টি করে উইকেট নেন। ২১৭ রানের ছোট টার্গেট হলেও বাংলাদেশ বোলারদের দারুণ শুরুটা চাপেই রেখেছিল নিউজিল্যান্ডকে। দলীয় ৩৯ রানেই সাজঘরে ফেরেন প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান টম লাথাম (১৬) ও জিত র‌্যাভাল (১৩)। প্রথম ইনিংসে সুবিধা করতে না পারলেও তরুণ অফস্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ জ্বলে উঠে জোড়া আঘাত হানেন। কিন্তু তৃতীয় উইকেটে উইলিয়ামসন ও অভিজ্ঞ রস টেইলর আগ্রাসন চালিয়েছেন। তাদের ঝড় বয়ে গেছে মেহেদি আর তাসকিন আহমেদের ওপর। মাত্র ১৫২ বলে তারা জুটিতে যোগ করেন ১৬৩ রান। টেইলর ৭৭ বলে ৬ চারে ৬০ রান করার পর শুভাশিষ রায়ের পেসে সাজঘরে ফেরেন। কিন্তু ততক্ষণে জয়ের সন্নিকটে চলে গেছে কিউইরা। উইলিয়ামসন ক্যারিয়ারের ১৫তম শতক হাঁকিয়ে ১০৪ রানে অপরাজিত (৯০১ বলে ১৫ চার) থেকে সেই জয় নিশ্চিত করেন। ১৮৯৪ সালে ৭ দিনের টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার দুর্ভাগ্যের পর ১৯৭২ সালে মেলবোর্নে পাকিস্তান দল ৫ দিনের টেস্টে আক্ষেপের পরাজয় দেখেছিল। প্রথম ইনিংসে ৫৭৪ রান করেও ৯২ রানে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারে তারা দ্বিতীয় ইনিংসে ২০০ রানে গুটিয়ে গিয়ে। আর বাংলাদেশ দল এমন দুর্ভাগ্যের সঙ্গী হয়েছে দ্বিতীয়বার। ২০১২ সালে মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৫৫৬ রান করেও হেরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ওয়েলিংটন সবচেয়ে বড় আঘাত দিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। কারণ এর আগে ৮ বার ইনিংস ঘোষণা করে কখনও হারেনি তারা। এবার সেই ভয়াবহ দুঃস্বপ্নই বাংলাদেশের সঙ্গী হলো।
×