ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

১৪ মনিটরিং টিম গঠন

দু’দফায় আড়াই লাখ টন লবণ আমদানি, সুফল পাননি ভোক্তারা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭

দু’দফায় আড়াই লাখ টন লবণ আমদানি, সুফল পাননি ভোক্তারা

এম শাহজাহান ॥ দু’দফায় এ বছর আড়াই লাখ টন লবণ আমদানি হলেও তার কোন সুফল পায়নি ভোক্তারা। প্রতিকেজি খাওয়ার লবণ পেতে রাজধানীর একজন ভোক্তাকে গুনতে হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকা। অথচ এই লবণের আমদানি মূল্য হচ্ছে মাত্র ১ টাকা ৬২ পয়সা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সব ধরনের খরচ যোগ করার পর এই লবণের উৎপাদন মূল্য ১৭ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেই লবণ দ্বিগুণেরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। আমদানিকারকদের বেশির ভাগ লবণ কিনে নিয়েছে দেশের শীর্ষ কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে লবণের বাজার। তাই ভোক্তা স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সরকার দু’দফায় আড়াই লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দিলেও বাজারে তার কোন প্রভাব পড়েনি। বরং লবণের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা চালাচ্ছেন মিল মালিকরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। এদিকে, ভোগ্যপণ্যের দাম না কমায় ফের নিয়মিত বাজার মনিটরিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এলক্ষ্যে ১৪ মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ঋণপত্র (এলসি) খোলার সময় প্রতিকেজি অপরিশোধিত লবণের আমদানি মূল্য ১ টাকা ৬২ পয়সা। ভারত থেকে আমদানিকৃত এই লবণ দেশে আনতে পরিবহন খরচ, রিফাইন ও অন্যান্য খরচসহ প্রতিকেজি লবণের খরচ হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ১৫-১৭ টাকা। কিন্তু সেই লবণ বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকার উপরে। গত কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ওই সময় সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। বর্তমান বাজারে অপরিশোধিত লবণ বিক্রি হচ্ছে প্রতি মণ ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। একই পরিমাণ আয়োডিনযুক্ত লবণ বেচাকেনা হচ্ছে ১ হাজার ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়। বর্তমানে প্যাকেটজাত লবণ প্রতিকেজি ৩৮-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা পর্যায়ে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে লবণ বিক্রি হচ্ছে মাত্র প্রতিকেজি ৫-৬ টাকায়। কিন্তু দেশে লবণের দাম কমছে না। এ কারণে ভারত থেকে অবৈধপথে লবণ আসছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে বাজারে। সরকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গত বছর এই সময়ে মান ভেদে প্রতিকেজি লবণ বিক্রি হয়েছে ১৫-২৮ টাকা। একই লবণ দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ২৮-৪২ টাকা পর্যন্ত। এ ক্ষেত্রে দামবৃদ্ধির হার প্রায় ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর লবণের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগেও লবণের দাম কমছে না। লবণের দাম বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, ভোক্তাদের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকার দু’দফায় আড়াই লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয়। কিন্তু আমদানিকৃত লবণ সময়মতো দেশে আনতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। এ কারণে লবণের দাম তেমন কমেনি। তবে গত কোরবানি ঈদের সময় আমদানির অনুমতি দেয়া না হলে লবণের দাম কোথায় ঠেকত সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমদানিকৃত বেশির ভাগ লবণ দেশে এসে গেছে। এছাড়া দেশেও ভাল উৎপাদন হবে বলে আশা করছি। চাষীরা এখন লবণ উৎপাদন করছেন। আবহাওয়া ভাল থাকলে আগামী দু’মাস পর্যন্ত তাদের উৎপাদন অব্যাহত থাকবে। তাই শীঘ্রই লবণের দাম কমে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, লবণসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে বাজার মনিটরিং টিম ঢেলে সাজানো হয়েছে। আশা করছি, সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। এদিকে, দেশে উৎপাদিত লবণের বড় অংশ ঈদ-উল-আযহায় কোরবানির চামড়ার প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহার করা হয়। বিসিকের তথ্য অনুযায়ী দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা ১৬ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন। তবে এই তথ্য সঠিক নয় বলে মনে করেন ব্যবসায়ীসহ লবণ ব্যবহারকারীরা। তাদের মতে, দেশে বছরে লবণের মোট চাহিদা প্রায় ২২ লাখ টন। কিন্তু উৎপাদন হয় মাত্র ১৬ লাখ টন। গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক চাষী মাঠ থেকে লবণ সময়ের আগেই তুলে ফেলেন। এছাড়া অপরিশোধিত লবণ পরিশোধন করে ফিনিশড গুড তৈরি করার সময় আরও ঘাটতি হচ্ছে। দেশে যদি ১৬ লাখ টন লবণের চাহিদা ধরা হয় তবে ১৬ লাখ টন লবণ পরিশোধ করতে ২২ লাখ টন অপরিশোধিত লবণের প্রয়োজন। কেননা পরিশোধনের সময় লবণের অনেক অপচয় হয়ে থাকে। আর এসব দিক বিবেচনায় নিয়েই সরকার প্রতিবছর লবণ আমদানির অনুমতি দিয়ে থাকে। ওই হিসেবে দেশে পণ্যটির ঘাটতি প্রায় ছয় লাখ টন। এ বছরের চাহিদা পূরণে সরকার দু’দফায় আড়াই লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয়। কিন্তু সেই লবণ দেশে আনা এবং বিক্রি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। লবণ না এনে কেউ কেউ আমদানির অনুমতিপত্র বিক্রি করে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেক মিল মালিক লবণ এনেছেনও। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের লবণমিল মালিক সমিতির সভাপতি নূরুল কবির জনকণ্ঠকে বলেন, ঘাটতি পূরণেই সরকার লবণ আমদানির অনুমতি দিয়ে থাকে। কিন্তু বড় ৪-৫টি সিন্ডিকেট শিল্প গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে এ শিল্প। এ কারণে রাজধানীতে লবণের দাম কমছে না। তিনি বলেন, অপেক্ষাকৃত ছোট মিলমালিকরা কম দামে লবণ বিক্রি করলেও বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপ লবণের দাম বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে ট্যারিফ কমিশনে প্রস্তাব দিয়েছে। ওই প্রস্তাব পড়লেই বোঝা যায়, তাদের উদ্দেশ্য ভাল নয়। জানা গেছে, বড় কয়েকটি মিল মালিকের হাতে লবণ চলে যাওয়ায় নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের বেশির ভাগ ছোট মিলগুলোতে কাঁচা লবণের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ ও নিতাইগঞ্জ ও তার আশপাশ এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত লবণ মিল রয়েছে। এসব মিলের উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। আবার অনেক ছোট ছোট মিল কাঁচামাল সংকটে সপ্তাহে এক-দুই দিন চালানো হচ্ছে। রূপগঞ্জের নিউ সুপার সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী শাহ মোহাম্মদ অলিউল্লাহ জানান, সরকার আড়াই লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দিলেও বাজারে এর কোন প্রভাব পড়েনি। কারণ চাহিদার তুলনায় স্বল্প পরিমাণ লবণ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে। ছোটবড় মিলিয়ে দেশে বেশির ভাগ লবণ মিলে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে কাঁচামাল সঙ্কটের কারণে। এ কারণে লবণের চাহিদা, উৎপাদন এবং আমদানির সঠিক হিসাব থাকা প্রয়োজন। বিসিক যে তথ্য দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি লবণের চাহিদা রয়েছে। লবণ শুধু খাওয়ার জন্যই নয়, এখন বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহার করা হচ্ছে। এদিকে, গত কোরবানি ঈদের আগে থেকেই সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজিতে অস্থির হয়ে উঠে লবণের বাজার। দাম নিয়ন্ত্রণে ওই সময় সরকার দেড় লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয়। এতেও বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় আরও এক লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। আশা করা হচ্ছিল, আড়াই লাখ টন লবণ দেশে প্রবেশ করলে বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে। বাজার মনিটরিংয়ে ১৪টি টিম গঠন ॥ নিত্যপ্রয়োনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে বাজার মনিটরিং কমিটি গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে ঢাকা শহরের বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজার পরিদর্শন করে পণ্য সামগ্রীর মূল্য, মজুদ ও সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে কোনরূপ অস্বাভাবিক অবস্থা পরিলক্ষিত হলে সে সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ দ্রব্যমূল্য মনিটরিং টিম পুনর্গঠন ও টিমের দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। ১৪টিম ঢাকায় বাজার মনিটরিং করবে। যাদের নেতৃত্বে টিম পরিচালিত হবে তারা হলেন- মোঃ মাহবুবুর রহমান, উপসচিব ডব্লিউটিও সেল। তিনি দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার মার্কেট পরিদর্শন করবেন। এই প্রতিনিধিদলে আরও থাকবেন স্বরাষ্ট্র, কৃষি, খাদ্য, শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। এছাড়া এই টিমে ঢাকা জেলা প্রশাসক, ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণ, এফবিসিসিআই, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন এবং সহকারী পুলিশ কমিশনারের একজন প্রতিনিনিকে রাখা হয়েছে। শামসুদ্দিন আহমেদ উপপরিচালক রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো-উত্তর সিটি কর্পোরেশন, মোঃ রুহুল আমিন উপ-প্রধান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-উত্তর সিটি কর্পোরেশন, মোঃ নজরুল ইসলাম উপ-পরিচালক রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, আবুল কালাম আজাদ সিনিয়র সহকারী সচিব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-উত্তর সিটি কর্পোরেশন, মোঃ ময়েজ উদ্দিন মোল্লাসহ প্রধান ট্যারিফ কমিশন-দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, খলিলুর রহমান উপসচিব ডব্লিউটিও সেল-উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ইউসুফ আলী মজুমদার সিনিয়র সহকারী প্রধান বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন- দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, আবু সালেহ মোহাম্মদ ইমরান সহকারী বাণিজ্য পরামর্শক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, একে এম ফরিদউদ্দিন আহমেদ সহকারী পরিচালক ইপিবি-উত্তর সিটি কর্পোরেশন, মোঃ আব্দুস সামাদ আল আজাদ উপসিচব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, মোঃ আক্তার হোসেন সিও টিসিবি-উত্তর সিটি কর্পোরেশন, মোঃ মুসলেহ উদ্দিন উপ-প্রধান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-উত্তর সিটি কর্পোরেশন, মোঃ বজলুর রশীদ উর্ধতন কার্যনির্বাহী টিসিবি-উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকার বাজার পরিদর্শন করবেন।
×