ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

না’গঞ্জবাসী সন্তুষ্ট ॥ আসামিপক্ষ আপীল করবে

নিহতদের স্বজনদের সন্তোষ ॥ রায় দ্রুত কার্যকর দাবি

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭

নিহতদের স্বজনদের সন্তোষ ॥ রায় দ্রুত কার্যকর দাবি

স্টাফ রিপোর্টার/ নিজস্ব সংবাদদাতা নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত বাস্তবায়ন চেয়েছেন নিহতদের স্বজনরা। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আশা প্রকাশ করছেন উচ্চ আদালতেও এই রায় বহাল থাকবে। অন্যদিকে, আসামি পক্ষের কয়েক আইনজীবী জানিয়েছেন রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন। সোমবার সাত খুনের রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। যে যতটুকু অপরাধ করেছে তার সে পরিমাণই শাস্তি হয়েছে। আমরা চাই রায়টা যাতে উচ্চ আদালতেও বহাল থাকে এবং দ্রুত কার্যকর হয়। পলাতক আসামিদেরও দ্রুত গ্রেফতার চান তিনি। তিনি আরও বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তিনিও স্বজন হারানোর ব্যথা বোঝেন। রায় দ্রুত কার্যকরে বিষয়টি তিনিও দেখবেন আমার প্রত্যাশা। স্বামীকে হারিয়ে আমি যে অসহনীয় কষ্ট ও দুঃখের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, আজকের রায়ের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও সেই কষ্ট ভোলার চেষ্টা করব। তিনি জানান, আমারা এখনও হুমকির মধ্যে রয়েছি। নূর হোসেনের সহযোগীরা এখনও এলাকায় রয়েছে। আমাকে কিছুদিন আগেও চিঠির মাধ্যমে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বলা হয়েছিল। এছাড়া আমাদের স্বজনদের বিরুদ্ধে নিহত তাজুলের স্বজনদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে নেয়া হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত রায় কার্যকর না হয় ততদিন পর্যন্ত আমরা আতঙ্কে আছি। সাত খুনের মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ওই ঘটনায় নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ে ডাঃ সুস্মিতা সরকার। এ রায় দ্রুত কার্যকর হবে এমনটাই প্রত্যাশা করেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চাঞ্চল্যকর এই সাত খুনের মামলায় ২৬ জনের মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণার পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আমার বাবা সারাজীবন ন্যায় বিচারের জন্য কাজ করেছেন। আজকে তার আত্মা শান্তি পাবে। আমরা খুশি হয়েছি তবে শান্তি পাব রায় কার্যকর হলে। সুস্মিতা সরকার বলেন, আমার বাবা নিজেদের জন্য না করতে পারলেও অন্যের জন্য সবসময় করতেন। নিজের জীবনটাও অন্যের জন্য দিয়ে তিনি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন। আমার বাবা যখন মারা যায় তখন আমার পরীক্ষা ছিল। আমি একা একা পরীক্ষা দিতে গিয়েছি আমাকে কেউ দিতে যায়নি নিয়ে আসেনি। আমার ছোট বোনকে খুব আদর করতেন বাবা। ও এখনও বিশ্বাস করে বাবা ফিরে আসবে। সুস্মিতা বলেন, বাবা নিজে খেতে না পারলেও অন্যের জন্য খাবার দিতেন। তিনি কখনও ক্রিমিনাল কেস করেননি তবুও তাকেই ক্রিমিনালদের হাতেই মরতে হলো। আমার বাবা ছিলেন একজন অসম্ভব সৎ মানুষ। আমরা তাকে বলতাম আমাদেরই তো নেই তুমি মানুষকে সবকিছু কিভাবে দাও। বাবা বলতেন, আমি যখন না থাকব দেখবে তোমাদেরও কেউ না কেউ সাহায্য করছে। এখন বাবার কথাগুলোর মর্ম বুঝতে পারি। উচ্চ আদালতের প্রতিও আমাদের বিশ্বাস আছে, রায় যেন দ্রুত কার্যকর হয় এটাই এখন আমাদের প্রত্যাশা। আজকের এ দিনের জন্য আইনজীবী, বিচারক, গণমাধ্যমের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি। সাত খুনের ঘটনায় আরেক মামলার বাদী নিহত এ্যাডভোকেট চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল রায় ঘোষণার সময় আদালতে ছিলেন না। যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে তিনি আদালতে আসতে পারেননি। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য ॥ পিপি এ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, নারায়ণগঞ্জের বিচারিক আদালতে একটি নির্ভুল রায় ঘোষণা করা হয়েছে। আমি আশা করি উচ্চ আদালতেও আমরা ন্যায় বিচার পাব। অনেক সুষ্ঠুভাবে বিচার কার্য সম্পাদিত হয়েছে। বিচার চলাকালে আমি কোন ধরনের চাপ অনুভব করি নাই। তিনি বলেন, মামলাটি পরিচালনা করার ক্ষেত্রে যদি কোন চাপ বা তদবির থাকত তাহলে এ মামলাটি ৮ মাসের মধ্যে ১০৬ সাক্ষীর সাক্ষ্য করে যুক্তিতর্ক করে রায়ের পর্যায়ে আনা যেত না। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিচার ব্যবস্থা সর্বোচ্চ ব্যক্তিরা পর্যন্ত ন্যায় বিচারের প্রত্যাশা করেছেন। তিনি আরও বলেন, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ সব আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি বলে আদালত সব আসামিকেই সাজা দিয়েছে। এ রায়ে আমরা খুশি। নারায়ণগঞ্জবাসী তো বটেই, দেশ ও বিশ্ববাসী তাকিয়ে ছিল এ রায়ের প্রতি। আমি মনে করি, মানুষ ও বিচারপ্রার্থীদের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে এ রায়ে। বাদী পক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য ॥ মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী এ্যাডভাকেট সাখাওয়াৎ হোসেন খান বলেন, সাত খুনের নৃশংস ঘটনার পর বিচারের দাবিতে আমরাসহ সাড়া দেশের আইনজীবী ও সাধারণ মানুষ আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। আমরা আইনী লড়াই করেছি। সেসব আন্দোলন ও আইনী লড়াইয়ের শেষে আজ রায় এ রায়ে আমি সন্তুষ্ট। রায় যাতে দ্রুত কার্যকর করা হয় সে দাবি জানাচ্ছি। এ মামলাটিতে যে সাক্ষ্য প্রমাণ এসেছে এর মধ্যে ২১ জন নিজেদের দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে এবং ২২ জন প্রতক্ষদর্শী সাক্ষীসহ অনেক সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছে। ফলে মামলার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। উচ্চাদালতে এ মামলা থেকে আসামিরা রেহাই পাবে বলে আমি মনে করি না। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আইনজীবীদের মিছিল ॥ সাত খুন মামলার রায় ঘোষণার পর পর জেলা আইনজীবী সমিতির উদ্যোগে রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তাৎক্ষণিকভাবে একটি মিছিল বের করেন। মিছিলটি আদালত পাড়ায় প্রদক্ষিণ করেছে। এ সময় সাত খুনে নিহত সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকারের রক্ত বৃথা যেতে দেব না বলে নানা সেøাগান দিতে থাকে। মিছিল শেষে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আনিসুর রহমান দিপু বলেন, আজ সাত খুনের যে রায় হয়েছে এ রায়ে আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ সরকার কোন অপরাধীকে ছাড় দেব না। অপরাধী কত বড় অফিসার, কত বড় কর্মকর্তা, কার ভাই, কার আত্মীয় এটা বিবেচ্য বিষয় নয়। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে যত বড় ভিআইপি অপরাধীই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আসতে হবে এবং ওনার (শেখ হাসিনার) দ্বারাই দেশে ন্যায় বিচার সম্ভব। তা তিনি প্রমাণও করিয়ে দিয়েছেন। উনি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে জনননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এ বিচার কার্যসম্পন্ন করতে যারা সহযোগিতা করেছেন যেমন তদন্তকারী কমকর্তা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সকলের কাছে কৃজ্ঞতা প্রকাশ করছি। দ্রুত রায় কার্যকর চান নারায়ণগঞ্জবাসী ॥ যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদ-ের রায় যেভাবে কার্যকর করা হয়েছে একইভাবে ৭ খুন মামলার দ-প্রাপ্তদের রায় কার্যকর দেখতে চান নারায়ণগঞ্জবাসী। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার রায়কে কেন্দ্র করে সোমবার সকাল থেকেই আদালতের গেটের সামনে ভিড় জমাতে থাকেন উৎসুক জনতা। রায় শোনার পর তারা আনন্দ-উল্লাস শুরু করেন। এ সময় তাদের চোখে-মুখে তৃপ্তির ছাপ ও কণ্ঠে স্বস্তির সুর শোনা যায়। কেরামত আলী বলেন, রায়ে আমরা সবাই খুশি। এটা নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ঘটনা। ওই ঘটনার পর সবাই ছি ছি করেছেন। নূরের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে। এ সময় তিনি যুদ্ধাপরাধীদের মতো ৭ খুনের দ-প্রাপ্তদেরও রায় দ্রুত কার্যকরের আশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, আমরা আশা করব উচ্চ আদালতেও এ রায় বহাল থাকবে। মোঃ আনিছ বলেন, এ রায় শোনার জন্য আজ আমরা এখানে এসেছি। রায়ে আমরা সবাই খুশি। দ্রুত রায় কার্যকর করে নারায়ণগঞ্জবাসীর কলঙ্ক মোচন হবে এমন প্রত্যাশা করেন তিনি। আসামি পক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য ॥ ফাঁসির দ-প্রাপ্ত তারেক সাঈদের আইনজীবী এ্যাডভোকেট সুলতানুজ্জামান বলেন, এ রায়ে আমার আসামি তারেক সাঈদ সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তার পরিবার সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কারণ তিনি মনে করেন মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। তারা এ বিষয়ে উচ্চাদালতে আপীল করবেন। সেখানে তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিকার পাবেন আমি মনে করি। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি নূর হোসেনের আইনজীবী নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট খোকন সাহা বলেন, আমি মনে করি আমার আসামি মামলায় ন্যায্য বিচার পাননি। আমরা উচ্চাদালতে এ বিষয়ে আপীল করব। আপীল করবেন নূর হোসেন, তারেক রানা ও আরিফ ॥ সাত খুন মামলায় মৃত্যুদ- পাওয়া আসামি নূর হোসেন, র‌্যাবের চাকরিচ্যুত র‌্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও এমএম রানা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করবেন বলে জানিয়েছেন তাদের আইনজীবীরা। নূর হোসেনের পক্ষের আইনজীবী মহানগর নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট খোকন সাহা বলেন, ‘এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট না। রায়ের বিরুদ্ধে অচিরেই আমরা উচ্চ আদালতে আপীল করব। আশা করি, উচ্চ আদালতে আমরা ন্যায় বিচার পাব।’ তিনি আরও বলেন, আমিসহ এ্যাডভোকেট সুলতানুজ্জামান ও আব্দুর রশিদ পেশাদার আইনজীবী। আইনকে নিজস্ব গতিতে চলার জন্য আমরা এই মামলায় আসামিদের পক্ষে ছিলাম। আমরা স্বাধীনতাত্তোর অর্ধশতাধিক মামলায় শুনানি করেছি। আমরা প্রমাণ করেছি এই ধরনের চাঞ্চল্যকর মামলায় শুনানি করার জন্য যোগ্যতা সম্পন্ন আইনজীবী নারায়ণগঞ্জে রয়েছে। আসামিরা এই রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকলে উচ্চ আদালতে আপীল এবং লিভ টু আপীল করতে পারবেন। আসামিরা উচ্চ আদালতে আপীল করলে ন্যায় বিচার পাবেন বলে তিনি মনে করেন। র‌্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত মেজর (অব) আরিফ হোসেন ও নূর হোসেনের সহযোগী আবুল বাশারের আইনজীবী নারায়ণগঞ্জ বারের সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট আব্দুর রশিদ বলেন, ৭ খুন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার অনেক ত্রুটি রয়েছে। আসামিরা এই রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকলে উচ্চ আদালতে আপীল এবং লিভ টু আপীল করতে পারবেন। আসামিরা উচ্চ আদালতে আপীল করলে ন্যায় বিচার পাবেন বলে তিনি মনে করেন। তারেক সাঈদের আরেক আইনজীবী শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আবেগতাড়িত হয়ে রায় দিয়েছে। কোন ধরনের প্রমাণ আদালতে হাজির করতে পারেনি। পুলিশ তদন্ত রিপোর্ট দিলেই তো হবে না, সাক্ষ্য দিয়ে প্রমাণ করতে হবে। তারিক সাঈদ (হত্যার) নির্দেশ দিয়েছে এ ধরনের কোন কাগজপত্র বাদীপক্ষ আদালতে হাজির করতে পারেনি।’ বরখাস্ত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানার আইনজীবী অন্যতম রিতা ইসলামও উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা সাংবাদিকদের বলেছেন।
×