ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রধান আসামি নূর হোসেন, সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামির মৃত্যুদ-, বাকি নয় জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা;###;দণ্ডিত ১২ আসামি এখনও পলাতক;###;রায়ের পর সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তারা নির্বিকার ছিলেন, সাজা পেল র‌্যাবের বিপথগামী ২৫ সদস্য

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলার রায় ॥ ২৬ জনের ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলার রায় ॥ ২৬ জনের ফাঁসি

আরাফাত মুন্না/ মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদ- দিয়েছে আদালত। দুই মামলায় ৩৫ আসামির মধ্যে বাকি নয়জনকে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদ-। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন সোমবার সকাল দশটা ৫ মিনিটে জনাকীর্ণ আদালতে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিহতদের স্বজনরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। উচ্চ আদালতেও এ রায় বহাল থাকবে বলে আশা রাষ্ট্রপক্ষের। আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তারা রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপীল করবেন। রায় ঘোষণার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নিহত নজরুল ইসলামের সমর্থক এবং আইনজীবী চন্দন সরকারের সমর্থকরা আদালতের বাইরে উল্লাসে ফেটে পড়েন। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সন্তুষ্ট। কিন্তু আমরা চাই, এই রায় দ্রুত কার্যকর হোক। হাইকোর্টে যাতে এই রায় বহাল থাকে।’ চন্দন সরকারের মেয়ে সুস্মিতা সরকারও রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তিনিও বলেন, আসামিদের সাজা দ্রুত কার্যকর হোক- এটাই তাদের চাওয়া। চন্দন সরকারের পরিবারের হয়ে এ মামলা লড়েন আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘এই রায়ে আমরা আনন্দিত। আমরা খুশি হয়েছি। ৩৫ জন আসামির মধ্যে সবার মৃত্যুদ- হলে আরও বেশি খুশি হতাম।’ তিন বছর আগে নারায়ণগঞ্জে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণের পর নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেয়ার ওই ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দেয়। ওই হত্যাকা-ে এলিট বাহিনী র‌্যাবের কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য বেরিয়ে এলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও শিরোনাম হয়। বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন বহু প্রতীক্ষিত এ মামলার রায় ঘোষণা করতে সময় নেন মাত্র কয়েক মিনিট। আসামিদের সাজার অংশটিই কেবল তিনি পড়ে শোনান। সোমবার সকাল দশটার দিকে এজলাসের সামনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন এবং এম এম রানাকে। আর প্রধান আসামি নূর হোসেনসহ বাকি ২০ জনকে রাখা হয় আদালতকক্ষের ভেতরে গ্রিলঘেরা গারদে। বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন এজলাসে আসেন সকাল ১০টার পর। আসামিদের অপরাধের বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ অংশ বাদ দিয়ে কেবল সাজাপ্রাপ্তদের নাম ও দ-ের পরিমাণ পড়ে শোনান তিনি। রায় ঘোষণা শুরুর আগে বিচারক বলেন, সাত খুনের ঘটনায় দুটি মামলা হলেও রায়ের ফলাফল এক ও অভিন্ন। কেবল একটি মামলায় রায় ঘোষণা করা হলে ‘স্বাভাবিকভাবে’ অন্যটি চলে আসবে। বিচারক বলেন, সাতজনকে অপহরণ, খুন, লাশ গুম, ষড়যন্ত্র ও আলামত নষ্টের অভিযোগ ‘সন্দেহাতীতভাবে’ প্রমাণিত হওয়ায় এ রায় দেয়া হচ্ছে। দ-প্রাপ্ত উপস্থিত ২৩ আসামি হলেন ॥ মামলার প্রধান আসামি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি নূর হোসেন (মৃত্যুদ-), র‌্যাব-১১ এর সাবেক ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ (মৃত্যুদ-), মেজর আরিফ হোসেন (মৃত্যুদ-), লে. কমান্ডার মাসুদ রানা (মৃত্যুদ-), এস আই পূর্ণেন্দু বালা (মৃত্যুদ-), হাবিলদার এমদাদুল হক (মৃত্যুদ-) কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন (মৃত্যুদ-), আরওজি-১ আরিফ হোসেন (মৃত্যুদ-), ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া (মৃত্যুদ-), ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন (মৃত্যুদ-), সিপাহী আবু তৈয়ব (মৃত্যুদ-), আসাদুজ্জামান নূর (মৃত্যুদ-), নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল (মৃত্যদ-), আলী মোহাম্মদ (মৃত্যুদ-), মিজানুর রহমান দীপ (মৃত্যুদন্ড), রহম আলী (মৃত্যুদ-), আবুল বাশার (মৃত্যুদ-), কনস্টেবল বাবুল হাসান (১০বছর), ল্যান্স কপোরার্ল রুহুল আমিন (১০ বছর), সৈনিক নুরুজ্জামান (১০ বছর), আবুল কালাম আজাদ (১০ বছর), এএসআই বজলুর রহমান (৭ বছর) ও হাবিলদার নাসির উদ্দিন (৭ বছর)। দ-প্রাপ্ত পলাতক ১২ আসামিরা হলেন ॥ নূর হোসেনের সহযোগী বর্তমানে ভারতের কারাগারে আটক সেলিম (মৃত্যুদ-), সানাউল্লাহ ওরফে সানা (মৃত্যুদ-), নূর হোসেনের ম্যানেজার শাহ্জাহান (মৃত্যুদ-), জামাল উদ্দিন (মৃত্যুদ-), সার্জেন্ট এনামুল কবীর (মৃত্যুদ-), সৈনিক আব্দুল আলিম (মৃত্যুদ-), সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী (মৃত্যুদ-), সৈনিক আল আমিন শরীফ (মৃত্যুদ-), সৈনিক তাজুল ইসলাম (মৃত্যুদ-), কর্পোরাল মোখলেছুর রহমান (১০ বছর), কনস্টেবল হাবিবুর রহমান (১০ বছর), এএসআই কামাল হোসেন (১০ বছর)। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ, খুন, লাশ গুম, ষড়যন্ত্রের অভিযোগে আদালত রায়ে নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিক মৃত্যুদ- দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে ৭ জনকে ১০ বছরে কারাদ- এবং ২ জন আসামিকে ৭ বছর কারাদ- দিয়েছে আদালত। এ রায়টি একটি যুগান্তকারী রায়। দেশের প্রচলিত আইনের শাসন ও সাংবিধানের উর্ধে কেউ নয়, কারণ যে কোন জায়গা থেকে যে কেউ অপরাধ করুক না কেন তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে দেশের আইনের মাধ্যমে। জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন ২০১৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার আসামিদের বিচার শুরু করেন। ৩৮টি কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে মোট ১৬৪ জনের সাক্ষ্য শুনে আদালত, যাদের মধ্যে ৬০ জন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জবানবন্দী দেন। দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে গত ৩০ নবেম্বর বিচারক ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি রায়ের জন্য দিন ঠিক করে দেন। কঠোর নিরাপত্তা বলয় ॥ বহুল আলোচিত সাত খুন মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সোমবার ভোর থেকেই কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয় নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতপাড়ায়। আলোচিত এ মামলার রায় দেন নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন। রায়কে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে আদালত চত্বর পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা বলয়। আইনজীবীসহ মামলা সংশ্লিষ্ট ছাড়া অন্য কাউকে আদালত চত্বরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। বাইরে নিরাপত্তা চৌকি বসিয়ে সবাইকে তল্লাশি করে ভেতরে ঢোকানো হয়। আদালতে ঢোকার মুখে বসানো হয় আর্চওয়ে, সেখানে সবাইকে তল্লাশি করা হয়। আদালত ভবনের সামনেই প্রস্তুত রাখা হয়েছিল জল কামন ও রায়ট কার। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ শফিউদ্দিন জানান, আদালত এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাঁচ শতাধিক পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। সাইনবোর্ড এলাকা থেকে আদালত চত্বর পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তার বলয় গড়ে তোলা হয়। মৃত্যুদ-ের রায়েও স্বাভাবিক আসামিরা ॥ নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলায় মৃত্যুদ-ের রায় শুনে সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা নির্বিকার ছিলেন। রায়ে নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামিকে মৃত্যুদ-াদেশ দিয়েছেন আদালত। বাকি নয় আসামির সবাইকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় নূর হোসেনসহ ২০ আসামি আদালতে স্থাপিত লোহার খাঁচার (আসামির কাঠগড়া) ভেতরে ছিলেন। আর র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা ছিলেন খাঁচার বাইরে। সকাল ১০টার কিছু পরই রায় ঘোষণা করেন আদালত। সংক্ষিপ্ত রায়ে আসামিদের দ- ঘোষণা করা হয়। রায় শোনার পর নূর হোসেন এবং র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও মাসুদ রানাকে নির্বিকার থাকতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়াই লক্ষ্য করা যায়নি। রায় ঘোষণার পর একপর্যায়ে তারেক সাঈদের সঙ্গে নূর হোসেনকে বেশ স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে দেখা যায়। মৃত্যুদ-ের রায় শোনার পরও গুরুত্বপূর্ণ চার আসামির নির্বিকার থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি এস এম ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, ‘তারা স্বাভাবিক থেকেই প্রমাণ করেছেন, তারা অপরাধী। যারা পেশাদার অপরাধী, তারা মানুষ খুন করেও স্বাভাবিক থাকতে পারেন। হাসি-ঠাট্টা করতে পারেন। র‌্যাবের ২৫ সদস্যের সাজা ॥ হত্যা, গুম, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধে একই মামলায় ২৫ র‌্যাব সদস্যকে সাজা দেয়া হয়। ফৌজদারি অপরাধে একসঙ্গে এত র‌্যাব সদস্যের সাজার ঘটনা এটাই প্রথম। নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলায় র‌্যাবের তিন কর্মকর্তাসহ মোট ৩৫ জনকে সাজা দিয়েছেন আদালত। দ- পাওয়া র‌্যাব ১১ এর ২৫ সদস্য হলেন- র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক মোহাম্মদ সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানা। র‌্যাবের অধিনায়ক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্যে এর আগে চট্টগ্রামের র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক জুলফিকার আলী মজুমদারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে অভিযোগ আনা হয়েছে। তার মামলাটি চট্টগ্রাম আদালতে বিচারাধীন আছে। ২০১১ সালের ৪ নবেম্বর চট্টগ্রামে তালসারা দরবার শরিফের প্রায় ২ কোটি টাকা লুটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বাহিনী থেকে জুলফিকারকে চাকরি হারাতে হয়। গ্রেফতারও করা হয় তাকে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার সাজাপ্রাপ্ত র‌্যাব সদস্যদের মধ্যে ১৭ জন কারাগারে আছেন। তারা হলেন চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মোঃ শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দ বালা, কর্পোরাল রুহুল আমিন, এএসআই বজলুর রহমান, হাবিলদার নাসির উদ্দিন, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, সৈনিক নুরুজ্জামান, কনস্টেবল বাবুল হাসান ও সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর। আর পলাতক আটজন হলেন- কর্পোরাল মোখলেছুর রহমান, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবীর, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান। দ্বিতীয় বৃহত্তম রায় ॥ বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলা ছাড়া এক মামলায় একসঙ্গে ২৬ জনকে ফাঁসি দেয়ার ঘটনাও নিকট অতীতে নেই বলে জানিয়েছেন নিম্ন ও উচ্চ আদালতের কয়েক আইনজীবী। বিডিআর বিদ্রোহের সময় সংঘটিত হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় বিডিআরের তিন শতাধিক সদস্যকে ফাঁসির দ- দেয়া হয়। এছাড়া নাটোরের আওয়ামী লীগ নেতা গামা হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত ২১ জনকে ফাঁসির দ- দেন। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আজ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার জানা মতে, এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রায়। যেখানে ২৬ জনকে ফাঁসির দ- দেয়া হয়েছে।’ সাত খুন ॥ ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়। একই সময়ে একই স্থানে আরেকটি গাড়িতে থাকা নারায়ণগঞ্জ আদালতের প্রবীণ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার চালককে অপহরণ করা হয়। ঘটনার তিন দিন পর বন্দর উপজেলা শান্তির চর এলাকায় শীতলক্ষ্যা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাত জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রত্যেকের পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন; প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। নিহত ৭ জন ॥ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের দুই নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, সিরাজুল ইসলাম লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম। লাশ উদ্ধারের পর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি এবং চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল দুটি মামলা করেন, যার তদন্ত চলে একসঙ্গে। দুই মামলার তদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ ম-ল। যা বলা হয়েছিল অভিযোগপত্রে ॥ অভিযোগপত্রে বলা হয়, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিরোধ থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে হত্যার এই পরিকল্পনা করেন আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে র‌্যাব সদস্যদের দিয়ে ওই হত্যাকা- ঘটানো হয়। অন্যদিকে নজরুলদের অপহরণের বিষয়টি দেখে ফেলায় ঘটনাচক্রে আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ি চালককেও হত্যা করা হয় বলে তার জামাতা বিজয় কুমার পালের ভাষ্য। আসামিদের মধ্যে র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জন এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনের পাঁচ সহযোগীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। ঘটনার ১৭ মাস পর মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। কে এই নূর হোসেন ॥ নূর হোসেন ১৯৮৫ সালে ট্রাকের হেলপার ছিলেন। বছর খানেক হেলপারি করার পর ট্রাক ড্রাইভার বনে যান। ১৯৮৭ সালে তার বাবা বদরুদ্দিন একটি পুরনো ট্রাক কিনলে ওই ট্রাকের চালক হন। ১৯৯২ সালে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন নূর হোসেনসহ ১৩ জন। শক্তিশালী প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান সহিদুল ইসলামকে পরাজিত করতে মাঠে নামেন সাবেক এমপি গিয়াসউদ্দিন। দলবল নিয়ে পক্ষ নেন নূর হোসেনের। দুই-আড়াইশ’ ভোটের ব্যবধানে নূর হোসেন জয়ী হয়। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ১৯৯২ সালে বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিনের আশীর্বাদে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিন বছর বাদে ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে আদমজীতে খালেদা জিয়ার জনসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। প্রভাব বিস্তার করে পুরো সিদ্ধিরগঞ্জে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি প্রার্থী হিসেবে পরবর্তী ইউপি নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন নূর হোসেন। আওয়ামী লীগ থেকে শামীম ওসমান প্রার্থী দেয় নজরুলকে। নূর হোসেন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে গড়ে তুলে নিজস্ব বাহিনী। স্থানীয়দের অভিযোগ, ১৯৯৬ সালের মার্চে শিমরাইল মোড়ে নূর হোসেনের বাহিনীর গুলিতে নিহত হন রিকশাচালক আলী হোসেন। ১৯৯৯ সালের ১ অক্টোবর থানা আওয়ামী লীগ অফিসে নজরুল ইসলামকে হত্যা করতে এসে যুবলীগ নেতা মতিনকে গুলি করে হত্যা করে নূর হোসেন বাহিনী। ২০০১ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় নূর হোসেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের এক নেতার সঙ্গে ভারতে সফল বৈঠকের পর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে ফিরে আসে নূর হোসেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের নেতাদের পেছনে মোটা অংকের টাকা খরচ করে ২০১৩ সালের ২৯ মে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদটি বাগিয়ে নেয়। এরপর নূর হোসেন বেপরোয়া হয়ে উঠে।
×