ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭

মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বিশ্বের দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বে ৪৫তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩৩তম স্থান অধিকার করেছে। বাংলাদেশের এই অগ্রগতি অন্য দেশগুলোর জন্য অনুকরণীয় বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংক বলছে, ‘স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে সংশয়বাদীদের ভুল প্রমাণ করে এসেছে। ১৯৭৪ সালের পর থেকে সেখানে কোন দুর্ভিক্ষ হয়নি। ১৯৯১ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ২০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছে।’ বাংলাদেশ এখন আর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয়, বরং ওই ঝুড়ি এখন পরিপূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছে। এখন আর দুর্ভিক্ষ হয় না, মঙ্গা শব্দটিও নির্বাসিত। অথচ একাত্তরের তুলনায় জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। তবে মাথাপিছু আয় বেড়েছে চার গুণ। হতাশা ছড়াতে ব্যস্ত যারা তাদের হিসাব মেলে না। মানুষের জীবনযাত্রায় এক পরিবর্তন ঘটে গেছে। মানুষ এখন আর কোথাও অলস বসে থাকে না। প্রত্যেকেই কোন না কোন কর্মে লিপ্ত। দেশব্যাপী এ যেন এক অন্যরকম কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। যার ফলে শহর-গ্রামের পার্থক্য অনেকটা কমে যেতে শুরু করেছে। এখন প্রত্যন্ত গ্রামেও বিদ্যুত চলে গেছে। ঘরে ঘরে টিউব লাইট কিংবা এনার্জি লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে প্রতিটি রাত। সেখানেও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাত্রার চিত্র পুরোপুরি পাল্টে গেছে। রঙিন টিভি, ফ্রিজ, খাট-পালঙ্ক থেকে শুরু করে আধুনিক গৃহসজ্জার প্রায় সব সামগ্রীই এসব পরিবারে বিদ্যমান। অনেক প্রয়োজনমতো ইন্টারনেটও ব্যবহার করছে। শতভাগ পরিবারে আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা বিদ্যমান। পরিবারের আকার সীমিত করার জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করা থেকে শুরু করে সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভবিষ্যত পরিকল্পনা সব ক্ষেত্রেই পরিবারগুলো যথেষ্ট সচেতন। উন্নয়নের যে সূচকগুলো সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখে সেগুলো এই সচেতনতার কারণে আমাদের অগ্রগতিতে এক বিরাট ভূমিকা পালন করে চলেছে। দেশ যে এগিয়ে যাচ্ছে প্রান্তিক মানুষের এই জীবনযাত্রার চিত্র দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়। কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। কৃষি জমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন দ্বিগুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ। দুই যুগ আগেও দেশের অর্ধেক এলাকায় একটি ও বাকি এলাকায় দুটি ফসল হতো। বর্তমানে দেশে বছরে গড়ে দুটি ফসল হচ্ছে। সরকারের যুগোপযোগী পরিকল্পনা, পরিশ্রমী কৃষক এবং মেধাবী কৃষি বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রয়াসেই এ সাফল্য। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে ৩ টন ধান উৎপন্ন হতো। এখন হেক্টরপ্রতি উৎপন্ন হচ্ছে ৬ টনের বেশি। তা ছাড়া হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বিশ্বে গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। খাদ্যশস্যে প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৩৪ টন উৎপন্ন করে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের পরে রয়েছে আর্জেন্টিনা, চীন ও ব্রাজিল। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। বর্তমান সরকার আট বছর আগে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে কৃষকের উন্নয়নে কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকিসহ নানা প্রণোদনামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যার ফলে আজকে প্রায় ১৭-১৮ কোটি জনসংখ্যার ভাতের যোগান দিতে এক কেজি চালও আমদানি করতে হয় না। বরং স্বল্প পরিমাণে হলেও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চাল রফতানিকারক দেশের কাতারে নাম লিখিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও বাড়ছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) বেশ কয়েকটি জাত ছাড়াও এরই মধ্যে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) বিজ্ঞানীরা মোট ১৩টি প্রতিকূল পরিবেশে সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এর মধ্যে লবণসহিষ্ণু নয়টি, খরাসহিষ্ণু দুটি ও বন্যাসহিষ্ণু চারটি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন তারা। ২০১৩ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেন বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এত প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড ফসল বিটি বেগুনের চারটি জাত অবমুক্ত করে। যার মধ্যে বেগুনের প্রধান শত্রু ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী জিন প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং মাধ্যমে আলুর নাবি ধসা রোগের প্রতিরোধী জিন প্রতিস্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে। তেরো শ’ নদীর দেশ বাংলাদেশ। এক সময় ‘মাছে-ভাতে বাঙালী’ কথাটি আক্ষরিক অর্থেই প্রযোজ্য ছিল। নদীগুলো মরে যাওয়ায় এ কথাটি বইয়েই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মাছ রফতানি বেড়েছে ১৩৫ গুণ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাছের উৎপাদন ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। জাটকা সংরক্ষণসহ নানা উদ্যোগের ফলে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ৫২ হাজার টন বেড়ে সাড়ে তিন লাখ টন হয়েছে। মাছের দাম সাধারণ ক্রেতার সামর্থ্যরে মধ্যে থাকায় গত দশ বছরে দেশে মাথাপিছু মাছ খাওয়ার পরিমাণ শতভাগ বেড়েছে। দেশের শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে যে সেক্টরটি সেটি হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্প। গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফ ব্লাডে পরিণত হয়েছে। বিশ্বে তৈরি পোশাক রফতানিতে বর্তমানে শীর্ষ রাষ্ট্র চীনের পরেই বাংলাদেশের স্থান। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই বাংলাদেশ প্রথম স্থানটি দখল করতে সক্ষম হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের সর্বমোট প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে এককভাবে শতকরা ৮০ ভাগ অর্জনের পাশাপাশি গার্মেন্টস খাত প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৪০ লক্ষাধিক দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। আর পরোক্ষভাবে আরও এক থেকে দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থানেও ভূমিকা রাখছে এ শিল্প। দেশে যে কয়েকটি শিল্পের নীরব বিপ্লব ঘটেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে সরকারী সহযোগিতা এবং উদ্যোক্তাদের জ্ঞান, পরিশ্রম, বিনিয়োগে উচ্চ ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা এবং আন্তরিক প্রচেষ্টায় এ শিল্প এখন একটি উদাহরণ। তৈরি হয়েছে লাখ লাখ কর্মসংস্থান। সেই সঙ্গে মেধাবী ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়তে পুষ্টির ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। শুধু তাই নয়, দেশ এখন মুরগির ডিম ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশ এখন ওষুধ রফতানিকারক দেশ। রফতানির এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা গেলে আগামীতে বাংলাদেশের ওষুধ খাত তৈরি পোশাক শিল্পের মতো বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের বড় একটি খাত হয়ে উঠবে বলেও আশা করা যাচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, পাবনা, খুলনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ২৬৯টি ছোট-বড় ওষুধ কারখানা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু কারখানা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বমানের ৪২টি ওষুধ কারখানাতে উৎপাদিত কোটি কোটি টাকার ওষুধ আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, জাপান, ইতালি, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ বিশ্বের ৮৭টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এক অন্যরকম কর্মযজ্ঞের পেছনে ছুটছে। সরকার যেমন দারুণ আত্মবিশ্বাসী তেমনি দেশের প্রতিটি কাজপাগল মানুষও আত্মবিশাসী। এই আত্মবিশ্বাসকে জাগিয়ে রাখতে হলে আমাদের সবার সচেতন থাকতে হবে কেউ যেন এই অপার সম্ভাবনা আর অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে। সবার সম্মিলিত কর্ম প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ কয়েক বছরের মধ্যে আগামীর এক উন্নত বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে ঠাঁই নেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। লেখক : সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমকর্মী
×