ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ১৭ জানুয়ারি ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

মাঘের প্রথম সপ্তাহেই ঢাকায় সত্যিকারের শীত পড়া শুরু হলো। দু-তিন দিনের মধ্যে ১২ ডিগ্রিতে নেমে এলো তাপমাত্রা। শৈত্যপ্রবাহের সংবাদ প্রথম পাতায় চলে এসেছে সংবাদপত্রের। এবার পৌষের ঠা-া-গরম ও মাঘের তীব্র শীতে আক্রান্ত হয়ে কাশি শুরু হয়েছে যাদের তাদের বড় অংশ একটু বেশিই কষ্ট পাচ্ছে এবার, আর অসুস্থতা কিছুটা বেশি সময় নেবে বলেই আশঙ্কা। বিশ্ব এজতেমা গত শুক্রবার সকালে তুরাগ তীরে শুরু হয় বিশ্ব এজতেমা। আগামী শুক্রবারেও শুরু হচ্ছে এর দ্বিতীয় আয়োজন। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই টঙ্গীমুখী মুসল্লিদের চাপ ছিল। এবার শুক্রবার সেখানে জুমার নামাজ পড়ার জন্য সেদিন সকাল থেকে আবার জনস্রোত উত্তরমুখী হয়। রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া তিন দিনব্যাপী এজতেমার কারণে আসলে পুরো পাঁচ দিনই রাজধানীবাসীর একটি বড় অংশ কোন না কোনভাবে এটির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এক হিসেবে বলতে পারি, ঢাকা গত সপ্তাহে লাখো নতুন অতিথি পেয়েছে। এই ধারা চলতি সপ্তাহেও বজায় থাকবে। কারণ বিগত কয়েক বছর ধরে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে বিশ্ব এজতেমা। রাজধানীতে গণপরিবহনের স্বল্পতা নিয়ে মহাভোগান্তি থাকে। এজতেমা শুরুর আগের দিনে ও রাতে টঙ্গী অভিমুখে মুসল্লিদের যাত্রা শুরু হয়। ফলে কর্মসূত্রে যেসব নগরবাসী ঘরের বাইরে বেরোন তাদের ঘরে ফেরা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ঢাকার দক্ষিণ প্রান্তে (মতিঝিল ও ধানম-ি রুটে) যেসব কর্মজীবী আসেন উত্তরপ্রান্ত থেকে, কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে গিয়ে পরিবহন সঙ্কটে পড়েন তারা। অধিকাংশ গণপরিবহন তখন মুসল্লিদের পরিবহন করে থাকে, লোকাল গাড়িও সিটিং হয়ে যায়। ফলে দাঁড়িয়ে বা ঝুলে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। এবারও যেভাবেই পারুক মানুষ এজতেমায় যোগ দিয়েছে। প্রশাসন থেকে অবশ্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিছুটা সহযোগিতা দেয়া হয়েছে। একবার আখেরি মোনাজাতের আগের সন্ধ্যায় জনকণ্ঠ ভবন থেকে উত্তরায় ফেরার পথে মহাখালীতে দেখেছি প্রশাসনের পক্ষ থেকে মিনিবাস রাখা ছিল টঙ্গীতে এজতেমায় যোগদানকারীদের জন্য। এবার অবশ্য এমনটা চোখে পড়েনি। এজতেমার সমাবেশ নিয়ে বলতে হবে- এবারও যথারীতি পার্শ্ববর্তী এলাকাজুড়ে বাসাবাড়ি, কলকারখানা, অফিস, দোকান ও যানবাহনের ছাদে অবস্থান নেন মুসল্লিরা। যদ্দুর জানা যায়, ঢাকার রমনা উদ্যানসংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে ১৯৪৬ সালে প্রথম এজতেমার আয়োজন করা হয়। মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৪৮ সালে এজতেমার স্থান পরিবর্তন করে বর্তমান হাজী ক্যাম্পের স্থলে নেয়া হয়। ১৯৫৮ সালে এজতেমা হয় সিদ্ধিরগঞ্জে। মুসল্লি আরও বাড়তে থাকায় সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর তুরাগ তীরের মাঠে এজতেমার স্থান নির্ধারণ করা হয়। সেই মাঠেও স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় গত ৫ বছর ধরে দুই পর্বে এজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বইমেলার আগে ফ্রেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে মাসব্যাপী বইমলো শুরু হয়। মাত্র দু’সপ্তাহ বাকি। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে তার বিপুল বিচিত্র তোড়জোড়। অনেক লেখকেরই নতুন বই বেরিয়ে গেছে, কেউ কেউ প্রকাশনা উৎসবেরও আয়োজন করছেন। এরই নাম আগাম প্রচার, আর প্রবাদ তো রয়েছেইÑ প্রচারে প্রসার বাড়ে। প্রসার কতটুকু বাড়ে জানি না, তবে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। ঢাবি-র বাংলা বিভাগ থেকে ডবল ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া শিক্ষার্থী কর্মজীবনেও সফল হবেন, এমন কোনো কথা নেই। তবে আমাদের বন্ধু কবি মারুফুল ইসলাম হয়েছেন। পঞ্চাশ পেরুনোর আগেই কাস্টমসে কমিশনার, তারপর বায়ান্নোতে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ। কর্মজীবনে লেখার অবকাশ তেমন পাননি, এখন অফুরন্ত অবসর যেন। শুধু লেখা আর লেখা। প্রতি তিন মাসেই একটা করে পা-ুলিপি প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। সেদিন তার এক জোড়া কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ উপলক্ষে আনুষ্ঠানিক আলোচনা ও কবিতাসন্ধ্যার আয়োজন করা হলেও আসলে সেটি ছিল সাহিত্যপ্রেমীদের জমজমাট আড্ডা। মারুফের শিক্ষক ড. আনিসুজ্জামানের নাম ব্যানারে জ্বলজ্বল করলেও আকস্মিক অসুস্থতার কারণে ঢাকা ক্লাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানটিতে তিনি আসতে পারেননি। আলোচক ড. নজরুল ইসলাম সভাপতিত্ব করলেন। কবি আসাদ চৌধুরী সুন্দর বক্তব্য দিলেন। যাহোক, কবিতার ব্যাকরণ মেনেই লিখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন দীর্ঘদেহী সুদর্শন কবি, যদিও মাঝেমধ্যে ছন্দ ভাঙতেও তার ভালো লাগে। ‘সাঁইজি’ বইয়ে গীতলতা ও অন্তমিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ৩৩ সংখ্যক কবিতায় লিখেছেনÑ ‘বাইজি নাচে বাইজি/ ভক্তমাঝে রাজাসনে সাঁইজি’। প্রতিটি কবিতা পড়েই বাস্তবধর্মী ছবি এঁকেছেন শিল্পী পাতায় পাতায়। বহুকাল পর প্রবীণ শিল্পী সৈয়দ এনায়েতের মনোরম ইলাসট্রেশন দেখা গেল। অপর কাব্য ‘শুভসকাল’-এর ‘ব্রাহ্মণবাড়ীয়া’ শীর্ষক কবিতা পড়তে পড়তে অধুনা সাম্প্রদায়িক হামলার ছবি মনের ভেতর ধরা দিচ্ছিলো। মারুফ সে ব্যাপারে সচেতন হয়েও বিশ্বখ্যাত সংগীতজ্ঞদের জন্মভূমি হিসেবে জেলাটির জন্য তার গৌরববোধের বিষয়টি আড়াল করেননি। বলা দরকার, তিনিও একদা ওই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকেই এসেছিলেন ঢাকায়। পার্কে সচেতনতা স্বাস্থ্যসচেতন বহু লোকই পার্কে হাঁটেন। তাদের একটি অংশ অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ। ফেসবুকে রাজধানীবাসীর পার্কে হাঁটা নিয়ে দরকারি এক পোস্ট দিয়েছেন অপর্ণা খান। লেখাটি তুলে দিচ্ছি : ‘রমনা পার্কে হাঁটার অভ্যাস প্রায় একযুগ ধরে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার কয়েকটি দৃশ্য আমাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে, আমি শুধু অসহায়ের মতো দেখেছি কিছু করতে পারিনি, দু’একজন হাঁটতে হাঁটতে অসুস্থ বোধ করে ওই পার্কে মৃত্যুবরণ করেছে। কেউ বা অসুস্থ হয়ে পড়ে গিয়েছে, পরে অন্য লোকজন তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। গত পরশু ঠিক এমনি একটি ঘটনা ঘটেছে। আমার হাঁটা শেষ অপেক্ষা করছি আমার অন্য সঙ্গীদের জন্য, এমনি সময় একজনকে ধরাধরি করে গেটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ভদ্রলোকের মুখ দিয়ে গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। দৃশ্যটি কিছুক্ষণের জন্য আমাদের স্থবির করে দিল। আজ শুনলাম তিনি ভাল আছেন, কিছুটা স্বস্তি পেলাম। ভোরবেলা যারা হাঁটতে যান বেশিরভাগ লোকজন বয়স্ক। অনেক ভিআইপি লোকজন আসেন হাঁটতে। অনেক সময় তাৎক্ষণিক কিছু করা গেলে হয়ত এই অসুস্থ হওয়া মানুষকে মৃত্যু কিংবা খুব বেশি ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানো যেতে পারে। সেজন্য যদি একটি এ্যাম্বুলেন্স বা প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট দেয়ার কোন ব্যবস্থা পার্কের গেটের কাছে করা যেত হয়ত অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো। এ বিষয়টি যারা পার্কে হাঁটেন ভেবে দেখতে পারেন, এবং এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করলে সকলেই উপকৃত হবেন। কে জানে নিয়তি কি নিয়ে বসে আছে আমার জন্য, আপনার জন্য।’ এক উত্তরাবাসীর অভিব্যক্তি উত্তরায় স্কুলছাত্র পিটিয়ে হত্যার ঘটনাটি এলাকাবাসীর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জাগিয়েছে সঙ্গত কারণেই। তবে এক সেক্টরের ঘটনা অন্য সেক্টরের অধিবাসীর মনে অন্য ধরনের প্রতিক্রিয়াও জাগাতে পারে। এক ভদ্রমহিলা যা শোনালেন তার সারমর্ম এ রকম : ‘উত্তরা মডেল টাউন’-এর বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘উত্তরা আদর্শ শহর’-এ ঘটেছে শুক্রবার একটি কুআদর্শিক ঘটনা ... পিটিয়ে মানুষ (কিশোর) হত্যা! কী পৈশাচিক কী নির্মম! আদনান নামের হতভাগ্য কিশোরকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে তার বন্ধু-সহপাঠীরা! ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডে ঘটেছে এই দুষ্কর্ম! উত্তরার ওই সেক্টরে আছে ৩টি পার্ক, একটি মসজিদ। পার্কসংলগ্ন এই ১৭ নম্বর রোডটি দারুণ ছিমছাম। বাড়িগুলো সুদৃশ্য! নিরিবিলি শান্ত একটি পরিবেশ এখানে! শুক্রবার বন্ধের দিন। স্বভাবতই বাড়িগুলোতে নারীর পাশাপাশি পুরুষদেরও থাকার কথা। সন্ধ্যা পৌনে ছ’টায় ঘটা এই দুষ্কর্মকে সামাল দিতে পারে এমন একটি পুরুষ কিংবা নারী কী সেখানে উপস্থিত ছিল না? সেখানে আদৌ কী মানুষ (?) বসবাস করে? আমরা কতটা সমাজ বিচ্ছিন্ন, বিবেক বিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাস করছি তার উদাহরণ এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ জানান দিয়ে গেল! মনুষ্যত্ব থেকে এখন আমাদের অবস্থান... যোজন যোজন দূরে! ইট-কাঠের এই সুরম্য অট্টালিকা মূলত একটি মায়া! এর ভেতরে আসলে বসবাস করছে কেঁচো সম্প্রদায়! কেঁচোর মতো মেরুদণ্ডহীন! ছিঃ!’ অনুসরণীয় ঢাকায় হোন্ডাঅলাদের দৌরাত্ম নিয়ে এর আগেও লিখেছি, পত্র-পত্রিকায় ছবিসহ এসব অনিয়মের খবর ছাপা হয়। তবু অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটেনি। ট্রাফিক পুলিশকে ব্যবস্থা নিতেও তেমন শোনা যায় নি। তীব্র হর্ন দিতে দিতে ফুটপাথের ওপর মোটর সাইকেল তুলে দেয়ার ফলে পথিকদের কী বিপন্ন দশায় পড়তে হয় সে কথা শুধু ভুক্তভোগীই জানেন। প্রধান প্রধান সড়ক ছাড়াও আবাসিক এলাকার ফুটপাথে মোটর সাইকেল আরোহীদের নির্বিচার বেপরোয়া চলাচলে বিরক্ত বিব্রত কোনো কোনো এলাকাবাসী উচিৎ জবাব দেবার পথ বের করেছেন। ফুটপাথের ওপর এমনভাবে প্রতিবন্ধক দিচ্ছেন যাতে সেটি সহজেই পথচারীরা পার হয়ে যেতে পারবেন, কিন্তু আটকা পড়ে যাবে মোটর সাইকেল। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের ফুটপাথকে ছাড় দিয়ে মূল সড়কই ব্যবহার করতে হবে। বিষয়টি অনুসরণীয়, কোনো সন্দেহ নেই। ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ [email protected]
×