ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলার রায় আজ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৬ জানুয়ারি ২০১৭

চাঞ্চল্যকর ৭ খুন মামলার রায় আজ

আরাফাত মুন্না/মোঃ খলিলুর রহমান ॥ নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার রায় ঘোষণা করা হচ্ছে আজ সোমবার। নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন এই রায় ঘোষণা করবেন। এই মামলার সব আসামিরই সর্বোচ্চ শাস্তি চান নিহতদের স্বজন ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও। কেবল নিহতদের স্বজন ও সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা নয়, চাঞ্চল্যকর এই মামলায় কি রায় হয় তা, জানার অপেক্ষায় গোটা দেশ। সাত খুনের ঘটনায় নিহত দুই জনের পরিবারের পক্ষ থেকে দুটি আলাদা মামলা করা হয়েছিল ২০১৪ সালে। এই দুই মামলার বিচার চলে এক সঙ্গে। গত ৩০ নবেম্বর চূড়ান্ত যুক্তিতর্ক শুনে রায়ের দিন ঠিক করেন বিচারক। এদিকে আলোচিত সাত খুন মামলার রায়কে সামনে রেখে নারায়ণগঞ্জে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে জেলা জজ কোর্টে বাড়তি নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে। সোমবার সকাল থেকে নারায়ণগঞ্জ আদালতপাড়া নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার মঈনুল হক। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়। একই সময়ে একই স্থানে আরেকটি গাড়িতে থাকা নারায়ণগঞ্জ আদালতের প্রবীণ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার চালককে অপহরণ করা হয়। ঘটনার তিনদিন পর বন্দর উপজেলা শান্তির চর এলাকায় শীতলক্ষ্যা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাত জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রত্যেকের পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন, প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেখানে চার সহযোগীসহ নজরুল লাশ মেলার পর সেলিনা ইসলাম বিউটি পাঁচজনকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা করেন। সপ্তাহখানেক পর একই অভিযোগে অপর মামলাটি করেন আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। সাত খুনের দুই মামলার তদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ ম-ল। অভিযোগপত্রে বলা হয়, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বিরোধ থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে হত্যার এই পরিকল্পনা করেন আরেক কাউন্সিলর নূর হোসেন। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে র‌্যাব সদস্যদের দিয়ে ওই হত্যাকা- ঘটানো হয়। মামলার আসামিদের মধ্যে র‌্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জন এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনের পাঁচ সহযোগীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। ঘটনার ১৭ মাস পর মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তিনিসহ মোট ২৩ আসামি এ মামলায় কারাগারে রয়েছেন, পলাতক ১২ জনের মধ্যে আটজনই র‌্যাব সদস্য। স্বজনদের বক্তব্য ॥ রায়ের আগের দিন রবিবার নারায়ণগঞ্জের সাবেক প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, অভিযুক্ত র‌্যাব কর্মকর্তাসহ অন্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই তার চাওয়া। তিনি বলেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে আর কেউ এমন সৃশংস হত্যাকা- ঘটাতে সাহস পাবে না। আর কেউ স্বামী হারা হবে না, আর কোন সন্তান বাবা হারা হবে না, আর কোন মায়ের বুক খালি হবে না। আমরা আদালতের কাছে প্রত্যাশা করছি, আসামিদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- দেয়া হয়। কারাগারে থাকা আসামিদের পাশাপাশি পলাতকদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান বিউটি। একটি মামলার বাদী বিজয় পাল বলেন, আমরা আমাদের স্বজনদের হারিয়েছি। যে কোন হত্যাকা-েরই শাস্তি হওয়া উচিত। আমরা চাই, যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- হোক। একজন ‘ভাল নাগরিক’ হিসেবে চন্দন সরকারের ‘সুনাম ছিল’ মন্তব্য করে তার জামাতা বলেন, যত দূর জানতে পেরেছি, তার সামনে একটা ঘটনা ঘটছিল, তিনি সেটার প্রতিবাদ করতে গিয়েই হত্যার শিকার হন। আদালতের উচিত, এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যেন কেউ আর এ ধরনের হত্যাকা- ঘটানোর চিন্তাও করতে না পারে, বলেন বিজয়। কারাগারে ২৩ আসামি ॥ ৩৫ আসামির মধ্যে ২৩ আসামি কারাগারে রয়েছেন। এরা হলেনÑ নূর হোসেন, লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মোঃ শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্নেন্দ বালা, কর্পোরাল রুহুল আমিন, এএসআই বজলুর রহমান, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, হাবিলদার নাসির উদ্দিন, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, সৈনিক নুরুজ্জামান, কনস্টেবল বাবুল হাসান, সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল। পলাতক ১২ আসামি ॥ এই দুই মামলার ১২ আসামি এখনও পলাতক রয়েছেন। এরা হলেনÑ কর্পোরাল মোঃ মোখলেছুর রহমান, সৈনিক আব্দুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবীর, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান, নূর হোসেনের সহযোগী সেলিম, সানাউল্লাহ ছানা, ম্যানেজার শাহজাহান, ম্যানেজার জামাল উদ্দিন। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান এ্যাটর্নি জেনারেল ॥ নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনকে পরিকল্পিত হত্যাকা- উল্লেখ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রবিবার নিজের কার্যালয়ে সুপ্রীমকোর্টের বিভিন্ন মামলার বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, এ ঘটনায় জনগণ একটি রায় চায় এবং দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। আমিও এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। দেশবাসীর সঙ্গে আমিও সে প্রত্যাশা করছি। এটি পরিকল্পিত হত্যাকা-। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য ॥ এদিকে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট ওঢয়াজেদ আলী খোকন জানান, সাত খুন মামলায় ১২৭ সাক্ষীর মধ্যে ১০৭ জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছে। ২৩ আসামির মধ্যে ২১ জন দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। আদালতে এই মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ ও যুক্তিতর্ক সম্পন্ন হয়েছে। আমরা আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যাকা-ের জড়িত থাকার প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- দাবি করেছি আদালতে। আশা করি আদালত থেকে নিহতদের স্বজন, দেশবাসী, ন্যায় বিচার ও সন্তোষজনক রায় পাবে। বাদী পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আদালতে ৭ হত্যার বিষয়ে প্রয়োজনীয় সাক্ষী ও প্রমাণ দাখিল করা হয়েছে। আদালতের কাছে হত্যাকা-ে নূর হোসেন ও র‌্যাব সতসদ্যরা যে জড়িত তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে, ডকুমেন্টসহ উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি জানান, প্রত্যেক আসামির সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসি হবে আশা করেন। আদালতপাড়ার নিরাপত্তায় ৫শ’ পুলিশ ॥ চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে জেলা পুলিশ। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সাপার মঈনুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, রায় উপলক্ষে নিরাপত্তার দায়িত্বে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশসহ পোশাকে প্রায় ৫শ’ পুলিশ নিয়োজিত থাকবে। এ লক্ষ্যে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে আসামিদের যাতায়াতের রাস্তা (ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্করোড) এবং সাত খুনের ঘটনায় নিহত পরিবারগুলোর স্বজনদের নিরাপত্তার বিষয়টিও থাকবে। যাতায়াতের জন্য ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা রাখা হবে। তিনি বলেন, রায় থেকে শুরু করে পরবর্তী সব প্রক্রিয়াগুলো যেন শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হয় সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে। তিনি আরও বলেন, সার্বিকভাবে নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস অত্যন্ত নিরাপদেই বিচার কার্যটি সম্পন্ন হবে। আসামি ও সাত খুনে নিহত স্বজনারাও যাতে নিরাপদে আসা-যাওয়া করতে পারেন সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে বলে জানান পুলিশ সুপার।
×