আজ হঠাৎ করে দেশবরেণ্য দু’জন প্রয়াত গুণী শিল্পীর কথা লিখতে ইচ্ছা করল। নাম পরে বলছি। ১৯৮২ সালের জুন মাসে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে আমার গানের অডিশনের ডাক পড়ল। আমি তখন চট্টগ্রাম বেতারের নিয়মিত ‘সি’ গ্রেডের আধুনিক ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিল্পী ছিলাম। ১৯৭৩ সাল থেকে এ কেন্দ্রে নিয়মিত গান গাইছি। কিন্তু ঢাকা বেতারে তালিকাভুক্ত নই বলে ওখানে গান গাইতে পারছিলাম না। তাই আমি শাহাবাগে ঢাকা বেতারে অডিশন দিতে এসেছি। স্টুডিওতে ঢুকে সামনে তবলাবাদক ছাড়া আর কাউকে চোখে দেখতে পেলাম না। মাইক্রোফোনের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো গান করার জন্য। তানপুরাটা সুরে বাঁধার কথা বলে একটু সময় চেয়ে নিয়ে গান ধরলাম। টপ্পা ‘সকল জনম ভরে ওমোর দরদিয়া...’। অর্ধেক শোনানোর পর মাইক্রোফোনে নির্দেশ এলো একটা তালের গান গাইতে। গাইলাম ‘আমার না বলা বাণীর...’ অর্ধেক গাওয়া শেষ হতেই বলল ঠিক আছে।
আমি পাস করেছি কি করি নাই এই ভয় নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখি আমার সামনে দু’জন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞাসা করলেন কার কাছে গান শিখেছো? উত্তরে বললাম, শান্তি নিকেতন থেকে এম মিউজ করে এসেছি। মোহরদি (কণিকা বন্দ্যেপাধ্যায়) নিলিমা সেন উনাদের কাছে গান শিখেছি। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে কাঠ। পরের প্রশ্ন, আমাদের চিনতে পেরেছো? আমি বললাম না। তারা আমার কথা শুনে অবাক। চট্টগ্রাম থেকে ভারতে চলে যাওয়ায় এবং দীর্ঘদিন সেখানে থাকার কারণে তখনকার ঢাকার নামী-দামী শিল্পীদের চেহারা আমার মানসপটে ছিল না।
তারা নাম বললেন, আমি অজিত রায়, আর উনি ‘আবদুল আহাদ’। আমি খুব ভয়ে ভয়ে বললাম, আসলে আমি চিনতে পারিনি, আমায় মাফ করবেন। বলে সঙ্গে সঙ্গে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, কোথাও গান কর? বললাম, চট্টগ্রাম বেতারে সি গ্রেডের শিল্পী ৭৩ সাল থেকে। উনারা দুজনেই একসঙ্গে বললেন- আমরা তোমার গান শুনে খুশি। এখানে আমরা একটি গ্রেড উচ্চতর করে তোমাকে ‘বি’ গ্রেড করে দিলাম এবং সামনের মাস থেকে নিয়মিত প্রোগ্রাম পাবে।
আমি অবাক হয়ে নীরব ভাষা নিয়ে ফিরে চলে আসি। ঠিক একমাস পর প্রোগ্রামের চিঠি পাই। এই দুজন গুণী শিল্পীকে আমি শ্রদ্ধাভরে অন্তর থেকে ম্মরণ করছি। বলতে হয়, এখন কি সে রকম বিচারক আছেন? এখনকার নিয়ম তো, অডিশনে টিকতে হলে হতে হবে ছাত্রছাত্রী, নয়ত বিশেষ পরিচয়ের মাধ্যম অথবা ক্ষমতা বা অন্যকিছু। আমি প্রচারে আগ্রহী নই। ইদানীং অনুষ্ঠান দেখে দুজন শ্রদ্ধাভাজনীয় গুণী শিল্পীর কথা খুব মনে হলো। আজকাল কেউ আর তাদের কথা স্মরণ করে না। অজিতদা, আহাদ ভাই, আমি কিছু করতে না পারলেও সবসময় আপনাদের মনে রাখব, স্মরণ করব মনেপ্রাণে সেদিনের প্রাপ্যতার কথা।
গুণী শিল্পীদের সান্নিধ্য পাওয়ার পর তাঁদের একটু একটু করে স্মরণ না করলে একদিন একটা প্রজম্মের কাছে তারা হয়ত হারিয়ে যাবে। নিজের অনুভূতি থেকে মনের ভাব প্রকাশসহ ব্যক্তিগত কিছু সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে, গুণী দুই শিল্পী আহাদ ভাই ও অজিতদাকে স্মরণ করা।
আহাদ ভাই ও অজিতদার কথা আমি যতটুকুন জানি তা স্বল্প পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। গুণীজন সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ভুল কিছু হয়ে থাকলে তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
প্রয়াত শিল্পী আবদুল আহাদ (আহাদ ভাই) ১৯২০ সালে রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রথম বাঙালী মুসলিম সন্তান যিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। শান্তিনিকেতনে তিনি মোহরদির সঙ্গে একসঙ্গে গান শিখেছেন বলেও আমি জেনেছি। কলকাতার এইচএমডিতে যোগদানের পর এক সময় তিনি বিখ্যাত সুরকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। দেশ ভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন এবং রেডিও পাকিস্তানে যোগদান করেন। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর তিনি একজন জনপ্রিয় সুরকার, সঙ্গীতশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি সঙ্গীত বিষয়ে বইও রচনা করেছেন। ১৯৭৮ সালে তিনি স্বাধীনতা পদক লাভ করেন। ১৯৯৪ সালে ৭৩ বছর বয়সে তিনি সকলকে ছেড়ে চিরবিদায় নেন।
প্রয়াত শিল্পী অজিত রায় (অজিতদা) ২৯ জুন ১৯৩৮ সালে কুড়িগ্রামে এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের কাছেই তাঁর গান শেখা শুরু হয়। তিনি ১৯৬০ সালে ঢাকায় এসে রেডিও ও পরবর্তীতে টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত হন। সঙ্গীত জগতে তার অবদানের কথা লিখে শেষ করা যাবে না।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর পরিচালিত গানের মধ্যে জাতীয় সঙ্গীত- ‘আমার সোনার বাংলা..., জাগো অনশন বন্দী ওঠোরে যত..., উল্লেখযোগ্য। সুর করেছেন অগণিত গান। যেমন- ‘আমি যুগে যুগে আসিয়াছি..., স্বাধীনস্বাধীন দিকে দিকে..., একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতা..., হে মহামানব একবার এসো ফিরে... প্রভৃতি গানের সুর করেছেন তিনি। স্বাধীনতার পর তিনি জীবন থেকে নেয়া, যে আগুনে পুড়ি, কোথায় যেন দেখেছি ইত্যাদি সিনেমায় গান করেছেন।
তিনি সুরুজ মিয়া নাটকে অভিনয়ও করেছেন। এসব অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। যেমন, স্বাধীনতা পদক, গুণীজন পদক, বেগম রোকেয়া পদক, রবীরশ্মী পদক ইত্যাদি। তিনি ১৯৯৬ সালে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং ২০১১ সালে ৭৩ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
একদিন জাদুঘরের নিচতলার অডিটরিয়ামে আহাদ ভাইয়ের স্মরণসভা হচ্ছে। সেখানে কয়েকজন শিল্পীর মাঝে আমিও আছি। সঙ্গে অজিতদাও আছেন। হঠাৎ আমি অজিতদাকে বললাম, ‘দাদা রেডিওতে অডিশনের সেই গল্পটা বলে আহাদ ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই? তিনি হেসে উত্তরে বললেন, ‘আমি মরে গেলে কথাটা একসঙ্গে বলো’। সত্যি একদিন অজিতদাও চলে গেলেন, স্মরণ সভায় গেলেও কথাটা আর বলতে পারিনি। তবে একটা বিষয় হচ্ছে তিনি যখন সরকারী বাসায় থাকতেন সেটা ছিল আমার বাসার বিপরীতে। মাঝেমধ্যে গিয়ে চা নাস্তা খেয়ে অনেক গল্প করতাম। এরপর তিনি চাকরি থেকে অবসরে যাবার পর বাসা নিলেন আমাদের কলোনিতে পাশের বিল্ডিংয়ে। এখনও এই কলোনিতে তাঁর পরিবার বসবাস করছে। যেহেতু দাদার মেয়ের বিয়ে চট্টগ্রামের ছেলের সঙ্গে, বিয়ের অনেক কিছুতে আমি জড়িয়ে গেলাম। আমার বাবা-মারা যাবার পর চট্টগ্রামে বাবার স্মরণ সভায় অজিতদা, সাদী মোহম্মদ, রোকাইয়া হাসিনাকে নিয়ে গিয়েছিলাম গান গাইতে। তিনজনই খুব জমিয়ে ছিলেন। দাদার কাছে আমার অনুরোধ ছিল- ‘হে বঙ্গভা-ারে তব বিবিধ রতন’ গাওয়ার জন্য। আর আমার বাবা সাদীর একটা গান খুব পছন্দ করতেন, ‘না বাঁচাবে আমায় যদি মারবি কেন তবে...’। অনেক গানের মধ্যে এগুলোও গাওয়া হয়েছিল। অজিতদা আমাদের অনুরোধে আমাদের কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেটের পহেলা বৈশাখের কয়েকটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। এখানে দাদার সঙ্গে দ্বৈত গান গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমরা গেয়েছিলাম, ‘ও আমার দেশের মাটি..., পুরনো সেই দিনের কথা...। আমাকে অবশ্যই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি বলতে হবে। তবে পরিতাপের বিষয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী, সুরকার, পরিচালকদের সঙ্গীত জগতে তাঁদের নিরলস পরিশ্রম, অবদান একদিন হারিয়ে যাবে। আগামী প্রজন্ম জানবে না তাঁদের অবদানের কথা, কেউ তাদের কথা মনে রাখবে না। তাই আমাদের জাতীয় প্রচার মাধ্যম বিটিভির কাছে আমার অনুরোধ, এই গুণী শিল্পীদের গানগুলো অন্তত মাসে একবার প্রচারের ব্যবস্থা করার জন্য। তাহলেই আমরা আবার ফিরে পাব আমাদের এই গুণী শিল্পীদের তারা বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে।
লেখক : রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী