ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জাকারিয়া স্বপন

একটা লাইন এখনও ঠিক করতে পারল না বাংলাদেশ!

প্রকাশিত: ০৩:২৯, ১৬ জানুয়ারি ২০১৭

একটা লাইন এখনও ঠিক করতে পারল না বাংলাদেশ!

৭ জানুয়ারি, ২০১৭। ঢাকা বিমানবন্দরে নেমেই দেখি হুলস্থুল ব্যাপার। বিমানবন্দরে এটা যে প্রথম দেখলাম তা নয়। আগে অবস্থা আরও খারাপ ছিল। প্লেন থেকে নামার উপায় থাকত না, বিশেষ কিছু কর্মকর্তা প্লেনের গেট থেকে কাউকে রিসিভ করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন। কেউ কেউ নামের প্ল্যাকার্ড হাতে। এগুলো সাধারণত বিমানবন্দরের যাত্রীদের আগমন হলের সামনে থাকে। কোন অপরিচিত যাত্রীকে কেউ নিতে এলে তারা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন, যেন যাত্রী তাকে খুঁজে পান। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা নয়। বাংলাদেশের মানুষ প্লেনের গেট পর্যন্ত চলে যান। কারণ, তারা দেখাতে চান তাদের ক্ষমতা আছে। নিরাপত্তা কিংবা অন্য প্রটোকলগুলোকে তারা থোরাই কেয়ার করেন। একটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন এমন হয়, তখন সেই বিমানবন্দর এবং দেশ সম্পর্কে একটা ধারণা তো হয়েই যায়। তবে এই যন্ত্রণা অনেক কমেছে। এখন প্লেনের গেট পর্যন্ত খুব একটা দেখা যায় না, ভিভিআইপি ছাড়া। তাদের অভ্যর্থনা দেয়ার জন্য প্লেনের দরজা পর্যন্ত না গেলে তারা মাইন্ড করতে পারেন। তাই প্রটোকল অফিসাররা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। সাধারণ যাত্রীদের কারও কারও দরজা থেকে নিয়ে যাওয়ার বাড়তি আদরের পরিমাণ বেশ কমেছে। পাশাপাশি বিমানবন্দরের আয়তন অনেকটা বেড়েছে। এখন যাত্রীদের লবি দিয়ে হেঁটে যাওয়ার জায়গাটায় এসে এই মানুষগুলো ভিড় করে। তারা এখন দরজা পর্যন্ত যায় না; তবে লবি থেকে পিক করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিভিল এ্যাভিয়েশনের ব্যাজ পরিহিত কর্মকর্তারাই এমন প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমার ধারণা, এর বড় একটি অংশ স্মাগলিংয়ের সঙ্গে জড়িত। নইলে এমন বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে কেন? পৃথিবীর বড় অনেক বিমানবন্দর ঘুরেছি। এমন অভ্যর্থনার মুখোমুখি কখনও পড়তে হয়নি, যা বাংলাদেশে ভ্রমণ করলে হরহামেশাই পড়তে হয়। অন্য যাত্রীদের যন্ত্রণা না দিয়ে সবাইকে কিভাবে দ্রুত বিমানবন্দর থেকে বের করে দেয়া যায়, সেটাই একটি বিমানবন্দরের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। লম্বা ভ্রমণের পর মানুষকে বাড়তি সময় আটকে রাখার কোন অর্থ হতে পারে না। এটা নেহাতই খারাপ ব্যবস্থাপনা। প্লেনের দরজা থেকে মানুষ টানাটানির পরিমাণ একটু কমলেও ইমিগ্রেশন কাউন্টারের অবস্থা সেই আগের মতোই রয়েছে। বিমানবন্দরের ক্ষমতা যেহেতু বেড়েছে, মানুষ বেড়েছে, তাই প্রতি মুহূর্তেই হয়ত একাধিক উড়োজাহাজ অবতরণ করছে। একটি উড়োজাহাজে দুই থেকে তিন শতাধিক যাত্রী থাকতে পারে (নির্ভর করে কত বড় উড়োজাহাজ)। তাই একসঙ্গে দুটি উড়োজাহাজের যাত্রীরা চলে এলে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের মাথা নষ্ট হয়ে যায়। তারা কিভাবে এই পরিমাণ যাত্রীকে সামাল দেবেন বুঝে উঠতে পারেন না এবং বিরক্তিকর বিষয়গুলো ঘটতে থাকে এখানেই। বিদেশী যাত্রীরা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও আমাদের দেশের যাত্রীরা লাইনে থাকেন না এবং পুলিশ অফিসাররাও সেটা ম্যানেজ করতে পারেন না; ক্ষেত্রবিশেষে তারাই এই অনিয়মটা করেন। তারা বিভিন্ন পরিচিত যাত্রীকে (কিংবা যাদের পরিচিত অফিসার রয়েছেন) আগে বের করে দেয়ার জন্য লাইন ভাঙ্গেন। তারা পাসপোর্ট হাতে নিয়ে এই কাউন্টার থেকে ওই কাউন্টারে দৌড়ঝাঁপ করেন। আগে আসা যাত্রীর মাথার ওপর দিয়ে তারা ওই পাসপোর্টগুলো নিয়ে টানাটানি করেন। বাংলাদেশে বিদেশীদের আসা-যাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। তাদের জন্য ভিন্ন লাইন করা হয়েছে অনেক দিন থেকেই। এখন হয়ত সেই লাইনের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তারপরেও তাদের দাঁড় করিয়ে রেখে, আমাদের অন্য যাত্রীদের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে রেখে একদল অফিসার কেন লাইন ভেঙ্গে অন্যদের পাসপোর্ট নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেন? যেই যাত্রী চার থেকে চৌদ্দ ঘণ্টা যাত্রা করে এখানে আসতে পেরেছেন, তারা স্বাভাবিকভাবে ইমিগ্রেশন পার হতে পারেন না? আর তারা যদি ভিভিআইপি হন তাহলে তাদের জন্য আলাদা প্রটোকল রয়েছে। সেটা মানলেই তো হয়। আমরা কেন একটি সুন্দর সুস্থ লাইন মানতে পারি না? ॥ দুই ॥ এবার বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি ইমিগ্রেশনের জন্য ফরম পূরণ করব। তখন লাইনে দাঁড়াইনি। দূরের পিলারের সঙ্গে লাগানো কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ফরমটি পূরণ করছি। অমনি একজন যাত্রী এসে বললেন, ভাই আমার এই ফরমটা একটু পূরণ করে দেবেন? ইমিগ্রেশন ফরম পূরণ করতে তেমন সময় লাগে না। তবে লাইনে যেহেতু দাঁড়াতে হবে, তাই তাড়া থাকে। নইলে অনেক লম্বা সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। সেই অপেক্ষার খারাপ লাগার চেয়ে অনেক কষ্টের যখন একজন মানুষ এসে বলে ফরমটি পূরণ করে দেবেন? কারণ, তার অক্ষরজ্ঞান নেই; কিন্তু তিনি উড়োজাহাজে ভ্রমণ করেছেন। আমাদের লাখ লাখ মানুষ আছেন যারা প্রবাসে কাজ করতে যান; কিন্তু ফরম পূরণ করতে পারেন না। আমি মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই তাদের ফরম পূরণ করে দেই। হাতে সময় থাকলে, কিংবা উড়োজাহাজ ছাড়ার তাড়া না থাকলে, এটা করতে আমার খারাপ লাগে না। আমি একা ছিলাম। তাই তাড়া নেই। মুচকি হেসে ভদ্রলোককে বললাম, একটু অপেক্ষা করুন, আমি আমার ফরমটা শেষ করে নেই। ভদ্রলোক অপেক্ষা করলেন। আমি আমার ফরমটা পূরণ করে তাকে বললাম, দিন এবার। তিনি আমার হাতে যেটা ধরিয়ে দিলেন সেটা ইমিগ্রেশন ফরম নয়। একটা দুই পৃষ্ঠার বড় বিশেষ ফরম যা তাকে পূরণ করতে হবে। আমি এর কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তাকে বললাম, এটা কিসের ফরম? তিনি বললেন, সৌদি থেকে আসছি তো। এইডা ধরায় দিছে। আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। আমার মতোই বয়স হবে। আরেকটু বেশিও হতে পারে। চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। পোশাক এলোমেলো। আমি ফরমটা পড়তে শুরু করলাম। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন, বেশি কিছু না লিখলেও হবে। এখানে যা আছে ওইডাই ইংরেজীতে লেইখ্যা দেন। তিনি আরেকটি কাগজ আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি তাকে বললাম, ব্যাপারটা কি আমাকে খুলে বলেন তো? তিনি যা বললেন তার সংক্ষেপ হলো, তিনি সৌদি আরবে থাকতেন। সেই দেশে তার কাজের ভিসা (আকামা) ছিল না। সৌদি সরকার তাকে ধরে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। তার সঙ্গে পাসপোর্ট নেই। ওই ডকুমেন্টটাই ট্রাভেল ডকুমেন্ট। বাংলাদেশে আসার পর সরকার তার কিছু পেপারওয়ার্ক করছে। বিষয়টি কিছুটা বুঝতে পেরে আমি ফরমটি পূরণ করতে শুরু করি। আমাকে পূরণ করতে দেখে ভদ্রলোককে ঘিরে আরও কিছু মানুষ ভিড় করছেন। আমি সৌদি সরকারের দেয়া ডকুমেন্টটি দেখে দেখে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া ফরমটি পূরণ করছিলাম। ওখানে বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন। কিভাবে বিদেশে গিয়েছিলেন, সেই ট্রাভেল এজেন্টের নাম-ঠিকানা, কোন্ ভিসায় গিয়েছিলেন, বাংলাদেশে যোগাযোগ ইত্যাদি। একটি ঘরে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, কত দিন জেলে ছিলেন? আমি এক ঘর বাদ দিয়ে পরের ঘরে চলে গিয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ কী মনে করে একটু আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে জেলে থাকার কথা জানতে চাইছে। আপনি কি জেলে ছিলেন? তিনি মুচকি হেসে বললেন, হ। আমাগো ধইরা জেলে রাখছিল। আমি ১০ দিন জেলে আছিলাম। এটা লেইখ্যা দেন। কথাটা শুনে মুহূর্তেই আমার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বিদেশ-বিভুঁইয়ে আমার দেশের একজন মানুষ কাজ করতে গিয়ে জেল খেটে আবার দেশে ফিরেছেন এটা ভেবেই ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। আমি কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে রেখে পুরো ফরমটি পূরণ করে দিয়ে বললাম, এখানে সই করেন। আমি কলম এগিয়ে দিলাম। তিনি খুব কষ্ট করে নামের কিছুটা লিখতে পারলেন। তার হাত থেকে কলমটা নিতে গিয়ে দেখি চারপাশে আমাকে ঘিরে ধরেছে। সবার হাতেই একই ফরম। আমার বুঝতে বাকি থাকল না, এই মানুষগুলো কিভাবে দেশে ফিরে এসেছেন। তাদের অনুরোধ, কেউ তাদের ফরমটি পূরণ করে দিচ্ছে না। এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলেন। আমি যদি দয়া করে পূরণ করে দেই, তাহলে তারা মুক্তি পেতে পারেন। আমি তাদের মুখের দিকে তাকাই। এলোমেলো উষ্কখুষ্ক মানুষগুলো আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, এই ফরমটা যারা দিয়েছেন তারা কেউ একটু সাহায্য করছেন না? তারা বললেন, নাহ্। আমাগো পূরণ করতে কইছে। এইগুলো কি আমরা বুঝি? আপনি একটু কইরা দ্যান। আর কেউ রাজি হইতাছে না। আমি খুব কঠিন বিষয়েও নিজেকে শক্ত রাখতে পারি। কিন্তু ছোটখাটো বিষয় আমাকে দুর্বল করে ফেলে। সৌদি ফেরত এই অসহায় মানুষের আকুতি আমাকে দুর্বল করে ফেলল। আমি একের পর এক ফর্ম পূরণ করতে শুরু করলাম। পাশের টেবিলে আরেকজন মানুষকে দেখলাম এগিয়ে আসতে। সৌদি ফেরত মানুষগুলো তাকেও ঘিরে ধরেছে। ফরমগুলো পূরণ করতে গিয়ে দেখলাম, সৌদি সরকার তাদের ধরে কোনরকমে কিছু তথ্য দিয়ে ইংরেজীতে সেগুলো হাতে লিখে উড়োজাহাজে তুলে দিয়েছে। কারও যেহেতু পাসপোর্ট নেই, তাই সঠিক নাম, জন্মতারিখ এগুলো নেই। যে যার মতো বলেছে, তারাও লিখে দিয়েছে। অনেক মানুষের বয়স দেখলাম ৫২। অনেকেই সিলেটের, কেউ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার, কেউ চট্টগ্রামের, কেউ ফেনী, কেউ হবিগঞ্জে প্রভৃতি জেলার। তারা সবাই জেলে ছিলেন। কেউ ১০, কেউ ১৩ দিন, কেউ হয়ত আরও বেশি। একসঙ্গে পঞ্চাশের অধিককে দেশে পাঠানো হয়েছে। তাদের মতে, এমন আরও এসেছে এবং আসতে থাকবে। ধরা পড়লেই দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা গিয়েছিলেন কিভাবে? বেশিরভাগেরই উত্তর হলো, ওমরা করতে গিয়েছিলেন; তারপর থেকে গিয়েছেন। কেউ থেকেছেন ৩ বছর, কেউ ৫ বছর, কেউ আরও বেশি। ভদ্রতা করে আর জিজ্ঞেস করতে পারিনি, তারা যে টাকার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন সেই টাকা আয় করতে পেরেছেন কি না! আমার লাগেজ বেল্টে ঘুরছে। সঙ্গে আমার মাথাও। আমাদের লাখ লাখ মানুষ প্রবাসে কাজ করতে গিয়েছেন। তারা এই দেশের মানুষ। এই দেশের মাটির ওপর তার পূর্ণ অধিকার আছে। এই দেশের আলো-বাতাসের ওপর তার অধিকার আছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে এদের টাকায়, এদের ঘামে ঝরা পরিশ্রমে। কিন্তু এদের এক পৃষ্ঠার একটা ফরম পূরণ করার জন্য কেউ নেই! দূর থেকে দেখে মনে হবে, ভেড়ার পালের মতো এদিক থেকে ওদিক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছি তাদের। প্রবাসী শ্রমিকদের দেখভাল করার জন্য এ দেশে কেউ নেই, কেউ না। আমি যখন ইমিগ্রেশন দিয়ে বাইরে হেঁটে আসি, পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি পুরো এলাকাটি এলোমেলো; আর কাউন্টারের পুলিশ অফিসারদের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে। কিছু অফিসার সেই লাইন ভেঙ্গে কারও কারও পাসপার্ট হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারাই এই দেশের সৌভাগ্যবান নাগরিক। তাদের পরিবার নিশ্চয়ই এই দেশের জমিদার ছিলেন। ॥ তিন ॥ ১৩ জানুয়ারি, ২০১৭ শুক্রবার। আবার যেতে হলো ঢাকা বিমানবন্দরে। ছোট বোন ডালাসে ফেরত যাচ্ছে। তাকে বিদায় দিতে গেলাম। বিশ্ব এজতেমা শুরু হয়েছে। তাই একটু আগেভাগেই গেলাম। এবারে গিয়ে দেখি যাত্রীদের ড্রপ করার বাইরের যে স্থানটুকু আছে সেখানেই এলাহি কা-। বিমানবন্দরের বাইরে এমনিতেই মানুষ গিজগিজ করতে থাকে। নিরাপত্তা প্রহরীরা দোতলায় বেশি মানুষ প্রবেশ করতে দেয় না। আগে টিকেট কেটে একদম ভেতরে যাওয়া যেত। এখন নিরাপত্তাজনিত কারণে সেটুকু করা যায় না। সেটা ভালই হয়েছে। ভেতরে গিয়ে ভিড় করার প্রয়োজনটা কি? কিন্তু এবারে দেখলাম দোতলায় ড্রপ করার জায়গাটাতেই প্রচ- ভিড়। হয়ত অনেক ফ্লাইট একসঙ্গে যাবে। যাত্রীরা বিশাল লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। এমনকি ট্রলি পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। টার্মিনাল ১ এবং ২ দুটোতেই প্রচ- ভিড়। গাড়ি থেকে লাগেজ নামিয়ে একটা লাইনে দাঁড়ালাম। ধীরগতির লাইন। নিরাপত্তাবলয় পার হয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছেন যাত্রীরা। যাত্রীদের বাইরে আর কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। খুবই ভাল উদ্যোগ। কিন্তু মুহূর্তেই খেয়াল করলাম, কিছু মানুষ সেই লাইনের তোয়াক্কা করছেন না। তারা গাড়ি থেকে নেমে বিভিন্ন উপায়ে, একে ধরে, তাকে বলে লাইনের সামনে ঢুকে যাচ্ছেন, নইলে দরজা দিয়ে ভেতরেই চলে যাচ্ছেন। খুবই বিরক্তিকর একটি বিষয়। বিমানবন্দর হলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্থান। বাসস্ট্যান্ড, ট্রেন স্টেশন, কনসার্ট ইত্যাদি স্থানে মানুষ লাইন দিয়ে কাজ করে। কিন্তু বিমানবন্দরে মানুষ তার চেয়েও বেশি সুশৃঙ্খল থাকে, লাইন দিয়ে চলে, নিয়ম মেনে চলে। কিন্তু ঢাকা বিমানবন্দরে সেটাও হওয়ার উপায় নেই। এই বিমানবন্দরে একটি ভিআইপি টার্মিনাল আছে। তারা ওইদিক দিয়ে যাতায়াত করেন। সেখানে লাইনের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য যে সেবা, সেখানে যারা লাইনে দাঁড়ান তাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে একটা বড় অঙ্কের মানুষ বেলাইনে চলে যান। আমি খেয়াল করে দেখলাম, সাধারণ যে যাত্রীটি দুবাই যাবে, একজন শ্রমিকÑ তিনি কিন্তু লাইন ভাঙছেন না। লাইনটি ভাঙছেন যিনি বিশাল একটি গাড়িতে এসেছেন, কিংবা বিশাল কোন পদ দখল করে আছেন। ছোট বোনকে সেই গেট পর্যন্ত দিয়ে বাইরে আরেকটু অপেক্ষা করলাম। এই সার্কাসটুকু দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লাইন ভাঙ্গার পদ্ধতি দেখছি। আমার সামনেই একজন এসে বললেন, ‘ভাই পলিটিক্যাল পিপল। একটু ঢুকায় দেন।’ আমাকে কেউ বলতে পারেন, এই কথাটার মানে কি? পলিটিক্যাল পিপল, তাই তাদের লাইন ভেঙ্গে দরজার চিপা দিয়ে ঢুকিয়ে দিতে হবে। তারা অন্য যাত্রীদের মতো ঢুকতে পারবেন না। আরও কিছু মানুষকে দেখলাম, পুলিশের সঙ্গে কি কি সব আলাপ করে, পাশ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে বেসামরিক বিমান কর্তৃপক্ষের লোকজন চিপা দিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু দরজার সামনেই বিশাল অস্ত্রসহ দাঁড়িয়ে আছে নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনী। পরিস্থিতি দেখতে দেখতে এতই বিরক্তি লাগছিল যে, নিরাপত্তার কাজে থাকা অনেক মানুষের ভেতর একজনকে বললাম, ভাই আপনার এই ভারি অস্ত্রটার কাজ কি? তিনি আমার প্রশ্নে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, কি বলতে চান আপনি? আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম, একটা লাইন ম্যানেজ করতে পারেন না, আর এইটা... নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কি? তিনি বিষয়টা বুঝতে পারলেন। হঠাৎ করেই লাইন ঠিক করতে একটু তৎপর হলেন। আমরা যখন বিমানবন্দরে লাইন সামলাতে পারি না, তখন আর কোথায় পারি? ॥ চার ॥ বাঙালীরা লাইন মানে না কেন? এর সবচেয়ে বড় কারণটি হলো অশ্রদ্ধা। আপনি অন্য মানুষকে সম্মান করতে শেখেননি। আপনার কাছে মনে হয়েছে, অন্য আর যে মানুষগুলো লাইনে দাঁড়িয়ে সময় কাটাচ্ছে, আপনি তাদের মুরগির চেয়ে অধম মনে করছেন। আপনি নিজেকে অনেক বেশি রাজা মনে করছেন, জমিদার মনে করছেন। অন্যকে আপনি মানুষই মনে করছেন না। চরম অশ্রদ্ধা থেকে এই প্রবণতা তৈরি হয়। এই জাতি কোথাও লাইন মানে না। এর অর্থ হলো, আমরা সুশৃঙ্খল জাতি নই। আজকাল মাঝে মাঝে বাসের জন্য লাইন দেখা যায়। কিন্তু লাইন তো সর্বত্র হওয়ার কথা। যেখানে আপনি সেবা নিতে যাবেন, সেখানেই আপনাকে একটা লাইনে এসে সেবাটি শৃঙ্খলার সঙ্গে নেয়ার কথা। আমরা সেটা করি না। আমরা প্রথমেই ভাবতে থাকি, কিভাবে লাইনটি ডিঙ্গিয়ে কত দ্রুত অন্যকে বাইপাস করে সেবাটি নিয়ে নেয়া যায়। এটাই হলো আমাদের জন্য স্মার্টনেসের সংজ্ঞা। আমরা যে শ্রদ্ধাবোধ শিখিনি, সেটা তো আমাদের নিত্যদিনের কাজকর্ম দেখলেই বোঝা যায়। মিডিয়াতে, টিভিতে প্রতিনিয়ত আমরা সেগুলো দেখছি, রাস্তায় দেখছি, স্কুলে দেখছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখছি- সর্বত্র একই চিত্র। একটি দেশের মানুষ যখন লাইন মানছে না, এরকম ছোট বিষয়ই দেশটি সম্পর্কে অনেক কিছু বলে দেয়। সেই দেশের মানুষের মানসিকতা সম্পর্কে বলে দেয়। অন্যকে সম্মান প্রদর্শনে তার এটিচিউড কি, সেটা বলে দেয়। আর যেখানে মানুষ একে অপরকে সম্মান করে না, সেখানে জীবনযাপন কেমন হতে পারে? হে বাংলাদেশ, গত ৪৫ বছরে তুমি আমাদের একটা লাইন উপহার দিতে পারনি, তাহলে আগামী ৪৫ বছরে তুমি কী দেবে? ১৪ জানুয়ারি ২০১৭ ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×