ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা বাড়ছে ইলিশের উৎপাদন

বাঙালীর জিভে জল আনা মাছ ইলিশ। ইলিশ নিয়ে বাঙালীর যত গর্ব পৃথিবীর আর কোথাও তা নেই। ইলিশ নিয়ে বাঙালীর আদিখ্যেতার ধরনই আলাদা। অস্বীকার করার জো নেই, স্বাদে-গন্ধেই শুধু অতুলনীয় নয়, ইলিশ বাংলাদেশের অন্যতম মৎস্য সম্পদ। সরকারী-বেসরকারী নানামুখী উদ্যোগ আয়োজনের কারণে ইলিশ ক্রমে অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও আমিষ জাতীয় উপাদান সরবরাহে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর বাড়ছে এর উৎপাদন। বিশেষ করে ভর প্রজনন মৌসুমে আহরণে নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে বাস্তবায়নে ইলিশ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিতে শক্তিশালী হয়ে উঠছে ইলিশের ভূমিকা। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে মাছের রাজা ইলিশের অবদান শতকরা প্রায় এগারো ভাগ। জিডিপিতে অবদান প্রায় একভাগ। এর বার্ষিক উৎপাদন চার লাখ টনেরও বেশি। টাকার অঙ্কে যার বাজার মূল্য ২৫ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বে মোট ইলিশের ৬০-৭০ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। ইলিশ আহরণে প্রত্যক্ষভাবে পাঁচ লাখ জেলে জড়িত। পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ। কর্মসংস্থান, অর্থনীতি ও আমিষ সরববরাহে গুরুত্বপূর্ণ এ খাতটি একটি সময়ে যথেষ্ট অবহেলিত ছিল। ইলিশ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ছিল না তেমন উদ্যোগ-আয়োজন কিংবা পরিকল্পনা। ফলে ইলিশের উৎপাদন ক্রমাবণতি ঘটছিল। গত ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন মাত্র পৌনে তিন লাখ টনে নেমে এসেছিল। সে সময়ে পাতে ইলিশ তোলা অনেকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সরকারের উদ্যোগে মৎস্য বিজ্ঞানীসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যাপক গবেষণা ও তৎপরতায় ২০০৭ সাল থেকে জাটকা রক্ষা অভিযানের পাশাপাশি শুরু হয় ভর প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ বন্ধ কর্মসূচী। মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ইলিশ মাছ সারা বছরই কমবেশি প্রজনন করে থাকে। তবে আশ্বিন-কার্তিক বা অক্টোবর মাসের ভর পূর্ণিমায় ইলিশ সবচেয়ে বেশি প্রজনন করে। এ সময় শতকরা ৬০-৭০ ভাগ ইলিশ পরিপক্ব ও ডিম ছাড়ার উপযোগী থাকে। আর বছরের এ সময়টাতেই সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। নির্বিচারে ডিমওয়ালা ইলিশ ধরার কারণে এর প্রজনন ও নতুন প্রজন্মের প্রবেশন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। ফলে কমে যাচ্ছিল ইলিশের উৎপাদন। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে সরকার ভর প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ বা ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২০০৭ সাল থেকে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। ওই বছর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক প্রজনন মৌসুমে দশ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ একদিন বাড়িয়ে ১১ দিন করা হয়। ২০১৫ সালে ১৫ দিন এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে আশ্বিন মাসের প্রথম পূর্ণিমার আগের চার দিন, পূর্ণিমার দিন এবং পূর্ণিমার পরের ১৭ দিনসহ মোট ২২ দিন করা হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৭ সালে ভর প্রজনন মৌসুমে ১০ দিন ডিমওয়ালা ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকায় ৪৬ হাজার আট শ’ কেজি ডিম প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদন হয়। এর মাত্র ৫০ ভাগ ডিম পরিস্ফুটন ধরা হলে ২৯ হাজার তিন শ’ কেজি রেণু উৎপাদন হয়েছে। রেণু বাঁচা বা ঠিকে থাকার হার শতকরা মাত্র ১০ ভাগ হলেও ওই বছর ২ হাজার ৯৩০ কোটি জাটকার প্রজন্ম ইলিশের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। যা ইলিশ সম্পদে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। একইভাবে ২০০৮ সালে প্রজনন মৌসুম নির্বিঘœ রাখার কারণে ২৪ হাজার ৫৩৮ কোটি, ২০০৯ সালে ৮ হাজার ৫২১ কোটি, ২০১০ সালে ২১ হাজার ১২ কোটি, ২০১১ সালে ২৪ হাজার ৯৪ কোটি, ২০১২ সালে ২৩ হাজার ৭৭৫ কোটি, ২০১৩ সালে ২৭ হাজার ৯৪৩ কোটি, ২০১৪ সালে ২৬ হাজার ১১০ কোটি এবং ২০১৫ সালে ৩০ হাজার ৮৯৭ কোটি জাটকা বাংলাদেশের ইলিশ সম্পদে যোগ হয়েছে। ২০১৬ সালে ভর প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণে উৎপাদিত জাটকার সংখ্যা আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেড়ে যাবে। যা ইলিশ সম্পদকে আরও সমৃদ্ধ করবে। ভর প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা ইলিশ নিরাপদ রাখার কারণে সর্বশেষ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন পাঁচ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে বলে আশা করা হচ্ছে। ভর প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা ইলিশ আহরণ বন্ধ রাখায় অন্যান্য মাছের ক্ষেত্রেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জেলেরা এ সময় অন্যান্য মাছ ধরাও বন্ধ রাখে। ফলে অন্যান্য মাছের বংশ বৃদ্ধি ঘটে সফলভাবে। প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরা থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যাপক উদ্যোগের পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানুষেরও সচেতনতা যথেষ্ট বেড়েছে। জেলেরা নিজেরাই অনেক ক্ষেত্রে উদ্যোগী হয়ে কর্মসূচী সফল করায় ভূমিকা রাখে। যা নিঃসেন্দেহে আরও একটি সাফল্য। এরপরেও উপকূলের বহু জায়গায় নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা চলে বেপরোয়াভাবে। যা ইলিশ সম্পদের জন্য মারাত্মক হুমকি। ভর প্রজনন মৌসুমের এ সাফল্য অব্যাহত রাখা গেলে অর্থনীতিতে ইলিশ আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যা এরই মধ্যে প্রমাণিত হতে শুরু করেছে।
×