ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

একজন কিংবদন্তি ব্যবসায়ীর গল্প

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

একজন কিংবদন্তি ব্যবসায়ীর গল্প

তরুণ বয়স থেকেই ব্যবসার প্রতি ছিল তাঁর তুমুল আগ্রহ। কিন্তু তাঁর বাবা চাইতেন না তিনি ব্যবসায়ী হন। বাবার ধারণা তার বংশের ছেলেদের ব্যবসা করা মানায় না। বাবার অনাগ্রহ থাকলেও তিনি থেমে থাকেননি। নিজের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে প্রথমে স্টেশনারীর দোকান দিলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২০। মা চাইতেন তাঁর ছেলে নিজে কিছু করুক। তাই ছেলের স্টেশনারী দোকান দেয়ার প্রাথমিক মূলধন তিনিই যোগান দিলেন। ১৯৫০ সালের দিকে মায়ের দেয়া মাত্র আড়াই হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করা তরুণটি আজ দেশের একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী। শুধু তাই নয় সেই তরুণটি আজ দেশের শীর্ষ করদাতা হিসেবেও সম্মানিত। তিনি একটানা ২০০৭ সাল থেকে ২০১৬ করবর্ষসহ মোট এগারোবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারীর স্বীকৃতি পেয়ে আসছেন। সর্বোচ্চ আয়কর দাতা হিসেবে পেয়েছেন সিআইপি মর্যাদার ট্যাক্স কার্ডসহ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ও পুরস্কার। বলছিলাম বাংলাদেশের ব্যবসার জগতে জীবন্ত কিংবদন্তি জর্দা ব্যবসায়ী মোঃ কাউছ মিয়ার কথা। তিনি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশের সর্বোচ্চ কর দিয়েছেন। সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ করদাতার স্বীকৃতিস্বরূপ ট্যাক্স কার্ড। এছাড়াও তিনি গত কয়েক বছর ধরেই দেশের শীর্ষ ১০ করদাতার তালিকায় ছিলেন। ৮৬ বছর বয়সী এই মানুষটি এখনও হাকিমপুরী জর্দা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কাউছ কেমিক্যালের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বর্ষীয়ান এই ব্যবসায়ী এখনও প্রতিদিন গড়ে ১২-১৪ ঘণ্টা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সময় দেন। মোঃ কাউছ মিয়ার জন্ম ১৯৩১ সালে চাঁদপুরে। তাঁর বাবা মরহুম হাজী আব্বাস আলী মিয়া ও মা মোসাঃ ফাতেমা খাতুন। ১৯৩৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কাউছ মিয়া স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। ১৯৪৪ সালে অষ্টম শ্রেণী পাস করে নবম শ্রেণীতে উঠেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে তাঁর আর পড়াশোনা করা হয়ে উঠেনি। যুদ্ধের পর তাঁর বাবা স্কুলে ভর্তি করতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। তরুণ কাউছ মিয়া ১৯৫০ সালে প্রথমে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ব্যবসায়ে নামেন। সেখানে বছরখানেক ব্যবসা পরিচালনা করে চলে আসেন চাঁদপুরের পুরানবাজারে। ভাড়ায় নেয়া একটি স্টেশনারী দোকান দিয়ে নতুন উদ্যমে আবার ব্যবসা শুরু করেন। কদিন যেতে না যেতেই এ ব্যবসায়ে লাভের দেখাও পান। সেখানে তিন বছর ব্যবসা করে নিজেই ছয়টি দোকানের মালিক হন কাউছ মিয়া। এরপর ১৯৫৫ সালে তামাক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। চাঁদপুরে তিনি টানা ২০ বছর সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করেন। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব হলে ১৯৭০ সালে মায়ের কথা মতো ছোটভাইকে সব দোকান লিখে দেন। নগদ ৮ লাখ টাকা নিয়ে চলে আসেন নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে। চাঁদপুরের মতো নারায়ণগঞ্জেও তিনি ব্যবসায়ে আলোর মুখ দেখতে পান। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি তামাক ব্যবসা পুরোদমে শুরু করেন। তামাক ব্যবসা করতে গিয়েই একসময় কাউছ মিয়ার মনে জর্দা উৎপাদনের ভাবনা আসে। জর্দা ব্যবসায়ের শুরু দিক সম্পর্কে মোঃ কাউছ মিয়া বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলাদেশে তামাক চাষ হতো না। তামাক আসতো পাকিস্তানের মারদান থেকে। তখনই হঠাৎ মনে হলো, যদি জর্দা উৎপাদন করা যায় তাহলে ভাল মুনাফা পাওয়া যাবে। পরবর্তীতে শান্তিপুরী জর্দা উৎপাদন শুরু করি। একপর্যায়ে শ্রমিকদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯৭৮ সালে এই কারখানাটি বন্ধ করে দিই। ১৯৮০ সালের দিকে আমি ঢাকা চলে আসি। ১৯৯৬ সালে নতুন করে বাজারে আনি ‘হাকিমপুরী জর্দা’। এই জর্দাটি মানুষ দ্রুত লুফে নেয়। অল্প কদিনেই হাকিমপুরী জর্দা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আমি ভাল মুনাফা পেতে শুরু করি। এ জর্দাটি এখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় আছে।’ কাউছ মিয়া যখন যে ব্যবসা ধরেছেন, সেই ব্যবসাতেই লাভের মুখ দেখেছেন। তাঁর মা বলতেন, ‘সৎ পথে থেকে ব্যবসা করলে সাফল্য আসবেই।’ কাউছ মিয়া মনে করেন, সৎ থেকে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন বলেই তিনি আজ এতদূর আসতে পেরেছেন। সততাই তাঁর ব্যবসায়ের মূল শক্তি। কাউছ মিয়া ১৯৫৮ সাল থেকেই সরকারকে নিয়মিত কর দেয়া শুরু করেন। কেন কর দেনÑ এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, দায়িত্ববোধ থেকেই কর দিই। কর দেয়া আমার নাগরিক দায়িত্ব। আমি ব্যবসা করছি। যা আয় করছি, মুনাফা অর্জন করেছি তা সরকারকে যথাযথভাবে দেখাই। সে অনুযায়ী কর পরিশোধ করি। কর ফাঁকি দিয়ে টাকা রাখতে চাই না।’ তিনি বলেন, ‘কর দিলে আমার আয় বৈধ হবে। কর না দিলে আমার টাকা তখন হোয়াইট থাকবে না। এটা ব্লাক মানি হয়ে যাবে। তাই নিয়মিত কর দিলে কেউ ঝামেলা করতে পারবে না। স্বাধীনভাবে ব্যবসা করা যাবে।’ তিনি মনে করেন যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী সরকারকে কর দেয়া উচিত। তাহলে নিজেও ভাল থাকতে পারা যাবে। দেশের উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে যদি সবাই কর দেয় তাহলে বাংলাদেশ সবক্ষেত্রেই ভাল করবে।
×