ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জলি রহমান

সবজি উৎপাদনে সমৃদ্ধ অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

সবজি উৎপাদনে সমৃদ্ধ অর্থনীতি

বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে সবজি উৎপাদনে। কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে মাঠজুড়ে শাক-সবজি দেখা যায়। দেশে সবজি উৎপাদনে যে বিপ্লব ঘটেছে এবারের সবজিমেলা তারই স্বাক্ষর বহন করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে দেশী-বিদেশী ৬০ ধরনের ও ২০০টি জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। পুষ্টি এবং অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তায় শাক-সবজির ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক ২২০ গ্রাম সবজি খাওয়া প্রয়োজন। যা বাংলাদেশে মাত্র ৭০ শতাংশ মানুষ পূরণ করতে পারেন। খাদ্য নিরাপত্তায় পৃথিবীব্যাপী শাক-সবজির চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশল কাজে লাগিয়ে বর্তমানে এখন সারাবছরই সব ধরনের সবজি উৎপাদন করা যায়। শীতকালে বাংলাদেশে সবজির সমারোহ মুগ্ধ করে সবাইকে। উত্তর অঞ্চলে কাঁচা সবজির বৃহত্তম হাট বগুড়ার মহাস্থান। এ অঞ্চলের উৎপাদিত কপি, মরিচ, মুলা, বেগুন ও লাউসহ যাবতীয় সবজি এ হাটে বেচাকেনা হয়। এ হাট থেকে সবজি কিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরগুলোতে বিক্রি হয়ে থাকে। প্রতি হাটে ৪-৫ শতাধিক মণ সবজি বিক্রি হয়। সফতাহে বুধ ও শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে মহাস্থান হাটে সবজি কেনাবেচা। এ হাটে শীতকালীন সবজির সরবরাহ বেশি। তবে, মাসের প্রথম দিকের চেয়ে বর্তমানে সব সবজির দাম কিছুটা কমেছে। চলতি মৌসুমে এই জেলায় আড়াই লাখ মেট্রিকটন বিভিন্ন সবজির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সংশ্লিষ্ট অধিদফতর। জানা যায়, এ হাটে রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরগুলো থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা আসেন এবং তাদের পছন্দমতো বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি কিনে থাকেন। মহাস্থান হাটে প্রতিদিন কত টাকার সবজি বিক্রি হয় এটা বলা না গেলেও প্রায় ৩০-৩৫ ট্রাক কাঁচা মালামাল দূর-দূরান্তে চলে যায়। মহাস্থান হাট সফতাহে দুইদিন বসলেও শীতকালীন সবজি বেচাকেনার জন্য হাটের বার ছাড়াও প্রতিদিন চলে বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন শাক-সবজি কেনাবেচা। ঐতিহ্যবাহী মহাস্থান হাটে আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, হাইব্রিড, বেগুন, শসা, পটল, করলা, কাঁচামরিচ, পেঁপে, বরবটি, চিচিঙ্গা, কচুমুখী এবং জালি কুমড়া পাওয়া যায়। এ হাটে জেলার বাইরে থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা আসার কারণে জেলার সবজি চাষীরা সাধারণত হাটের বারেই বেশি শাক-সবজি নিয়ে আসেন। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। গত এক দশকে বাংলাদেশে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। এই হার বিশ্বে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও)। এক সময় ভাল স্বাদের সবজির জন্য শীতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। টমেটো, লাউ, কপি বা নানা পদের শাক শীতকাল ছাড়া বাজারে মিলতই না। গ্রীষ্মকাল ছিল সবজির আকালের সময়। গত এক যুগে পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন প্রায় সারা বছরই ২০ থেকে ২৫ জাতের সবজি খেতে পারছে দেশের মানুষ। কৃষকরা সারা বছরই নানা ধরনের সবজির চাষ করছেন। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রফতানি বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, আর কৃষিজাত পণ্যের রফতানি বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে সবজির রফতানি বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের রফতানি বেড়েছে ৬০ শতাংশ। ইপিবির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ সালে দেশে ১ কোটি ৪৩ লাখ ৪৭ হাজার টন সবজির উৎপাদন হয়েছে। যা ২০০৯-১০ সালের চেয়ে ৩৫ লাখ টন বেশি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ছয় বছর আগে সবজির উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৮ লাখ ৬৯ হাজার টন। সদ্য বিদায়ী ২০১৬ সালে দেশে সবজির উৎপাদন ৩১ শতাংশ বেড়েছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বলে মনে করেন কৃষিবিদরা। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি সবজি যায় সৌদি আরবে। এর পরেই রয়েছে কাতার, ওমান, আরব আমিরাত, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। গত এক যুগে রীতিমতো ঘটে গেছে সবজি বিপ্লব। সবজি চাষ ও পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সচেতন করতে রাজধানীতে দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে সবজি মেলা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে এ মেলা আগামী ৫ জানুয়ারি শুরু হয়ে ৭ জানুয়ারি শেষ হয়েছে। এ সবজি মেলায় প্রদর্শন করা হয়েছে প্রায় ১২৪ জাতের শাক-সবজি। সরকারের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিকরা ৩৪টি ফসলের ১০০ রকমের জাত উদ্ভাবন করেছেন, যেগুলো প্রদর্শন করা হয়েছে এ মেলায়। বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল এ্যান্ড এ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মোহাম্মদ মনসুর এক সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, ‘দেশে আগের চেয়ে উন্নত মানের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। তাই আমাদের পক্ষে রফতানি করা সহজ হয়েছে। তবে এখনও বাংলাদেশের সবজির প্রধান ক্রেতা প্রবাসী বাংলাদেশী, ভারতীয় ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের প্রবাসীরা।’ মোহাম্মদ মনসুর আরও বলেন, ‘ইউরোপ ও আমেরিকার সুপারস্টোরগুলোতে আমরা এখনও প্রবেশ করতে পারিনি। সরকার যদি সবজির জন্য কেন্দ্রীয় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ হিমাগার ও শীতাতপনিয়ন্ত্রণ পরিবহনের ব্যাপারে সহযোগিতা করে, তাহলে বাংলাদেশ বিশ্বের সবজি বাজারে নেতৃত্ব দিতে পারবে।’ বিশ্বের অন্যতম খাদ্য রফতানিকারক দেশে পরিণত হওয়ারও সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের। ইতিমধ্যে সরকার কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নতমানের বীজ ব্যবহার নিশ্চিত করে উৎপাদন দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য বহির্বিশ্বের কাছে বিস্ময় বলে বিবেচিত হবে এবং বাংলাদেশ কৃষিতে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।
×