ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধিকাংশ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পূর্ণাঙ্গ জরুরী চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই

অপঘাতে দেশে বছরে মারা যায় ৭০ হাজার

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

অপঘাতে দেশে বছরে মারা যায় ৭০ হাজার

নিখিল মানখিন ॥ গুরুতর আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য দেশের অধিকাংশ হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পূর্ণাঙ্গ জরুরী চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জরুরী চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে অপঘাতের শিকার অনেককেই বাঁচানো সম্ভব। দেশে এখনও জরুরী চিকিৎসার যথেষ্ট উন্নতি না ঘটায় এ ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে। জরুরী চিকিৎসার জন্য পৃথক ও বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য জনবল দরকার। পাশাপাশি যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক হাসপাতালে স্বাভাবিক চিকিৎসার সক্ষমতা ও অবকাঠামো দিয়ে জরুরী চিকিৎসা হিসেবে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ করেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন অপঘাতে বছরে দেশে ২২ লাখ ১০ হাজার ৯৮০ জন আহত হয়। তাদের মধ্যে ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই ৭০ হাজারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৫.৫ শতাংশ মারা যায় পানিতে ডুবে। এর পরই ২২.৬ শতাংশ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। এ ছাড়া কোন না কোনভাবে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর হার ১৫.৭, আত্মহত্যা করে ১৩.৬, সহিংসতায় ৬.৬, পশুর কামড়ে ৫.৫, অগ্নিকা-ে ৩.৯, বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে ২.৮ শতাংশ এবং বাকি মৃত্যু অন্যান্য কারণে হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই অপঘাতের পর পরই হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে আসা হয় বা ঘটনাস্থলে কিংবা আনার পথে প্রয়োজনীয় প্রাক-জরুরী চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু ঘটে। জরুরী চিকিৎসা যে কেবল হাসপাতালের জরুরী বিভাগে আনার পর শুরু হবে তা নয়, দুর্ঘটনার পর থেকেই এর শিকার ব্যক্তির জরুরী চিকিৎসার সময় শুরু হওয়া দরকার। প্রাক-জরুরী সেবাটাও খুব জরুরী। বিশেষ করে এ্যাম্বুলেন্সে পর্যাপ্ত জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম থাকা অত্যাবশ্যক। এ ছাড়া হাসপাতালের জরুরী বিভাগে আনার পর যাতে তার সার্বিক দিকগুলো দ্রুতগতিতে দেখার মতো দক্ষতাসম্পন্ন জনবল থাকে সে ব্যবস্থা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের অনুরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশে জরুরী চিকিৎসা সার্ভিসের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দিতে শুরু করে। এর আওতায় প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এই কার্যক্রম শুরু হলেও পরবর্তীতে তা বিস্তৃত হয়েছে ঢাকা অর্থোপেডিক হাসপাতাল নিটর, মানিকগঞ্জ জেলা হাসপাতাল ও হরিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে, সাতক্ষীরা জেলা হাসপাতাল ও দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং গোপালগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতাল ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে । আওয়ামী লীগ সরকারের আগ্রহে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগকে পাইলট প্রোগ্রামের আওতায় নিয়ে আসা হয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের দেশী-বিদেশী একদল বিশেষজ্ঞ দিয়ে চাহিদা নিরূপণ করা হয়। এর ভিত্তিতে প্রকল্প প্রণয়ন হয়। প্রকল্পের আওতায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তিন চিকিৎসক ও তিন নার্স জরুরী চিকিৎসা সার্ভিসের দক্ষতা অর্জনের জন্য থাইল্যান্ড গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসেন। পরে তারা দেশে ফিরে আরও ১২০ চিকিৎসক, ৬০ নার্স ও ২০ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেন। তারা সবাই এখন জরুরী চিকিৎসাসেবা কার্যক্রমে দক্ষ। একই সূত্র জানায়, প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতালসহ অন্য হাসপাতালে আনুষঙ্গিক উপকরণ, অবকাঠামো ও জনবল কাঠামোতেও সহায়তা দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে এই কার্যক্রম নিয়ে কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ সোসাইটি অব ইমার্জেন্সি মেডিসিন-বিএসইএমের সংশ্লিষ্টরা জানান, কোন অপঘাতের পর যত দ্রুত সম্ভব আহতকে উপযুক্ত জরুরী চিকিৎসাসেবা দেয়া গেলে অনেক ক্ষেত্রেই তার জীবন রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু দ্রুত ও উপযুক্ত জরুরী চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে অনেক রোগীর করুণ মৃত্যু ঘটে। বছরে যে ৬০ থেকে ৭০ হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে, তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেয়া গেলে তাদের অনেকেই হয়ত বেঁচে যেত। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, জরুরী চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা বলতে আগে দেশে কিছুই ছিল না। তবে বর্তমান সরকার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় এ নিয়ে কাজ করছে। ইতোমধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতালসহ দেশের আটটি হাসপাতালে অত্যাধুনিক জরুরী সেবা কার্যক্রম চলছে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও জেলা সদর হাসপাতালগুলোর জরুরী বিভাগের উন্নয়নে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জরুরী চিকিৎসার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির চেষ্টা চলছে, কিছু কিছু কাজ শুরু হয়েছে। তবে এর সুফল পেতে আরও সময় লাগবে। কারণ জরুরী চিকিৎসার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য জনবল দরকার। পাশাপাশি যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোগত ব্যবস্থাপনাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ অর্থোপেডিক্স সোসাইটির সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডাঃ আবদুল গণি মোল্লা বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার পর দ্রুত জরুরী চিকিৎসা দেয়া গেছে বলেই অনেক গুরুতর আহত মানুষ প্রাণে বেঁচে গেছেন। আহতের অনেকে নয়ত ঘটনাস্থলেই যেভাবে একটি পা বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রচুর রক্তক্ষণ হয়, তাতে তাদের বাঁচানো কঠিন ছিল। আমাদের হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে আসার পর যেভাবে জরুরী চিকিৎসা দিয়ে থাকি, অনেক হাসপাতালেই এ সুবিধা নেই। এ ছাড়া দুর্ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতালের দূরত্বও বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বলে জানান অধ্যাপক ডাঃ আবদুল গণি মোল্লা। কেবল সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই যে জরুরী চিকিৎসা প্রয়োজন তা নয়, যেকোনভাবে আহত বা অসুস্থতার ক্ষেত্রেও জরুরী চিকিৎসা অত্যাবশ্যক। তাই হাসপাতালগুলোতে জরুরী চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা খুবই জরুরী। এ ক্ষেত্রে হৃদরোগের জরুরী চিকিৎসাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার। বাংলাদেশ সোসাইটি অব ইমার্জেন্সি মেডিসিন-বিএসইএম সূত্র জানায়, আগে হাসপাতালগুলোতে নামমাত্রই জরুরী বিভাগ ছিল। সাধারণ চিকিৎসকরাই এসব জরুরী বিভাগে কাজ করতেন। এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। এখন জরুরী চিকিৎসার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। বিশেষ করে গত এক বছরে প্রায় ৪০০ নবীন চিকিৎসককে ট্রমা, কার্ডিয়াক এবং পেডিয়াট্রিক ইমার্জেন্সির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে দেশের কয়েকটি হাসপাতালে অত্যাধুনিক জরুরী বিভাগ চালু করা হয়েছে। অন্যান্য হাসপাতালেও জরুরী বিভাগ নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যক্রমের আওতায় এ হাসপাতালের আগের জরুরী বিভাগকে পুনর্গঠন করে নতুন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইমার্জেন্সি এ্যান্ড ক্যাজুয়ালিটি কমপ্লেক্স করা হয়েছে। মহাসড়কের আশপাশে ‘ট্রমাটিক ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার’ সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ বন্ধ ॥ দেশের প্রতিটি মহাসড়কের আশপাশে ‘ট্রমাটিক ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার’ সেন্টার স্থাপনের সরকারী উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১১ সালে সরকার ‘সড়ক নিরাপত্তা দশক কার্যক্রম: ২০১১-২০২০’ কার্যক্রম গ্রহণ করে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ৮টি মন্ত্রণালয় ও বেশ কয়েকটি বেসরকারী সংস্থা সমন্বিতভাবে এটি বাস্তবায়নে কাজ করবে। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আহত ও মৃত্যুর হার শতকরা ৫০ ভাগে কমিয়ে আনাসহ সকল প্রকার আহতদের যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হবে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেশের প্রতিটি মহাসড়কের আশপাশে ‘ট্রমাটিক ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেন্টার’ স্থাপন করার উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এসব সেন্টারে সার্জারিসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করবেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ‘রোড সেফটি এ্যান্ড ইনজুরি প্রিভেনশন প্রোগ্রাম’র মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে ইনজুরি ও মৃত্যুর হার শতকরা ৫০ ভাগে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করা হবে।
×