ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকাশকদের হাতে ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ খোদ বাংলা একাডেমির সভাপতির ॥ সংস্কৃতিমন্ত্রীর ভিন্নমত

একুশে বইমেলার আয়োজক নিয়ে নানা বিতর্ক

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

একুশে বইমেলার আয়োজক নিয়ে নানা বিতর্ক

মনোয়ার হোসেন ॥ অনেক দিন ধরেই একুশের বইমেলা পরিচালনায় বাংলা একাডেমির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক চলছিল। অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিচালনা করা বাংলা একাডেমির কাজ নয়, এটা ছেড়ে দেয়া উচিত প্রকাশকদের তত্ত্বাবধানে- এমন কথা বলছিলেন বিশিষ্টজনদের অনেকেই। এ নিয়ে তাঁদের যুক্তিটি হলো, মূলত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা এবং গবেষণাসহ এর উৎকর্ষ সাধনেই কাজ করা উচিত একাডেমির। অথচ বইমেলা পরিচালনা করতে গিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসসহ আরও কয়েকটি মাস নষ্ট হয় একাডেমির। বইমেলা পরিচালনায় একাডেমির ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসংখ্যবার প্রশ্ন তুলেছেন প্রকাশকরা। আর সেই বইমেলা পরিচালনার কাজটি প্রকাশকদের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছেন খোদ বাংলা একাডেমিরই সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। গত ৩১ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির ৩৯তম বার্ষিক সভায় সভাপতির বক্তব্যে বরেণ্য এই ব্যক্তিত্ব বলেছেন, বাংলা একাডেমির উচিত নয় বইমেলার দায়িত্ব পালন করা। অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিচালনার দায়িত্ব প্রকাশকদের ওপর ছেড়ে দিলে একাডেমি নিজের কাজগুলো ঠিকমতো করতে পারবে। কারণ, বইমেলা পরিচালনার কারণে ফেব্রুয়ারি মাসসহ আগে ও পরে মিলিয়ে তিন মাস একাডেমির নিজস্ব কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এছাড়া বাংলা একাডেমির মেলা পরিচালনা বিষয়ে নানারকম সমালোচনাও হচ্ছে। তাই মেলা পরিচালনার বিষয়ে একাডেমির ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করা উচিত। তবে অমর একুশে বইমেলা পরিচালনায় প্রকাশকরা কতটা সফল হবেনÑ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংস্কৃতিমন্ত্রীসহ সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। কেউ বা আবার প্রকাশকদের মেলা পরিচালনার পক্ষে মত দিয়েছেন। অধিকাংশই বইমেলার ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার সক্ষমতা প্রকাশকদের নেই বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, বাংলা একাডেমি পরিচালিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। বই বিকিকিনির পাশাপাশি এ মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য। প্রকাশকদের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিলে মেলার চেতনাগত রূপটি হারিয়ে সেটি পরিণত হবে বাণিজ্যমেলায়। শুধু তাই নয়, মেলা পরিচালনায় যে ঐক্য প্রয়োজন সেটাও প্রকাশকদের নেই। তাই প্রকাশকদের ইচ্ছা থাকলেও বাংলা একাডেমিকে ছাড়া বইমেলা আয়োজনের উপায় নেই। বাংলা একাডেমি প্রকাশকদের ওপর বইমেলা পরিচালনার দায়িত্ব ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান জনকণ্ঠকে বলেন, এ নিয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না। তবে একাডেমির সভাপতি হিসেবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এ বিষয়ে কোন নির্দেশ দিলে আমরা সেটাকে কার্যনির্বাহী পরিষদের সভায় উত্থাপন করব। একইভাবে প্রকাশকরা আগ্রহ প্রকাশ করলেও বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে। এছাড়া দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই একাডেমিকে বাদ দিয়ে মেলা না করার মত প্রকাশ করেছেন। বইমেলা পরিচালনার কারণে বাংলা একাডেমির নিজস্ব কার্যক্রম ব্যাহত হয় কিনাÑ এ বিষয়েও মন্তব্য করতে রাজি হননি শামসুজ্জামান খান। এ বিষয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, বাংলা একাডেমি পরিচালিত ভাষা শহীদদের নিবেদিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। প্রকাশকদের হাতে মেলা ছেড়ে দিলে এর নীতিগত চরিত্রটি হারাতে পারে। এমনকি মেলা পরিচালনায় প্রকাশকদের সক্ষমতার বিষয়টি নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। বইমেলা পরিচালনার দায়িত্ব প্রকাশকরা যথাযথ পালন করতে পারবেন কিনাÑ এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সদ্য বিদায়ী সভাপতি ওসমান গনি বলেন, অবশ্যই আমাদের একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজনের সক্ষমতা আছে। এই মেলা পরিচালনা করার মতো দক্ষতাও আমাদের আছে। ইতোমধ্যে দেশের ভেতরে আমরা বিভাগীয় শহরে বইমেলার আয়োজন করেছি। কলকাতায় বাংলাদেশ বইমেলাটিও আমাদের আয়োজনে সফলভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় আমাদের উদ্যোগে বাংলাদেশের প্রকাশনীগুলো অংশ নিচ্ছে। এছাড়া পৃথিবীর বড় বড় বইমেলা প্রকাশক কিংবা বেসরকারী সংস্থার অধীনেই পরিচালিত হয়। তবে একুশে গ্রন্থমেলা পরিচালনার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সহযোগিতা প্রয়োজন। এই মেলার আয়োজনটি এখন প্রকাশকদের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। আর সেটা হলে মেলা আয়োজনের জন্য অযথা বাংলা একাডেমির তিনটি মাস নষ্ট হবে না। আমরা কোন সরকারী বরাদ্দ ছাড়াই এ মেলার আয়োজন করতে পারব। এমনকি স্টলের ভাড়াও আমরা কম রাখতে পারব। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকসহ, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠনের মাধ্যমে আরও সুন্দর ও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে এ মেলার আয়োজন করা সম্ভব হবে। তাই বইমেলা আয়োজনের দায়িত্ব জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই আমি বলে আসছি যে একুশে গ্রন্থমেলার দায়িত্ব বাংলা একাডেমির ছেড়ে দেয়া উচিত। এই মেলা আয়োজনের দায়িত্বটি প্রকাশকদের কাছে হস্তান্তর করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে মেলা আয়োজনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বাংলা একাডেমি ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। এছাড়া মাসব্যাপী মেলার প্রতিদিনের সেমিনারের আয়োজনটি থাকবে একাডেমির দায়িত্বে। এদিকে বইমেলার আয়োজন প্রকাশকদের হাতে তুলে দেয়ার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। শংকা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি মেলা পরিচালনার দায়িত্ব বাংলা একাডেমির হাতেই থাকা উচিত। প্রকাশকদের কাছে মেলার দায়িত্বভার তুলে দিলে সেটা বাণিজ্যমেলায় পরিণত হবে। ফলে একুশে বইমেলার আবেদনটি নষ্ট হবে। কারণ, এটা শুধু বইয়ের বিকিকিনি নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের কৃষ্টি-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। প্রকাশকরা দায়িত্ব নিলে বাণিজ্যের বিষয়টিকেই বড় করে দেখবে। এছাড়া একাডেমি আয়োজিত মেলায় প্রতিদিন যে বিষয়ভিত্তিক সেমিনার হয় প্রকাশকদের পক্ষে সে ধরনের সেমিনার আয়োজন করা সম্ভব হয়। আবৃত্তিশিল্পী ও জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ একুশে মেলা পরিচালনায় প্রকাশকদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, প্রকাশকরা এখনও পর্যন্ত এমন কোন দায়িত্বশীল কাজ করেনি যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে তারা মেলার আয়োজন করতে পারবে। তাদের নিজেদের ভেতরেই অনেক বিভাজন আছে। তাই বইমেলায় একাডেমির নিয়ন্ত্রণ না থাকলে এটিকে শুধুই বাণিজ্যিক বিবেচনায় দেখা হবে। ভাষা শহীদদের নিবেদিত এই মেলার একটা রাজনৈতিক চেতনা আছে। কখনও যদি সরকার পরিবর্তনের ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় আসে তখন প্রকাশকরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বদলে যাবে মেলার চরিত্র। এছাড়া প্রকাশকদের মধ্যে এমন কেউ নেই যিনি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। তাই বইমেলা আয়োজনে যদি একাডেমির নিজস্ব কর্মকা- ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেক্ষেত্রে মেলার প্রয়োজনে বাড়তি লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। বইমেলা পরিচালনায় বাংলা একাডেমির সহযোগিতা প্রয়োজন উল্লেখ করে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির বর্তমান সভাপতি মাজহারুল ইসলাম বলেন, একুশে বইমেলার মতো বিশাল পরিসরের আয়োজন বাংলা একাডেমির সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বইমেলাকে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তবে মেলা সংক্রান্ত সরকারের বিভিন্ন অধিদফতর ও মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ সহযোগিতা পেলে আমাদের পক্ষে আয়োজন করা সম্ভব। মেলা আয়োজনে প্রকাশকদের মধ্যে বিভাজন এবং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা মনে করি আমাদের ঐক্য আছে এবং সবার সহযোগিতা পেলে মেলা আয়োজনেও সক্ষম হব। প্রসঙ্গত, ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে অমর একুশে গ্রন্থমেলা। একাডেমির বর্ধমান হাউস সংলগ্ন বটতলায় ৩২টি বই নিয়ে একাই বইমেলার আয়োজন করেছিলেন মুক্তধারা প্রকাশনীর প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা। ঘাসের ওপরে চট বিছিয়ে বই নিয়ে বসেছিলেন এই প্রকাশক। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন দেশে এটাই ছিল প্রথম বইমেলা। ১৯৭৬ সালে এসে মেলায় যোগ দেয় আহমদ পাবলিশিং হাউস। এরপর ১৯৭৭ সালে একে একে যোগ দেয় নওরোজ কিতাবিস্তান ও চলন্তিকা। ১৯৭৮ সালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বইমেলার আয়োজন শুরু করে বাংলা একাডেমি।
×