ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পুরান ঢাকার ঐতিহ্য সাক্রাইন

দিনভর ঘুড়ি কাটাকাটি রাতে আলোর উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

দিনভর ঘুড়ি কাটাকাটি রাতে আলোর উৎসব

মোরসালিন মিজান ॥ নতুন ঢাকাই সব এখন। পুরান ঢাকার খবর কে রাখে? যানজট ঠেলে ওদিকে তেমন যান না কেউ। শনিবারও যাননি। এবং যারা যাননি তারা কল্পনাও করতে পারবেন না, সাক্রাইন উৎসব কত বড় আর বর্ণাঢ্য হয়ে থাকে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, টিএসসি চারুকলা শাহবাগ এলাকার চেনা গ-ির বাইরে গিয়ে এমন উদ্যান দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। প্রতিবছরের মতো এবারও দিনভর উৎসব অনুষ্ঠানে মেতেছিল প্রাচীন শহর। ছেলে বুড়ো নারী পুরুষ কিশোর কিশোরী সবাই উঠে এসেছিল বাসার ছাদে। রং-বেরঙের ‘ঘুড্ডি’ আকাশে উড়িয়ে দিয়ে শুরু। সেই সকালবেলায়। তার পর ঘুড়ি কাটাকাটি খেলা। দিনভর হৈ হুল্লোড়। পিঠাপুলির আয়োজন ছিল ঘরে ঘরে। আর সন্ধ্যায় তো মনে হচ্ছিল আলোর রাজ্য। আতশবাজি, ফানুস, পটকা, ফায়ারওয়ার্কস, গান, বাদ্যি যেন রাত নামতে দিচ্ছিল না! সাক্রাইন উৎসব নাম হলেও এটি পৌষসংক্রান্তির বাইরে নয়। বিচ্ছিন্ন নয় একদমই। বরং পৌষ বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতার সবচেয়ে দৃশ্যমান অংশ। পৌষের শেষদিনে পৌষসংক্রান্তির উৎসব অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সে অনুযায়ী, ৩০ পৌষ শুক্রবার পৌষসংক্রান্তি উদযাপিত হওয়ার কথা। কিন্তু প্রচলিত পঞ্জিকার হিসাবের সঙ্গে স্থানীয়দের হিসাবের পার্থক্য থাকায় একদিন পর শনিবার এই উৎসব আয়োজন করা হয়। একই কারণে একদিন পিছিয়ে যায় সাক্রাইন উৎসব। লোক আচার ও সমকালীন সংস্কৃতির উৎসবে দারুণ মুখরিত এমন দিন নাগরিক জীবনে কমই আসে। সাক্রাইন কবে থেকে উদ্যাপিত হচ্ছে তা সঠিক করে কেউ বলতে পারেন না। যতদূর তথ্য, মোগল আমলে বাংলায় উৎসবটির প্রচলন। ঢাকার নবাবরা এর সূচনা করেন। পৌষের শেষ এবং মাঘের শুরুর ক্ষণে খাজনা আদায় শেষে নবাবরা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব করতেন। চলত খাবারদাবারের আয়োজন। সেই ঐতিহ্য মেনে এখন পুরান ঢাকায় উৎসবটি উদযাপন করা হয়। উৎসবের আমেজটা বেশি দেখা যায় গে-ারিয়া, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, চকবাজার, লালবাগ, সূত্রাপুরসহ কয়েকটি এলাকায়। এলাকাগুলো ঘুরে মনে হয়েছে, এ শহর কেবলই হাসিরাশি আনন্দের। কোন ঘরে বেদনা নেই। সব ঘর উৎসবের একেকটি কেন্দ্র। সাক্রাইনের প্রধানতম অনুসঙ্গ ঘুড়ি। সকাল হতেই প্রতি বাড়ির ছাদে অবস্থান নিতে থাকে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। বিশেষ করে তরুণ ও শিশু-কিশোরদের আনন্দ যেন ধরে না। বিভিন্ন আকার-আকৃতির ঘুড়ি নিয়ে বাসা থেকে বের হতে দেখা যায় তাদের। তার পর ঘুড়ি ওড়ানোর আনন্দ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ঘুড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকে। হরেক রকমের ঘুড়ি আকাশ এক রকম ঢেকে দেয়। কিছু ঘুড়ি পাতলা কাগজ দিয়ে তৈরি। কিছু আবার পলিথিন দিয়ে। বাঁশের পাতলা চটি অথবা নারকেলের শলা দিয়ে কাঠামো তৈরি করা হয়। ঘুড়ির আবার অনেক নাম। এদিন আকাশে উড়তে দেখা যায় পঙ্খীরাজ, চাপালিশ, চোখদ্বার, মালাদ্বার, চশমাদ্বার, কাউঠাদ্বার, চানদ্বার, ইত্যাদি নামের ঘুড়ি। ঘুড়ির মতো বিভিন্ন নাম আছে নাটাইয়ের। বাটিওয়ালা, মুখবান্ধা, মুখছাড়াÑ কত কত নাম! ঘুড়ির ‘লেঞ্জা’ তৈরিতেও সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটানো হয়। ঘুড়ির লেজ বা লেঞ্জা দারুণ ঢেউ তুলে আকাশে উড়ে বেড়ায়। সেই ঢেউ, যে ঘুড়ি ওড়ায় না, তারও বুকে এসে লাগে! ঘন হয়ে উড়তে থাকা রং-বেরঙের ঘুড়ি আকাশকে শুধু নীল থাকতে দেয় না। স্থির হয়ে থাকতে দেয় না। উৎসবের রঙে সাজায়। বহু দূর থেকে এই দৃশ্য দেখা যায়। পথচারীরা তাই নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটার কথা ভুলে যান। হাঁটেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। কী যে আনন্দ নিয়ে ঘুড়ি দেখেন তারা! ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবটি ভাল দেখা যায় বাড়ির ছাদ থেকে। বাড়ির বড়রাও তাই আর বাড়িতে ছিলেন না। ছাদের উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে, জানালার গ্রিল ধরে ঘুড়ির ওড়াউড়ি দেখছিলেন এমনকি বুড়োরা। অবশ্য সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানো মূল কথা নয়। ঘুড়ি কাটাকাটি খেলা চাই। ওটাই প্রধান আকর্ষণ। না, ঝগড়াঝাটি নয়। শত্রুতা নয়। এ লড়াই চলে হাসিমুখে। প্রথমে সুতোয় সুতোয় প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়া হয়। তার পর নিজ নিজ দক্ষতা অভিজ্ঞতা ও কৌশল কাজে লাগিয়ে কাটাকাটি খেলা। যুদ্ধে পরাজিত ঘুড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দূরে আরও দূরে চলে যায়। অন্য কোন বাসার ছাদে বা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সুতো কাটা ঘুড়িকে অনুসরণ করে পাড়ার দূরন্ত ছেলেমেয়ে। ঘুড়িকে নিজের করার এই চেষ্টাও চোখে পড়েছে কিছু সময় পর পর। পরদিন কুড়িয়ে পাওয়া ঘুড়ি ওড়ানো হয় আকাশে। এভাবে কয়েকদিন চলে ঘুড়ি উৎসব। কাটাকাটি খেলার জন্য ঘুড়ির সুতো মজবুত হওয়া জরুরী। একই সঙ্গে ধারাল হতে হয়। ঘুড়ির সুতো ধারালো করার প্রক্রিয়াটিকে বলে মাঞ্জা দেয়া। আগেই মাঞ্জা দেয়ার কাজ সেরে রেখেছিলেন ‘যোদ্ধারা।’ লালবাগ এলাকার একটি ছয়তালা বাড়ির ছাদে কথা হয় শিহাব, শায়ান, তুমুল ও সিফাতের সঙ্গে। শিহাব ও শায়ান স্থানীয়। তুমুল ও সিফাত এসেছিল আমন্ত্রিত হয়ে। সবাই ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী। তারা জানালেন, ঘুড়ি ওড়ানোর এই সুযোগ কাজে লাগাতে সারা বছর পুরান ঢাকার মানুষ অপেক্ষা করে থাকেন। চলে দীর্ঘ প্রস্তুতি। প্রস্তুতি ভাল হওয়ায় এবার তিনটি ঘুড়ি কেটে দিতে পেরেছে বলে জানায় তারা। সন্ধ্যায় আবার আরেক রূপে ধরা দেয় সাক্রাইন। প্রতিটি বাড়ির ছাদ থেকে ঘুড়ির বদলে ফানুস ওড়ানো শুরু হয়। দেখতে দেখতে গোটা আকাশ ভরে যায় ফানুসে। আতশবাজি দেখে শেষ করা যায় না। একটির চেয়ে অন্যটি আরও বর্ণিল। বিপুল জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। চলে বিচিত্র ফায়ারওয়ার্কস। মুখ দিয়ে কেরোসিন ছুড়ে তরুণরা আগুনের সঙ্গে খেলেন। আগুন কু-লি পাঁকিয়ে উপরের দিকে উঠে যায়। কিন্তু কোন অনিষ্ট করে না। পুরোটা সময় ছিল নাচ-গানের আয়োজন। উচ্চৈস্বরে গান বাজানো হচ্ছিল অধিকাংশ বাসার ছাদ থেকে। দীননাথ সেন রোডের ২৮ নম্বর বাড়ির ছাদে সন্ধ্যায় উঠে দেখা যায়, আশপাশের সব বাড়ির ছাদে চলছে একই রকম আয়োজন। মাঝবয়সীদের একটি দল এ ছাদে দাঁড়িয়ে উৎসব উপভোগ করছিলেন। কথা প্রসঙ্গে মানজার চৌধুরী বললেন, ছোটবেলা থেকেই সাক্রাইন উৎসব উপভোগ করছি। এখনও মন আনন্দে নেচে ওঠে। বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক উৎসবগুলোর এটি একটি জানিয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় মৌলবাদীরা বিভিন্ন সময় ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কাজ হয়নি। প্রাণের টানেই পুরান ঢাকার মানুষ সাক্রাইন উৎসবে মাতে বলে জানান তিনি।
×