ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

রামপাল রূপপুর মাতারবাড়ি ॥ বিরোধীদের অযৌক্তিক দাবি

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

রামপাল রূপপুর মাতারবাড়ি ॥ বিরোধীদের অযৌক্তিক দাবি

‘সর্বপ্রাণ সাংস্কৃতিক শক্তি’ নামের একটি সংগঠন ৭ জানুয়ারি শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণকাজ বাতিলসহ সুন্দরবন রক্ষার দাবিতে কর্মসূচী পালন করে। ওই প্রতিবাদ কর্মসূচীতে জনৈক বক্তার বক্তব্য এখানে উল্লেখ করছি, ‘সরকার সুন্দরবন ধ্বংস করতে ভারতকে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করতে দিচ্ছে; বাঁশখালীতে মানুষ হত্যা করে চীনকে, রূপপুরে ভয়াবহ দূষণকারী পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র রাশিয়াকে এবং বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রকে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করতে দিচ্ছে। দেশের প্রাণ-প্রকৃতি ও জীবন ধ্বংস করে কিছু মুনাফাখোরদের হাতে দেশের সম্পদ বিক্রি করে দিচ্ছে।’ উপযুক্ত বক্তব্যে এটা আবারও প্রমাণিত হলো, এদের প্রতিবাদ কর্মসূচী, সেমিনার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা, টিভি টকশো, নিবন্ধ লেখাজোখা, অনলাইন এ্যাক্টিভিটি- সবই কেবল রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ বিরোধিতায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং সরকারের পুরো জ্বালানিনীতির-ই বিরোধী এক মহাযজ্ঞে (!) নেমেছে এরা। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারের জ্বালানিনীতি হলো, দেশের বিদ্যুত চাহিদার শতকরা ৫০ ভাগ কয়লা থেকে, ২৫ ভাগ গ্যাস থেকে এবং অবশিষ্ট ২৫ ভাগ আসবে নবায়নযোগ্য ও পারমাণবিক উৎস থেকে। মিশ্র জ্বালানি উৎসের নীতি বলে এটি সময়োপযোগী ও বাস্তব পদক্ষেপ। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার নীতি গ্রহণ করে এবং এই নীতি বাস্তবায়নে বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ করছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। এদিকে সরকার প্রণীত এই জ্বালানিনীতির বিশেষত্ব হলো, এতে পারমাণবিক উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের অপশন যুক্ত হওয়া। এটি একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুত উৎপাদনে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ‘নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি’ ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছে। যা হোক, দেশের জ্বালানিনীতিতে তথা বিদ্যুত উৎপাদন পরিকল্পনা যাতে বাস্তবায়িত না হতে পারে, সে জন্যই এরা বিরোধিতায় নেমেছে। এক্ষেত্রে তারা আপাতত বেছে নিয়েছে আমাদের আবেগের জায়গা সুন্দরবন আর পরমাণুভীতিকে। কেউ যদি প্রশ্ন করে কয়লা আর নিউক্লিয়ার উৎস বাদ দিলে দেশের বিদ্যুত চাহিদার সমাধান কীভাবে হবে? বিজ্ঞের মতো জবাব : ‘কেন, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের অপার সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে।’ এখন দেখা যাক, দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের সম্ভাবনা কতখানি? বাতাস, নদীর পানিপ্রবাহ, সমুদ্রস্রোত ও ঢেউ, ভূ-অভ্যন্তরের তাপ নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহারে বিদ্যুত উৎপাদনের বাস্তবতা আমাদের দেশে নেই। তাই বাংলাদেশে সৌরশক্তি-ই প্রধান নবায়নযোগ্য উৎস। এর আবার সমস্যা আছে। যেমন, এক মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুত উৎপাদনে ৪ থেকে ৫ একর খোলা জায়গা দরকার। স্বল্পভূমির জনসংখ্যার দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এত জায়গা কোথায়? দ্বিতীয়ত, সৌরবিদ্যুত সূর্যালোকের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধায় এই বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করলে সরবরাহের ওঠানামায় কারিগরি অসামঞ্জস্য দেখা দেবে, যা সমাধানে স্মার্ট গ্রিড প্রয়োজন পড়বে। তৃতীয়ত. সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। তাই সরকারকে এক্ষেত্রে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হবে। তারপরও বর্তমান জ্বালানিনীতিতে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ সৌর ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু দেশের জ্বালানিনীতিবিরোধীর দাবি করছে বিদ্যুত উৎপাদনের সব অপশন বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য বিশেষত সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমেই নাকি বিদ্যুত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? সূর্যই নাকি আমাদের শেষ ভরসা! এখন দেখা যাক, তাদের এই প্রচারণার বাস্তব উদাহরণ পৃথিবীর কোথাও আছে কি? চীনের মোট বিদ্যুতের মাত্র শতকরা ৩ ভাগ আসে সৌর বিদ্যুত থেকে। জার্মানির উদাহরণ দিতে দিতে তো বাংলাদেশের কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুত উৎপাদনবিরোধীরা মুখে ফেনা তুলছে। কিন্তু সেই জার্মানির অবস্থা কি তা দেখা যাক। সেখানে ২০১৫ সালেও মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকরা ৪৪ ভাগ ছিল কয়লা উৎস থেকে। আর পানি, বাতাস সৌর ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য উৎস থেকে এসেছে মাত্র শতকরা ৩১ ভাগ। সেখানেও দেখা যায়, জার্মানির বাসাবাড়ির ছাদে বিদ্যুত উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে যে ভর্তুকি দিত, তা অনেকটা সঙ্কুচিত করেছে সরকার। কিন্তু রামপাল ও রূপপুর প্রকারান্তরে উন্নয়নবিরোধীরা বলছে, জার্মানির মোট বিদ্যুতের শতকরা ৭৮ ভাগ আসে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে। আসলে এরা মিথ্যা তথ্য দিয়ে দেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করতে কতটা শঠতার আশ্রয় নিতে পারে উপযুক্ত তথ্যই এর বাস্তব প্রমাণ। রামপালবিরোধীরা দাবি করছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রটি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করবে এমনকি বনের গাছগুলোও নাকি অঙ্গার হয়ে যাবে, নদীর পানি বিষাক্ত হবে। কিন্তু সুন্দরবনের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রটি কোথায় নির্মিত হতে যাচ্ছেÑ তা কি তারা ভেবে দেখেছেন? সুন্দরবন চারটি রেঞ্জে বিভক্তÑশরণখোলা, চাঁদপাই, খুলনা (নলিয়ান) ও সাতক্ষীরা (বুড়িগোয়ালিনী)। আর রামপালের অবস্থান তো সুন্দরবনের পূর্বপ্রান্ত থেকে ১৪ কি. মি. দূরত্বে। সুন্দরবনের অভ্যন্তর দিয়ে নদী ও খালসমূহ সাধারণভাবে উত্তর-দক্ষিণ দিকে জোয়ার-ভাটায় প্রবহমান। এসব নদী দিয়েই মংলাবন্দরে জাহাজ চলাচল করে। বছরের শীতকালেই মাত্র উত্তরদিক থেকে বায়ু দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে শীতকালের ব্যাপ্তিও স্বল্প। তারপরও দেশী-বিদেশী ভাড়াটে বিশেষজ্ঞ দিয়ে রামপাল তথা উন্নয়নবিরোধীরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে বা হিসাব কষে বের করছে রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র হলে আণুবীক্ষণিক কী-কী ক্ষতি হবে। তা ফলাও করে প্রচারণায় নেমেছে প্রচারসংখ্যায় শীর্ষে বিশেষ একটি মিডিয়া। যদি কোন উন্নয়নে আণুবীক্ষণিক ও অনপুঙ্খ এসব দিক আমলে নেয়া হয়, তাহলে কোন উন্নয়নই করা সম্ভব নয়। যেমন, পদ্মা সেতু করতে গিয়ে আমাদের নদী শাসন করতে হচ্ছে। এখন পরিবেশবাদী নদীপ্রেমিকরা যদি দাবি করে নদীকে শাসন করা যাবে না, তাহলে তো পদ্মা সেতুও করা যাবে না। বলা হচ্ছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র ভয়াবহ দূষণকারী। এই তত্ত্বটি তিনি কোথায় পেলেন? কারণ আমার জানা মতে, তিনি তো অর্থনীতিবিদ, নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী নন। আসলে আমাদের বুঝতে হবে সুন্দরবন, পরিবেশ, ইকোলজি, নদী প্রভৃতি ইস্যু নয়, বরং এসবের আড়ালে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিদ্যুত খাতে এগিয়ে যাক, উন্নয়ন টেকসই হোক- তা থামানোর পাঁয়তারা চলছে। সেমিনার, মানববন্ধন, মিছিল, মিটিংয়ে এই ষড়যন্ত্রের যতটুকু দৃশ্যমান, অদৃশ্য তার চাইতে অনেক বেশি। লেখক : বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক
×