ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

নবীন চিকিৎসকদের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

নবীন চিকিৎসকদের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত

আমরা আজ যারা ডাক্তার, তারা সবাই জীবনে তিনবার ডাক্তার হয়েছি। ১মবার ডাক্তার হয়েছি যে দিন মেডিক্যাল কলেজে নবীনবরণে সংবর্ধিত হয়েছি চিকিৎসা পেশার গর্ব সাদা এপ্রোণ পরে। দ্বিতীয়বার ডাক্তার হয়েছি যখন তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করে স্ট্যাথো (ঝঃবঃযড়) গলায় ঝুলিয়ে প্রথম দিনের মতো রোগীর পাশে বসে, রোগীর রোগের ইতিহাস শুনেছি এবং স্ট্যাথোস্কোপকে গলায় কতরকমভাবে ঝুলিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেমন লাগছে কতবার দেখেছি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একই সঙ্গে দ্বিতীয় বার ডাক্তার হওয়ার পরে যেই রোগীকে দেখেছি মনে হচ্ছে সেই রোগ আমাদের মধ্যেও আছে। তৃতীয়বার ডাক্তার হই সত্যিই যখন শেষ পর্ব এমবিবিএস পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ইন-সার্ভিস ট্রেইনীতে যোগদান করি। আমরা সত্যিই ছিলাম ভাগ্যবান। পাস করা মাত্রই তখনকার ৫ম গ্রেডে ১ম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসারের মর্যাদায় চাকরি পেয়েছি। যদিও পরবর্তীতে সরকারী কর্মকমিশনের মাধ্যমে নিয়মিত হতে হয়েছে। এবার নবীনদের উদ্দেশে কিছু বলছি- উড়পঃড়ৎ শব্দটি ল্যাটিন উড়পবৎব শব্দ থেকে সংগৃহীত। যার অর্থ ‘ডাক্তার হলো একজন শিক্ষক এবং অত্যন্ত প-িত এবং অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারেন এবং যিনি সমাজকে স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা এবং সামাজিক শিক্ষা দিতে পারেন।’ আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০ সালে চিকিৎসকদের জন্য এক শপথবাক্য প্রবর্তিত হয়, যা চিকিৎসা জগতের ঈশ্বর হিপোক্র্যাটিসের নাম অনুসারে হিপোক্রেটিক শপথ হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র স্বীকৃত। যা হলো আমাদের পেশার ছাত্র-শিক্ষকের মূলমন্ত্র। এই হিপোক্র্যাট শপথ বাণীই বর্ধিত কলেবরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ, যখন জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো শাখা মেলে এবং এর একটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যা বা ডঐঙ হয়, তখন ১৯৪৮ সালে জেনেভা ডিক্লারেশন হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীতে অবশ্যই ১৯৬৪ সালে আমেরিকান Tuft University তার পূর্ণাঙ্গ একটা রূপ দান করে, যা হিপোক্রেটিক অউথ টুডে (Hippocratic oath today) নামে পরিচিতি লাভ করে। আশা করব তোমরা সবাই এই শপথবাক্যগুলো পাঠ করবে এবং মনে-প্রাণে তা পালন করতে সচেষ্ট থাকবে। ডাক্তারদের সম্পর্কে অনেক মনীষীর অনেক সুন্দর, প্রশংসাসূচক, হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য আছে। তাদের মধ্য থেকে আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান হলো Voltaire মন্তব্য। Voltaire (১৬৯৪-১৭৭৮) যিনি একজন ফরাসী লেখক এবং ইতিহাসবিদ, তিনি ডাক্তারদের সম্পর্কে যে মতামত দিয়েছিলেন তা হলো :Men who are occupied in the restoration of health to other men, by the joint exertion of skill and humanity, are above all the great of the earth. They even partake of divinity, since to preserve and renew is almost as noble as to create.” অর্থাৎ যে ব্যক্তি অন্য কোন ব্যক্তির স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিজের দক্ষতা ও মানবিকতা দিয়ে সেবাদান করে, সে এই ভূপৃষ্ঠের সব কিছুর ঊর্ধ্বে। এমনকি তারা স্বর্গের অংশীদার, যেহেতু কারও স্বাস্থ্য সুরক্ষা অথবা অসুস্থ ব্যক্তিতে সুস্থ করা, একজনকে নতুন জীবনদান করার নামান্তর। চিকিৎসা পেশার একজন চিকিৎসক তার সমস্ত কর্ম বৈদিক আর লৌকিক স্রষ্টার নামে অর্পণ বা উৎসর্গ করে তারই ভৃত্য বোধে তারই কর্ম, তারই সন্তুষ্টির জন্য অর্পণ করেন, তিনিই স্রষ্টার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব। আর সেই সুবর্ণ সুযোগ শুধু ডাক্তারদের আছে। সর্বপ্রকার আসক্তি ত্যাগ করতে হবে, চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র ও ডাক্তারদের একমাত্র স্রষ্টাই পরমগতি। এই দৃঢ় চিত্ত ও মনস্থির করে ঐকান্তিক দৃঢ়তার সঙ্গে সর্বপ্রকারে সৃষ্টির পূজা করতে হবে। মনে রাখবে রোগী, জীব, বৃক্ষরাজি সবই মানুষের সেবা পাবার যোগ্য, পক্ষান্তরে তারা মানুষের অনেক উপকারে লাগে। জীবের প্রতি অবজ্ঞা, ঘৃণা বা বৈরীভাব পোষণ করলে স্রষ্টার প্রীতি বা ঈশ্বরপ্রীতি লাভ হয় না। সম্যক জ্ঞান, রোগীর প্রতি ভক্তি এবং স্রষ্টার সেবা অর্থাৎ রোগীর সেবার নিমিত্তে যথাপ্রাপ্ত নিয়ত : কর্মসম্পাদন কর। মনে রাখা দরকার ডাক্তার হিসেবে নিজের যেমন আত্মসম্মানবোধ আছে, তেমনি রোগীরাও তাদের ফরমহরঃু (মূল্যবোধ), জবংঢ়বপঃ (সম্মান), চৎরাধপু (গোপনীয়তা) সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে আসে তখন সে অসহায়। মানসিক এবং শারীরিকভাবে দুর্বল। তাই সেই অসহায়ত্ব বা দুর্বলতার সুযোগ কোন চিকিৎসক কখনও নেবে না। যদি সেই সুযোগ নেয়া হয় তাহলে তা হবে প্রতারণার শামিল। কখনও কোন রোগীকে ক্রেতা বা খরিদ্দার মনে করবে না। চিকিৎসাসেবা একটি পেশা, এটা কখনও ব্যবসা নয়। তাও মনে রাখতে হবে, ‘শিক্ষা ও চিকিৎসা যদি পণ্য হয়ে যায় তবে তার গুণগতমান থাকে না’। পেশার সম্মান বজায় রাখতে হলে সবাইকে সুউচ্চ নৈতিকতার অধিকারী হতে হবে। চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে একজন ক্ষুদ্র সেবাদানকারী মনে করতে হবে, রোগীকে দিতে হবে অতিথি বা দেবতার মর্যাদা এবং হাসপাতালকে মনে-প্রাণে, মনে-ধ্যানে একটি উপাসনালয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তখন ডাক্তারের ভূমিকা হবে পূজারীর। অর্থাৎ ডাক্তার হিসেবে হতে হবে পূজারী, রোগী হবে অতিথি বা দেবতা আর হাসপাতাল হলো উপাসনালয় বা মন্দির। হাসপাতাল একটি পবিত্র জায়গা। অতীতে কখনও, এমনকি যুদ্ধকালীন সময়েও হাসপাতালে বোমা নিক্ষেপ করা হতো না। তাই তার পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব চিকিৎসকসহ চিকিৎসা পেশায় সেবাদানকারী প্রত্যেকের। ডাক্তারদের সম্পর্কে স্যার উইলিয়াম অসলারের (William Osler) দুটি প্রণিধানযোগ্য উক্তি হলো Patient does not care how much you know until they know how much you care”. সুতরাং চিকিৎসক কত জানে সেটা রোগীর কাছে বিচার্য নয়, রোগীর কাছে বিচার্য হলো রোগীকে কি পরিমাণ সম্মান ও যতœ দিয়ে পরিচর্যা করা হলো। দ্বিতীয়টি হলো A doctor is a student till his death, when he fails to be a student he dies” অর্থাৎ একজন চিকিৎসককে নিত্য-নতুন রোগ, নিত্য-নতুন চিকিৎসা সম্বন্ধে জানতে হলে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত লেখাপড়া করতে হবে, অর্থাৎ ছাত্রের মতোই হবে তার জীবন, আর এক্ষেত্রে সে যদি ব্যর্থ হয় তাহলে ধরে নিতে হবে চিকিৎসক হিসেবে সে মৃত। পৃথিবীতে বা ইহজগতে Nothing is Secret, Nothing is impossible, No body indispensable অর্থাৎ তোমরা জেনে রেখ পৃথিবীতে কোন কিছুই গোপনীয় নহে, যদি কিছু গোপনীয় থাকত তাহলে সিআইএর দলিল হাওয়ায় ভাসত না। অসম্ভব বলে তারুণ্যের কাছে কিছুই নেই এবং প্রত্যেকেরই বিকল্প আছে। Col Dr. Lukis (১৯০৫) অধ্যক্ষ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়কে বলেছিলেন সেই হবে সবচেয়ে বড় এবং ভাল ডাক্তার যার তিনটি গুণ আছে:- 1.A heart that never hardens. অর্থাৎ যে হৃদয় কখনও কঠোর হয় না। 2.A temper that never tires অর্থাৎ যে মেজাজে কখনও ক্লান্তি আসে না। 3.A touch that never hurts অর্থাৎ যার হাতের স্পর্শ কখনও কাউকে কোন ব্যথা দেবে না। সর্বশেষ আমি মহামতি লেনিনের সেই অমোঘ বাণী Read, Read & Read ‘পড়, পড় এবং পড়’ এই অমোঘ বাণীটি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। তিনিও সেটা উপলব্ধি করেছিলেন, যখন ফ্যাসিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে পরাস্ত করে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দেশ গড়তে চেয়েছিলেন। তখন তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন শিক্ষা ও প্রযুক্তি অর্জন ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর শিক্ষা ও প্রযুক্তি অর্জন করতে হলে লেখাপড়ার কোন বিকল্প নেই, বরং এটাই একটা অবলম্বন। মাদার তেরেসার অমোঘ বাণী “এরাব, এরাব, এরাব ঁহঃরষ রঃ যঁৎঃং” তোমরা ডাক্তার হবে মনে-প্রাণে মাদার তেরেসার সেই অমোঘ বাণীকে শুধু অন্তরে লালন করবে না, ব্যক্তি জীবনে প্রয়োগ করতে সচেষ্ট থাকবে। মনে রাখবে আমরা যখন জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসি, এসেছি শূন্য হাতে আবার যখন বিদায় নেব তখনও শূন্য হাতেই ফিরে যাব। যদিও জন্মের পরে কখনও কখনও হাত মুষ্টিবদ্ধ থাকে; কিন্তু মৃত্যুর সময় হাত সমতল অর্থাৎ ফ্ল্যাট থাকে। মনে রাখবে Patient does not bother wheather it is allopathy or Homeopathy, his demand is empathy & sympathy. নবীন চিকিৎসকদের মনে রাখা দরকার এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তাদের সামনে অপেক্ষা করছে। আঠারো বা উনিশ বছর বয়সে তোমরা প্রতিজ্ঞা কর ভবিষ্যতে কি হতে চাও এবং কঠোর পরিশ্রম ও সুউচ্চ নৈতিকতার মাধ্যমে তা অর্জন করতে চেষ্টা কর এবং যতক্ষণ পর্যন্ত ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পার, কঠোর পরিশ্রম করে এমনকি যুদ্ধ করে তা অর্জন কর। জয় হোক তারুণ্যের। জয় হোক চিকিৎসা পেশার। জয় হোক মানবতার। [লেখাটি উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ ও অভিষেক অনুষ্ঠানে পদত্ত ভাষণের সারসংক্ষেপ] লেখক : ভাইস চ্যান্সেলর (সাবেক) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×