ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

দুই পা এগোই আর এক পা পিছাই

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ১৫ জানুয়ারি ২০১৭

দুই পা এগোই আর এক পা পিছাই

বাঙালী জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রামটা শুরু হয়েছে অনেক আগে, প্রায় সত্তর-ঊনসত্তর বছর হয়ে গেল, যখন ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলার এক সূর্যসন্তান কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংসদ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠলেন, রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের বুলি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিতে হবে। তখন পাকিস্তানের পাঞ্জাবী শাসকরা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ভারতের দালাল আর পাকিস্তানের শত্রু ও ইসলামের দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনেন। কিন্তু বঙ্গ সন্তানদের অব্যাহত অদম্য সংগ্রামের ফলে ১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। সূচিত হয় বাঙালীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের পথে প্রথম বিজয়। তারপর থেকে এ পর্যন্ত এগোনো আর পিছানোর মধ্য দিয়ে এখনো আমরা চূড়ান্ত মুক্তির পথে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে আমরা একবার বিজয়ের মহাসড়কে উঠলেও পাঁচত্তরে আবার ছিটকে পড়ি। তারপর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয় দফা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনেক দূর এগোলেও এ সময়ে মুক্তির অগ্রযাত্রা নিরবচ্ছিন্ন থাকেনি। সাম্প্রদায়িকতার বিষপাপ ও সামরিকতন্ত্রের রাজনীতি থেকে মুক্তি, এটাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ও মৌলিক লক্ষ্য থাকায় স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ করা হয়Ñ এটা হচ্ছে গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার পূর্বশর্ত। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় দর্শন হঠাৎ করে আসেনি বা নতুন কোন তত্ত্ব নয়। দীর্ঘ ইতিহাসের পাঠ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পাকিস্তানের ২৩ বছরে রাজনীতিতে ও রাষ্ট্রপরিচালনায় ধর্মকে টেনে আনার ফলে ধর্ম, রাজনীতি, রাষ্ট্র সবকিছুতেই আমরা কলুষিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখেছি। ধর্মের চরম অবমাননা হয়েছে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রও থাকেনি। ইউরোপের ইতিহাসপাঠ আরও ভয়াবহতার কথা বলে। রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, মধ্যযুগের ক্রুসেড (১০৯৬-১৪৯২), রোমান সম্রাট চার্লস পঞ্চম কর্তৃক ধর্ম নিয়ে চরম বাড়াবাড়ির ফলে রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়ে ১৫২৯ সালে খ্রিস্টধর্মের বিভাজন ও প্রোটেস্ট্যান্টদের আবির্ভাব, ১৬৬১ সালে ফ্রান্সের রাজা লুইস চতুর্দশ কর্তৃক ‘আই এ্যাম দ্য স্টেট’ ঘোষণা এবং তার জের ধরে ফ্রেন্স বিপ্লবের ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যায় রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মের প্রাধান্য মানবতা, ধর্ম ও রাষ্ট্র, সবকিছুকেই বিনষ্ট করেছে। তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে ইউরোপ রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করতে পারায় তারা এক সময়ে সারা বিশ্ব শাসন করেছে এবং উন্নতির শিখরে উঠেছে। সভ্যতা, গণতন্ত্র, মানবতা ও উন্নয়ন সবকিছুর উদাহরণ এখনও ইউরোপ। ইতিহাসের আলোকেই স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বানিয়েছিলেন। কিন্তু সে যাত্রা বেশিদূর এগোতে পারেনি। নিজেদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং যথেষ্ট প্রস্তুতির অভাবে ১৯৭৫ সালের আগস্টে প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির আঘাতের ধাক্কায় কয়েক দশক পিছিয়ে গিয়ে আবার আমরা পাকিস্তানের মতো ধর্মীয় উম্মাদনার মধ্যে ঢুকে পড়ি। অর্থাৎ, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হওয়ার মাধ্যমে মুক্তির পথে যতটুকু এগিয়েছিলাম, পঁচাত্তরের ঘটনার মধ্য দিয়ে আবার ততটুকু পিছিয়ে যাই। আবার শুরু হয় সংগ্রাম। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে সংগ্রামে গতি আসে এবং ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসায় মুক্তির পথে নতুন আশার সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেবারও বেশিদূর এগোনো যায়নি। ২০০১-২০০৬ ছিল পিছনের দিকে হাঁটার কাল। এই সময়ে বাংলাদেশের জন্মের পর এ যাবতকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িকতার বহির্প্রকাশ ঘটে। পরিকল্পিতভাবে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ ও নির্যাতন চালানো হয়, যাতে তারা দেশ ছেড়ে চলে যায়। অনেকে মনে করেন তখন ধর্মীয় অপশক্তির প্রতিরূপ জামায়াত নেতারা মন্ত্রী হওয়ায় এমন চরম বিপর্যয় ঘটে। ২০০৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটা নিরবচ্ছিন্ন যাত্রা অব্যাহত থাকায় রাষ্ট্র পরিচালনা, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জায়গায় দেশ একটি ইতিবাচক টার্নিং পয়েন্টে পৌঁছেছে। এই টার্নিং পূর্ণ ও সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার জন্য বাস্তবতার নিরিখে যতটুকু সময়ের প্রয়োজন তত সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে রাজনীতি পরিপূর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরে আসবে এবং তখন এর গুণগত পরিবর্তনও হবে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে দেশ শক্তিশালী অবস্থানে আসবে। এই লক্ষ্য অর্জনে ও সেটিকে টেকসই করার জন্য জাতীয় মানস কাঠামোকে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের ওপর দাঁড় করানো আবশ্যক। এই লক্ষ্যে ২০০৯ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি, পাঠক্রম ও পাঠ্য পুস্তক সংস্কারের জন্য পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের দর্শনে সমৃদ্ধ শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়। দলমত নির্বিশেষে মানুষ সেটিকে স্বাগত জানায় এবং আশাবাদী হয়ে ওঠে। ক্ষুদ্র জায়গা থেকে আমি নিজেও তখন একাধিকবার লিখেছি যে, নতুন শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রমে শিক্ষিত তরুণরা যখন বাংলাদেশের দায়িত্ব নেবে তখন আমাদেরকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না। কিন্তু গত কয়েকদিনের একটি খবরে দেশের মানুষের সঙ্গে আমিও আশাহত হয়েছি। ৭ জানুয়ারিতে জনকণ্ঠের প্রধান হেডলাইন ছিলÑ মৌলবাদের উগ্রপন্থা আর ভুলে ভরা পাঠ্যবই। তারপর ১০ জানুয়ারির হেডলাইনÑ কেলেঙ্কারির নেপথ্যে পাঠ্যবই দায়িত্বে বিএনপি-জামায়াত জোটের আস্থাভাজনরা। প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, জামায়াত-বিএনপি সময়ে প্রণীত নীতি অনুসারে ২০০৩ থেকে ২০১২ পর্যন্ত পড়ানো হয়েছে, কিন্তু বর্তমান সরকারের নতুন নীতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ২০১৩-২০১৬ পর্যন্ত পড়ানো হয়নি এমন ১০টি গদ্য-পদ্য বিভিন্ন শ্রেণীর বাংলা বইয়ে ফিরে এসেছে। তাতে জামায়াত-বিএনপি আমলের মতোই জামায়াত মদদপুষ্ট হেফাজতসহ উগ্রবাদী গোষ্ঠীর চাওয়াই পাঠ্যবইয়ে এবার পূরণ করা হয়েছে। এর সরল অর্থ দাঁড়ায়, ২০১৩ সালে কার্যকর হওয়া শিক্ষানীতি নিয়ে আমাদের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল সেখান থেকে আবার ব্যাক টু স্কয়ার ওয়ান। জাতীয় মানসতন্ত্র গঠনে অত্যন্ত ভাইটাল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্য পুস্তকে জামায়াত-হেফাজতের চাহিদা পূরণ হলে তার পরিণতি হবে পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের মতো। এ সম্পর্কে বেশি যুক্তি এবং ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন নেই। পত্রিকার খবর অনুসারে তালিকা থেকে রবীন্দ্রনাথের লেখাও বাদ পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এতবড় স্পর্ধা কারা দেখায়! রবীন্দ্রনাথ না থাকলে তো বাঙালী জাতি ও বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকে না। বিদেশে বসেও দেখছি এটা নিয়ে দেশের ভেতরে তোলপাড় হচ্ছে। এটিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টার খবরও পাচ্ছি। এর জন্য দায়ীদের কেবল ওএসডি অথবা বদলি করে ছেড়ে দেয়া হলে প্রশাসনের মধ্যে ছদ্মবেশী জামায়াত-হেফাজতীরা আরও উৎসাহিত হবে। কারণ, তারা ভাববে এই ওএসডি এবং বদলি পত্রটিই হয়ত আগামীতে একদিন তাদের জন্য আশীর্বাদ হবে। উচিত হবে, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের দ্বারা নির্মোহ তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। তা না হলে ভবিষ্যতে এর থেকে আরও ভয়ঙ্কর কাজ তারা করবে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সংঘবদ্ধ আক্রমণের ঘটনায় আওয়ামী লীগের একজন দলীয় জেলা প্রধান কাম সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বিশ্বাস করার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এসব নেতা শুধু এমপি, মন্ত্রী হওয়ার জন্য আদর্শ, দল, দেশ, জাতি এবং দলের নেতৃত্বকে বলি দিতে দ্বিধাবোধ করে না। এদের মুখে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের জন্য জান কোরবানির কথা ফাঁকাবুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। আশার কথা, প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিয়েছেন এবং ইতোমধ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের জেলে ঢুকিয়েছেন। এটি নিঃসন্দেহে অগ্রগমনের খবর। তবে ঘটনার মূল মাস্টারমাইন্ডকে জবাবদিহির আওতায় না আনলে এ ধরনের নেতারা দলের জন্য ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে, সঙ্কট সৃষ্টি করবে। অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মানুষ এখন নিরবচ্ছিন্ন অগ্রযাত্রা দেখতে চায়। এ যাত্রায় পাঠ্য পুস্তক কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত সামনের ও পিছনের অপশক্তির সঙ্গে আপোস করে কোন লাভ হবে না। এর মধ্যে আরেকটি অগ্রগমনের খবর পেলাম, জামায়াত মুক্ত করে মূলধারায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে ইসলামী ব্যাংককে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ও জঙ্গীমুক্ত সমাজ নির্মাণে এই পদক্ষেপ সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে। এটি অবশ্যই আরেক পা এগিয়ে যাওয়ার সংবাদ। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। নিউ অরলিনস, ইউএসএ থেকে
×