ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের মদদ দেয়ার অভিযোগ

খোলস পাল্টাচ্ছে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের সংগঠন

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

খোলস পাল্টাচ্ছে আটকে পড়া পাকিস্তানীদের সংগঠন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ খোলস পাল্টাচ্ছে বাংলাদেশে বসবাসকারী উর্দুভাষী অবাঙালীদের সংগঠন এসপিজিআরসি (স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানীজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশনস কমিটি)। সংগঠনটির নামের সঙ্গে পাকিস্তানের গন্ধ থাকায় অনেকটা জোরেশোরেই চলছে সংগঠনটির খোলস পাল্টানোর প্রক্রিয়া। সংগঠনটির বর্তমান ও সাবেক নেতাকর্মীদের অনেকের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধীদের সরাসরি সহযোগিতা ও মদদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। পুরনো সেই ক্ষত ঢাকতে এবং বর্তমান প্রজন্মের চাপের মুখেই এমন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই এসপিজিআরসি নামেরও পরিবর্তন আসছে। এটি সংগঠনটির কৌশলী কোন উদ্যোগ কিনা তা নিশ্চিত নয়। যদিও সংগঠনটির তরফ থেকে বলা হচ্ছে, তারা সত্যিকার অর্থেই সংগঠনটি পুনর্গঠন করতে যাচ্ছেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই সংগঠনটি ঢেলে সাজানো হচ্ছে। সে মোতাবেক সারাদেশে থাকা এসপিজিআরসির ২২টি শাখায় একযোগে কাজ চলছে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য। জানা গেছে, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় উর্দুভাষী নাগরিকদের প্রায় শতভাগই পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। তাদের পাকিস্তানে পনর্বাসন করার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর এসপিজিআরসি নামের সংগঠনটির সৃষ্টি হয়। যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন প্রয়াত নাসিম খান। এসপিজিআরসির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রয়াত নাসিম খান, সংগঠনটির বতর্মান সভাপতি জব্বার খান, সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারুণ অর রশীদসহ অনেকের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধীদের সরাসরি মদদ ও সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি তিনি জানার পর এসপিজিআরসি ছেড়ে দেন। স্বাধীনতার পক্ষের উর্দুভাষী অবাঙালীদের নিয়ে তারা মোহাজির ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন নামের সংগঠনটি সৃষ্টি করেন। তিনি এই সংগঠনের সভাপতি এবং অসি আহমেদ সাধারণ সম্পাদক। তারা যুদ্ধাপরাধী ও তাদের উর্দুভাষী অবাঙালীসহ সকল সহযোগীর বিচার দাবি করেন। যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগিতা করার অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে এসপিজিআরসির সভাপতি জব্বার খান জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি কোন দিনই পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেননি। করবেনও না। তিনি সব যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সহযোগীদের বিচার দাবি করেন। এসপিজিআরসির বর্তমান বা সাবেক কোন নেতা বা কর্মী যদি যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকে বা যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগিতা করে থাকে, তাদের বিচার হওয়া দরকার। সে যেই হউক না কেন। এসপিজিআরসি পুনর্গঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, নামটির সঙ্গে পাকিস্তানের গন্ধ আছে। তারা যেহেতু আর পাকিস্তানে যেতে চান না, তাই তারা সংগঠনটি পুনর্গঠন করতে চান। বিষয়টি তারা দেশের ১৩ জেলায় থাকা এসপিজিআরসির ২২টি শাখাকে অবহিত করেছেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই এসপিজিআরসি নাম পরিবর্তনসহ অনেক কিছুরই পরিবর্তন হচ্ছে। এ বিষয়ে সংগঠনের ভেতরে আলাপ আলোচনা চলছে। নাম পরিবর্তন বা পুনর্গঠনের সঙ্গে অন্য কোন কিছুর পরিবর্তন বা পরিমার্জনের কোন সম্পর্ক নেই। এটি সংগঠনের কৌশলী কোন পদক্ষেপ নয় বলেও তিনি দাবি করেন। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আধুনিক ব্যাংকিং ধারায় ব্যাংকটিকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। এসপিজিআরসির সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগিতা করার অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সহযোগীদের বরাবরই বিচার দাবি করে আসছি। এসপিজিআরসির পুনর্গঠনসহ নাম পরিবর্তনের বিষয়ে জোরালো আলোচনা চলছে। কারণ নামটির সঙ্গে পাকিস্তান কথাটি রয়েছে। যা তাদের প্রায়ই সরকারের বিভিন্ন মহলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে। এজন্য নামটির পরিবর্তন পরিমার্জন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই নামটির পরিবর্তন আসছে বলেও তিনি জানান। তবে সংগঠনটির নতুন নাম কি হবে, তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। সারাদেশের এসপিজিআরসির নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করে নতুন নাম ঠিক করা হবে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির জনকণ্ঠকে বলেছেন, উর্দভাষী অবাঙালীদের অনেকের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধীদের নানাভাবে সহযোগিতা করা, মদদ দেয়া এবং সশরীরে উপস্থিত থেকে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিচারের মুখোমুখি করা উচিত। তবে যারা জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হয়েছেন, তাদের বিষয়টি ভিন্ন। জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া উর্দুভাষী অবাঙালীদের বহু ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা পূর্ব পুরুষের দায় নিতে নারাজ। তাদেরই একজন এসপিজিআরসির সভাপতি জব্বার খানের ছেলে মোর্তজা আহমেদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছি। জন্মসূত্রে আমি এ দেশের নাগরিক। আমি স্বাধীনতা বিশ্বাস করি। স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করছি। আমি কেন আমার পূর্ব পুরুষের অপকর্মের দায় নেব? আমি আমার পূর্ব পুরুষের দায় নিতে নারাজ। পূর্ব পুরুষদের কেউ যদি স্বাধীনতার বিরোধিতা করে থাকে, পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করে থাকে, অবশ্যই তাদের বিচার হওয়া উচিত। সে আমার বাপ হলেও, কোন অসুবিধা নেই। তিনি আরও বলেন, আমি এক সময় ওব্যাট হেল্পার্স নামের এনজিওটিতে কর্মরত ছিলাম। এনজিওটি উর্দভাষী অবাঙালীদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে কাজ করছে। বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই অষ্টম শ্রেণী পাস করেই ঝরে পড়ে। এর অন্যতম প্রধান কারণ পরিবেশ ও আর্থিক অভাব। কারণ ছেলেমেয়েরা ক্যাম্পের নোংরা ও মাদকদ্রব্যের ছড়াছড়ির মধ্যে বড় হচ্ছে। ফলে এক সময় ছেলেমেয়েরা মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আর পড়াশুনা হয় না। যদিও সরকার ক্যাম্পের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার পথ খুলে দিয়েছে। ছেলেমেয়েরা যেকোন স্কুলে যোগ্যতা অনুযায়ী ভর্তি হতে পারে। কিন্তু নানা কারণে সেটি আর হয়ে ওঠে না। এজন্য ক্যাম্পের অর্ধেক মানুষ শিক্ষিত হলেও উচ্চ শিক্ষিতের হার মাত্র শতকরা ৫ থেকে ৭ ভাগ। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের দ্রুত পুনর্বাসন করা হলে, বর্তমান প্রজন্ম শিক্ষিত হয়ে দেশ গড়ার কাজে অংশ নিতে পারবে। অন্তত দেশের বোঝা হয়ে থাকবে না। জানা গেছে, ক্যাম্পগুলোতে উর্দভাষী অবাঙালীদেরই তৈরি অন্তত ২০টি সংগঠন কাজ করছে। এসব সংগঠনের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের অনেকেই উর্দভাষীদের পুনর্বাসনের পক্ষে নয়। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনেক এনজিও। এসব সংগঠন ও এনজিওগুলো উর্দুভাষীদের পুনর্বাসনের নাম করে বিদেশ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ এনে পকেট ভারি করছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তির পর ১৯৯২ সালে ৩২৫ জন পাকিস্তানে পুনর্বাসিত হওয়ার পর থেকে এ প্রক্রিয়া আরও জোরালো হয়েছে। বিশেষ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উচ্চ আদালতের নির্দেশে বাংলাদেশে জন্ম নেয়াদের তালিকাভুক্ত করা হয়। এরপর থেকেই উর্দভাষী অবাঙালীদের পুনর্বাসনসহ নাগরিক সুযোগ সুবিধা লাভের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় চলে আসে। অন্যদিকে পাকিস্তান সরকার উর্দুভাষী অবাঙালীদের আর নেবে না বলে জানিয়ে দেয়। এরপর থেকেই উর্দভাষী বিভিন্ন সংগঠন ও এনজিওগুলো বাংলাদেশেই প্রায় পাঁচ লাখ উর্দভাষী অবাঙালীকে পুনর্বাসনের কথা বলে বিভিন্ন দেশ থেকে কোটি কোটি ডলার আনছে। যার অধিকাংশই আত্মসাত হচ্ছে।
×