ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নানারকম পণ্যে মিলছে মূল্যছাড়ের সুবিধা

বাণিজ্যমেলায় ছুটির দিনে মানুষের ঢল

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

বাণিজ্যমেলায় ছুটির দিনে মানুষের ঢল

ওয়াজেদ হীরা ॥ জমজমাট বললে একটু কম হয়ে যাবে! এ যেন মানুষের এক ‘মিলনমেলা’। সব বয়সী মানুষের আগ্রহ আর ছুটির দিনের অতিরিক্ত জনসমাগমে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা পরিণত হয় মানুষের মিলনমেলায়। কেউ এসেছেন কিনতে, কেউ দেখতে। প্রত্যাশিত পণ্য পেতে এক স্টল থেকে অন্য স্টলে ছুটছেন ক্রেতা। কেউ কেউ এসেছেন বন্ধুদের সাথে। আবার কেউ এসেছেন পরিবারের সাথে পারিবারিক বন্ধন অটুট রেখে। উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও গন্তব্য এসে মিলেছে এই বাণিজ্যমেলাতেই। আর সেই একটি গন্তব্য হওয়ার কারণে ভিড় যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে আশপাশ সড়কে জটও। মেলা শুরু হওয়ার পর এটি ছিল দ্বিতীয় শুক্রবার। ছুটির দিনে এমতিইে ভিড় একটু বাড়ে আর মেলার মাঝামাঝি সময়ে এসে সেটা পরিণত হলো উপচেপড়া ভিড়ে। টিকেটে লাইন, প্রবেশে লাইন আর কোন স্টলে দেখতেও ঠেলাঠেলি। সব দিকে মানুষ আর মানুষ। মানুষের ধাক্কায় পেছনে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না কেউ। কেউ শুধু সামনের দিকে যাচ্ছে। মানুষের ভিড়ে কেউ হাঁটতে না চাইলেও ধাক্কায় তাকে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন তাই সকাল থেকেই মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। কোলের শিশু থেকে বয়সে বৃদ্ধ সবই দেখা গেল মেলা প্রাঙ্গণে। আর মাঝ বয়সী কিংবা তরুণ-তরুণীর তো কথাই নেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দর্শনার্থীর সংখ্যাও বেড়ে যায় কয়েকগুণ বেশি। দুপুরের পর পরই কারও টিকিট কাটতেই কেটে গেছে ঘণ্টা খানেক সময়। মেলায় প্রবেশের একাধিক গেট থাকলেও কোন গেটে ফাঁকা তো ছিলই না বরং প্রবেশের জন্য লম্বা লাইন। বিক্রেতারা জানিয়েছেন, তাদের বিকিকিনিও বেশ ভাল এদিন। কেননা মানুষ বেশি হলে যারা শুধু ঘুরতে আসে তারাও শখের বশে কিছু না কিছু কিনে নেন। এদিন, অধিকাংশ দর্শনার্থী ছুটেছেন নানা রকম পণ্যে ছাড় দেয়া সুবিধাগুলো দেখতে বা কিনতে। মেলায় দেখা যায় নানা রকম পণ্যে নানা রকম সুবিধার ছাড় দিচ্ছে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। আর সেই ছাড়ের সুবিধা লুফে নিচ্ছে ক্রেতাও। ১টি কিনলে ১০টি ফ্রি! কেউ চোখ কচলে দেখছেন ঠিক দেখেছেন কিনা। এরপর দোকানে গিয়ে হাতে নিয়ে দেখে পছন্দ হলে কিনে নিচ্ছেন। এই সুবিধাগুলো দেয়া হচ্ছে হোম এ্যাপ্লায়েন্সের স্টলগুলোতে। এছাড়াও এদিন তরুণীরা ভিড় করেছে থ্রিপিস স্টলগুলোতে। নানা রংবেরঙের থ্রিপিস দেখে মুগ্ধ তরুণীরা। কেউ তিনটি থ্রিপিস বিক্রি করছেন ৪৯৯ টাকায়। কোন স্টলে আবার ৯৯৯ টাকায়। তবে সেটা নির্দিষ্ট কিছু জামার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে ক্রেতারাও ছাড়ার পাত্র নয়। নির্দিষ্ট সেই জামাগুলো বার বার দেখে পছন্দ হলে নিয়ে নিচ্ছেন। এই প্যাকেজের বাইরেও রয়েছে নানা রংবেরঙের কালেকশন। কোন কোন জামা ১ হাজার থেকে ৬ হাজার পর্যন্ত দাম হাঁকাচ্ছে বিক্রেতারা। আপন টেক্সটাইলের প্যাভিলিয়ন-৪৭ গিয়ে দেখা যায়, তারা ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে লিখে রেখেছেন তিন পিস ৫৯৯ টাকা মাত্র। বিক্রয় প্রতিনিধি জানালেন, অনেকেই একটি জামা কিনতে এসে আরও অনেক ডিজাইনের জামা পছন্দ হয়। প্যাভিলিয়ন পুরোটাই নানা রকম থ্রি পিসের সমাহার। প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব তাঁত ছাড়াও ভারত-পাকিস্তানের নানা ডিজাইন ও হাতের কাজের ওপর থ্রি-পিস এনেছে। প্রতিষ্ঠানটি ইন্ডিয়ান ফোরপিস দিচ্ছে ১ হাজার ১৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৮৫০ টাকায়। এছাড়া গঙ্গা থ্রিপিস রয়েছে ৮৯০ টাকায়, জয়পুরী ৮৫০ টাকা আর জামদানি তাঁতের থ্রিপিস ৭৫০ টাকায়। আবার পাকিস্তানী লন থ্রিপিস দেয়া হচ্ছে ১ হাজার ৫০ টাকায়। এদিকে, তানসিয়া জামান নিপু জানান, তিনি ৯৯৯ টাকায় একটি প্যাকেজ জামা কিনেছেন। পণ্যের মান নিয়ে বলেন, মূলত কোথাও বেড়ানোর জন্য নয়, শুধু বাসায় পরিধানের জন্যই কিনলাম। এছাড়াও নারীরা ছুটেছেন অলঙ্কারের স্টলগুলোতে। নানা রকম পাথরের নানা ডিজাইনের অলঙ্কারের স্টলগুলোতে বেশ ভিড় লক্ষ করা গেছে। এদিকে, মেলায় কেউ কেউ ঝুঁকেছেন পাট দিয়ে তৈরি বিভিন্ন আকর্ষণীয় ডিজাইনের জুতা, ব্যাগ ও শোপিচ পণ্যগুলোর দিকেও। মেলায় আসা বনানীর বেসরকারী কর্মকর্তা নিয়ামুল জামান ও তার স্ত্রী শায়িদা জামান জানান, পাট দেশের ঐতিহ্য। এর পণ্যগুলো টেকসইও বটে এবং দেখতেও সুন্দর। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনলাম। আবার আগামী কোন একদিন আসব। এছাড়াও আগত শিশুরা মেতেছিল মেলায় তৈরি মিনি শিশু পার্কে। শিশুদের দেখা গেছে বিলাসী সাম্পানে উড়তে। কেউ কেউ তার আদুরে বাচ্চাকে কোন রাইডে উঠিয়ে দিয়ে উৎসাহ দিতেও। মেলায় মিনি শিশু পার্কেও এদিন উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। যেখানে রয়েছে হানি সুইং, দোলনা, ডোরেমন, ট্রেনসহ বিভিন্ন রাইড। মেলা প্রাঙ্গণে শিশু পার্কটির দায়িত্বরত কো-অর্ডিনেটর রিয়াজ আহমেদ বলেন, আমরা এবার দিয়ে তিন বছর বাণিজ্যমেলায় অংশ নিয়েছি। বাচ্চাদের সময়টা যেন ফুর্তিতে কাটে সে জন্যই শিশুপার্কের ব্যবস্থা। এবার তিনটি রাইড ছাড়া বাকি সব রাইডের টিকিট মূল্য ৩০ টাকা। ছুটির দিনগুলোতে ভিড় বাড়ে তবে অন্যান্য দিনও কম নয় বলেও জানান তিনি। জানা গেছে, শিশু পার্কের প্রতিটি রাইডই ইলেক্ট্রিক যন্ত্রচালিত। এক একটি রাইডে ৫ থেকে ৮ মিনিট উপভোগ করতে পারবে শিশুরা। একাধিক শিশুর অভিভাবক জানান, তার বাচ্চার বিনোদনই তাদের কাছে প্রথম। এজন্য কেনাকাটা বাদ দিয়ে বাচ্চাকে বিনোদনে রাখতে পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহও দিচ্ছেন কেউ কেউ। এদিকে, মেলায় আগত তরুণ-তরুণীদের একাংশ দেখা গেছে স্টলগুলোর ভিড় এড়াতে তারা খোলা জায়গা বেছে নিয়েছেন। কেউ আবার মেলায় অবস্থিত বাগানগুলোর আশপাশ গিয়ে বেশ আধুনিকতার সেলফি দিচ্ছেন। রেহমান মনজুর নামের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও তার বন্ধুরা মেলায় এসে নীরবে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। কথা বলে জানা গেল, শখ করে মেলায় এসেছেন তবে ভিড় বেশি হওয়ার কারণে স্টলগুলো এড়িয়ে একটু নিজেরা নিজেদের মতো গল্প করছেন। কেনাকাটার বিষয়ে বলেন, অন্য একদিন আবার আসতে হবে। এদিন, মেলায় বিভিন্ন পণ্যের দাম নিয়ে ক্রেতাদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিছু কিছু দোকানে পণ্যের দাম স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রাখা হচ্ছে। অন্যদিকে কিছু দোকানে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কিছুটা কম মূল্যেও ভাল জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও ছুটির দিনে অন্যন্য দিনগুলোর চেয়ে মেলার নিরপত্তাও ছিল একটু বেশি। এর কারণ হিসেবে একাধিক কর্মকর্তা জানান, মানুষের ভিড় যেখানে বাড়ে সেখানে নিরপত্তা বাড়াতেই হয়। কোন দুর্ঘটনা বা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে দেখা গেছে। একই সাথে মেলা থেকে হকার উচ্ছেদে অভিযান চালানো হয়েছে। অন্তত ২৫ জন হকারকে আটক করে তাদের মালামাল জব্দ করা হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) নির্দেশে শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত এ অভিযান চলে। হকারদেও উৎপাতে বেশ অতিষ্ট হন দর্শনার্থীরা। বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে হকার প্রবেশ করে কিন্তু ভবিষ্যতে হকার যাতে মেলায় প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে বলেও জানান পুলিশের কর্মকর্তারা। ২১টি দেশ অংশ নিয়েছে এবারের বাণিজ্যমেলায়। মাসব্যাপী এ মেলা চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত খোলা থাকবে মেলা। মেলায় প্রবেশে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য টিকেটের মূল্য রাখা হচ্ছে ৩০ টাকা। অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২০ টাকা।
×