ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফখরুলের দাবি

একাদশ সংসদ নির্বাচন কিভাবে হবে তা আগেই ঠিক করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

একাদশ সংসদ নির্বাচন কিভাবে হবে তা আগেই ঠিক করতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে হবে তা আগেই বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আর তা না হলে দেশের চলমান সঙ্কট নিরসন করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। শুক্রবার বিকেলে বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। মির্জা ফখরুল বলেন, সকল দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হলে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড করতে হবে। আর এজন্য দরকার হবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। কিন্তু আমরা বারবার এ দাবি জানিয়ে এলেও সরকার তাতে কর্ণপাত করছে না। তিনি বলেন, আমরা তো নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা হতে পারে। তিনি বলেন, দেশের মানুষ এখন ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। আইনের শাসন অনুপস্থিত। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। দেশে এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। উন্নয়নের নামে চলছে বল্গাহীন লুণ্ঠন। মির্জা ফখরুল বলেন, একটি নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ, সাহসী, যোগ্য নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন হতে হবে। সেজন্য সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিরোধী দল নির্মূল করার যে প্রক্রিয়া চলছে, তা বন্ধ করতে হবে। সব রাজনৈতিক নেতাকে মুক্তি দিতে হবে। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। সভা, মিছিল, সমাবেশ করার সমান সুযোগ দিতে হবে। গণমাধ্যমকে স্বাধীনতা দিতে হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আগামী নির্বাচন ও রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করবেন এবং নতুন আশার আলো দেখাবেন বলে আশা প্রকাশ করছে বিএনপি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বিভিন্ন ভ্রান্ত তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। গণতান্ত্রিক পরিবেশ, রাজনীতিকে তার স্বাভাবিক পথে চলতে দিতে হবে। ফখরুল বলেন, বিএনপি নেতাদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অন্যায়ভাবে সাজা দেয়া, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, বিচার বিভাগসহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। তিনি অভিযোগ করেন, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য তৈরির কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে বিরোধী দলকে দায়ী করে জঙ্গীবাদকে আরও প্রশ্রয় দিচ্ছে সরকার। বিএনপি মহাসচিব বলেন, বারবার জিডিপির হিসাবের বিভ্রাটে ফেলা হচ্ছে জাতিকে। বিএনপির আমলে জিডিপি ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছিল, বর্তমান সরকারের আমলে তা বরং হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু, মালিবাগ ফ্লাইওভারসহ প্রায় সবকটি ফ্লাইওভারের প্রকল্প ব্যয় কয়েকগুণ বাড়ানো হয়েছে। সরকার মেগা প্রকল্প গ্রহণে বেশি আগ্রহী, কারণ এতে তারা মেগা চুরির সুযোগ সৃষ্টি করে। তিনি সরকারকে উদ্দেশ করে বলেন, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের ভবিষ্যত কী, জনগণ তা জানতে চায়। দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নেই। সরকারদলীয় লোকজনের চাঁদাবাজি, গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে বিনিয়োগ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফখরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে তাঁর ভাষণের শুরুতেই জাতিকে ভ্রান্ত তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের কথা বলেছেন, যা সঠিক নয়। কারণ, ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি ১৫৩ জনকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল। শতকরা ৫ ভাগ ভোটারও ভোটকেন্দ্রে যায়নি। সারাদেশের মানুষ এবং বহিঃবিশ্ব ওই নির্বাচনকে গ্রহণ করেনি। আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করেছিল অনৈতিকভাবে। ‘জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে বন্দুকের মুখে জিম্মি করে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। তিনি এবং আরও অনেকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেও সেটা গ্রহণ করা হয়নি। সে সময়কার তামাশা ও নাটক সকলের মনে থাকার কথা।’ মির্জা ফখরুল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে যে তিনটি সরকার গঠিত হয় সে তিনটি সরকারের সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নতুন মাত্রা পায়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন, মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজগুলো কোন একটি বিশেষ সরকারের একক প্রচেষ্টার ফসল নয়। তাই প্রধানমন্ত্রীর দাবি অনৈতিক এবং শুধুমাত্র আত্মতুষ্টির প্রচেষ্টা। ফখরুল বলেন, সরকারের নজীরবিহীন দলীয়করণ প্রশাসন ও অন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু করেছে। জবাবদিহিতার অভাব, অকার্যকর সংসদ দুর্নীতিকে লাগামহীন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে অর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ধ্বংসের মুখে। শেয়ার মার্কেট লুট, ব্যাংক লুট, দলীয় ব্যক্তিদের জন্য ঋণ সুবিধা ও ফেরত না দেয়ার প্রবণতা একনায়ক সরকারের সমর্থক ও তল্পিবাহকরা লাগামহীনভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার করে দেশের অর্থনীতিকে ভেতরে ভেতরে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলছে। শুধুমাত্র আরএমজি সেক্টরের আয় ও রেমিন্টেন্সের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়লেই অর্থনীতি চাঙ্গা হয় না, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে কি-না তাও দেখতে হবে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণ এমনভাবে চিত্রায়িত করেছেন যে, সকল উন্নয়ন তাঁর দুই দফার সরকারের ৮ বছরেই হয়েছে, যা সঠিক নয়। অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। ভিত্তি তৈরি করতে হয়, এরপর একটি একটি করে ইট লাগাতে হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ দেশের অর্থনীতিতে দুঃশাসন ও দুর্নীতির কারণে এবং ভ্রান্ত নীতির কারণে অচল হয়ে পড়েছিল। তখন বিদেশীরা তলাবিহীন ঝুড়ির সঙ্গে তুলনা করেছিল, দুর্ভিক্ষে লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। সে অর্থনীতিকে সজীব ও সচল করে তুলেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে অবরুদ্ধ অর্থনীতিকে তিনি মুক্ত করেছিলেন। বেসরকারী বিনিয়োগ, মুক্তবাজার অর্থনীতি, কৃষিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার, শিল্পে তিন শিফটের কাজ, সর্বপ্রথম পোশাক শিল্পের উদ্যোগ ও বিদেশে বাজার সৃষ্টি, মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজার সৃষ্টি দেশের অর্থনীতিকে নতুন এবং সচল অধ্যায়ে নিয়ে যায়। সেটাই ছিল ভিত্তি। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান অর্থনীতিকে সচল করে। নতুন ও তরুণ উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসায় বাংলাদেশ আবার স্বনির্ভর দেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। পরবর্তী গণতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক, বৈধ-অবৈধ প্রায় সব সরকারই কমবেশি উন্নয়নে কাজ করে। মির্জা ফখরুল বলেন, ক্ষুদ্রঋণ, গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, ইনফর্মাল সেক্টরে বিনিয়োগ গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার করে। একদিকে নারী ক্ষমতায়ন অন্যদিকে নারীদের আনসার, ভিডিপি, পুুলিশ ও অন্যান্য সেক্টরে কর্মসংস্থান অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। পৃথক মহিলা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এ প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, তাঁর সরকার শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করেছে। গত আট বছর ধরে এ দেশে শিক্ষার কী উন্নতি হয়েছে, তা জনগণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সরকার শিক্ষার গুণগতমান ধ্বংস করে দিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দেশের সঙ্কট চিহ্নিত করবেন এবং তা নিরসনের পথের সন্ধান দেবেন। সেটাই ছিল তাঁর জন্য রাষ্ট্রনায়কোচিত কাজ। তিনি তা না করে রাজনৈতিক দলগুলোকে শুধুমাত্র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বলেছেন। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ একটি সহায়ক সরকারের অধীনে একটি নিরপেক্ষ, সাহসী, যোগ্য নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি নির্বাচন। সেজন্য তৈরি করতে হবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। গণতন্ত্রকে হত্যা করে, জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করে, একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা জনগণ কোনদিনই মেনে নেবে না। আমরা এখনও আশা করি, প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্র ধ্বংস করার একদলীয় শাসন প্রবর্তনের ভয়ঙ্কর রাস্তা থেকে সরে গিয়ে গণতন্ত্রের মুক্ত পথে চলবেন। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করবার জন্য বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আগামী নির্বাচন এবং রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করবেন। নতুন আশার আলো দেখাবেন। অন্যথায় জনগণের কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেনÑ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান ও দলের প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী।
×