ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা নাটকের নতুন আলোর দিশারী

সেলিম আল দীনের প্রয়াণবার্ষিকী আজ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

সেলিম আল দীনের প্রয়াণবার্ষিকী আজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী বাংলা নাটকের নতুন আলোর দিশারী নাট্যকার সেলিম আল দীন। পশ্চিমা নাট্যরীতিকে পাশ কাটিয়ে কাজ করেছেন হাজার বছরের দেশীয় ঐতিহ্যে। বাংলা নাটকে প্রবর্তন করেছেন বর্ণনাত্মক ধারা। আজ শনিবার দেশের নাট্য আন্দোলনের এই পথিকৃতের নবম প্রয়াণবার্ষিকী। ২০০৮ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। নাটকের আঙ্গিক ও ভাষার ওপর গবেষণা করেছেন সেলিম আল দীন। এই নাট্যজনের প্রয়াণদিবসে ঢাকা থিয়েটার ও গ্রাম থিয়েটার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, নাট্যসংগঠন স্বপ্নদল বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। ঢাকা থিয়েটারের চারদিনের অনুষ্ঠান শুরু হবে আজ শনিবার বিকেলে শিল্পকলা একাডেমিতে সেমিনারের মাধ্যমে। ‘উত্তর-উপনিবেশবাদ, রাজনীতি এবং প্রজন্মান্তরে নাট্যচর্চা : এক ধবল রক্তিমাভ নাট্যকথামালা’র বহু-অক্ষীয় পাঠ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ। কাল রবিবার শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হবে ‘সেলিম আল দীন স্মরণ উৎসব ২০১৭।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের আয়োজনে থাকছে দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে লাঠি খেলা, মুক্ত আলোচনা, এ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনী এবং নাট্যমঞ্চায়ণ। নিজেদের দুটি প্রযোজনা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় স্বপ্নদল আজ থেকে আয়োজন করেছে ‘সেলিম আল দীন স্মরণোৎসব-২০১৭’। উৎসবটি উৎসর্গ করা হচ্ছে নাট্যাচার্যের সহধর্মিণী সদ্যপ্রয়াত বেগমজাদী মেহেরুন্নেসা পারুলের স্মৃতির প্রতি। বাংলা মঞ্চ নাটক আর সেলিম আল দীনÑ কথা দুটি প্রায় সমার্থক। নাট্যরচয়িতা হিসেবেই শুধু নন, দীর্ঘ তিন যুগ ধরে নাট্যকেন্দ্রিক নানা কর্মতৎপরতা, গবেষণা, চর্চা ও সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়ে সেলিম আল দীন নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। সেখানে রবীন্দ্র উত্তরকালে আর কেউ পৌঁছাতে পারেননি। তারই আগ্রহে ও প্রচেষ্টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘নাটক ও নাট্যতত্ত্ব’ বিভাগ। ১৯৭৩ সালে ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম তিনি। নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটারও। সারাদেশে আয়োজন করেছেন নানা নাট্যমেলা, উৎসব, পার্বণের। সব মিলিয়ে বাংলা নাটকে তার তুলনা তিনি নিজেই। বাংলা নাটকের একটি নতুন বাঁকের স্রষ্টাও সেলিম আল দীন। বাংলা নাটকের গবেষণাতেও তার অবদান আজ প্রতিষ্ঠিত। বাংলা নাটকের হাজার বছরের পুরনো শিল্পরীতিকে অতীতের সিন্দুক থেকে তুলে এনেছেন বাঙালীর সংস্কৃতি চর্চার বাংলাঘরে। তিনি দেখিয়েছেন বাংলা নাট্যরীতি একেবারেই নিজস্ব। এই নাট্যরীতি ছোটগল্প, উপন্যাস বা প্রবন্ধের মতো পাশ্চাত্যের প্রেরণাতাড়িত বিষয় নয়। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রের নির্যাস ও বাংলা ভাষার মধ্যযুগের সাহিত্যরীতি থেকে পাওয়া শিল্প উদ্দীপনাগুলো নিজের সৃষ্টিকর্মে প্রয়োগ করেছেন তিনি। সেলিম আল দীন উপাখ্যান বা আখ্যান রচনা করতে গিয়ে পাশ্চাত্য ধারার নাটকের মতো ‘অংক’, ‘দৃশ্য’ এসব না এনে আমাদের হাজার বছরের সাহিত্য ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত থেকে উপাখ্যান রচনার এক আধুনিক নিজস্ব রীতি তৈরি করেছেন। আমাদের মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যের একটি বিশেষ গুণ হলো এর বর্ণনারীতি। লেখক সেই বর্ণনারীতিকে ব্যবহার করেছেন। বর্ণনারীতির এই ব্যবহার তার সব রচনাতেও তিনি ব্যবহার করেছেন। ‘কেরামতমঙ্গল’ (১৯৮৮), ‘যৈবতী কন্যার মন’ (১৯৯৩), ‘চাকা’ (১৯৯১), ‘হরগজ’ (১৯৯২), ‘প্রাচ্য’ (২০০০), ‘হাতহদাই’ (১৯৯৭), ‘নিমজ্জন’ (২০০২), ‘ধাবমান’, ‘স্বর্ণবোয়াল’ (২০০৭) ইত্যাদি মাস্টারপিস আখ্যান নির্মাণ করে তিনি বাংলা নাটকের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট ফেনীর সোনাগাজী থানার সেনেরখিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নাট্যচার্য সেলিম আল দীন। বাংলাদেশের বিচিত্র শ্রমজীবী, পেশাজীবী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সমাজজীবন ও তাদের আবহমান কালের সংস্কৃতিকে নাটকে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তিদান করেছেন। তার প্রথম রেডিও নাটক বিপরীত তমসায়। প্রথম মঞ্চনাটক ‘সর্পবিষয়ক গল্প’ মঞ্চায়ন হয় ১৯৭২ সালে। তিনি শুধু নাটক রচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেননি। বাংলা ভাষার একমাত্র নাট্যবিষয়ক কোষগ্রন্থ বাংলা নাট্যকোষ সংগ্রহ, সংকলন, প্রণয়ন ও সম্পাদনা করেছেন। সেলিম আল দীনের নির্দেশিত নাটকের মধ্যে রয়েছেÑ ‘মহুয়া’, ‘দেওয়ানা মদিনা’, ‘একটি মারমা রূপকথা’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ‘মেঘনাদবদ’। নাট্যচার্য জীবনের শেষ ভাগে এসে লেখেন ‘নিমজ্জন’ নামে মহাকাব্যিক এক উপাখ্যান। তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, কথাসাহিত্য পুরস্কার, নান্দিকার পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন।
×