ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ইয়াং চু থেকে শিল্পা ফুল ঘর

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

ইয়াং চু থেকে শিল্পা ফুল ঘর

যে ফুল ভালবাসে না, সে মানুষ খুন করতে পারে। ফুল নিয়ে এমন অসংখ্য প্রবাদ, গল্প, কবিতা, ছন্দ, গান প্রচলিত রয়েছে। ফুল ভালবাসার বস্তু, স্নিগ্ধ ও নিখাদ। ফুলের বাহারি রং, বর্ণ, গন্ধ, সুবাস, মাধুর্য ও দৃষ্টিনন্দনতা প্রকৃতি ও পরিবেশকে দিয়েছে অনাবিল, মায়াময় রূপ। যে রূপের মুগ্ধতায় মুগ্ধ হয়ে কবি লিখেছেন কাব্য ভাষায় তার উক্তি, চিত্রকর তার রংতুলির ছোঁয়ায় এঁকেছেন তার প্রতিচ্ছবি, আলোকচিত্রী ধারণ করেছেন ক্যামেরার ফ্রেমে আর প্রকৃতিপ্রেমী ঘুরে বেড়িয়েছে দিগন্তের শেষ সীমানায়। প্রকৃতিগত অবস্থান-দিক রয়েছে সেখানে চোখ মেলে দেখতে পাওয়া যায় বারো মাস নানান রং, গন্ধ, সুবাসের কতই না ফুলের সমাহার। ফুল গবেষকদের মতে দেশে প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির ফুল ফোটে। অনেক বিদেশি ফুল ইতোমধ্যে এদেশে স্থান করে নিয়েছে। ফুলের ব্যবহার আকর্ষণীয় রং, রূপ, গন্ধ, সুবাস, বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতার জন্য অনেকাংশে জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়। দেশী ফুলের মধ্যে রয়েছে শিমুল, পলাশ, কদম, বেলি, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, বকুল, গন্ধরাজ, কাঠগোলাপ, সূর্যমুখী, রঙ্গন, হাসনাহেনা, কামিনী, সন্ধ্যামালতী, কলাবতী, জবা, ঝুমকোজবা, গাদা, ডালিয়া, শাপলা, পদ্ম, কাশফুল, নয়নতারা, বাগানবিলাস, নীলঘণ্টা ইত্যাদি। বুনোফুলের মধ্যে রয়েছে কাঁটা মেহেদি, কুলঞ্জন, শিরীষ, ছাতিন, বনজুঁই, মহুয়া, অশুখ, হিজল, তমাল, বন্যা, মান্দার, লজ্জাবতী ইত্যাদি। বিদেশি ফুলের মধ্যে রয়েছে চন্দ্রমল্লিকা, লিলিয়াম, ক্যালেন্ডুলা, গোপাল, এ্যানথুরিয়াম, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, গেলার্ডিয়া, হেলিকোনিয়া, জিপসোফিলা, জিনিয়া, পপি, পেটুনিয়া, স্প্যাথিফাইলাম ইত্যাদি। ফুলের নানামুখী ব্যবহার ও ফুলের প্রতি মানুষের গভীর ভালোবাসার ফলে দিন দিন ফুলের কদর বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই তো ফুল গাছ রোপণ, চাষাবাদ, যতœ-পরিচর্যা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে আধুনিক ও উন্নত। বাসাবাড়ি, গ্রামগঞ্জ, শহর, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও পার্কে নানাজাতের ফুলের গাছ যতœ ও পরিচর্যার সঙ্গে লালন-পালন চোখে পড়ার মতো। কেউ বা সরাসরি মাটিতে, কেউ বা বাড়ির ছাদে, মিলনায়তনে, বারান্দার টবে, বাসাবাড়ি-প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে ফুল গাছ লাগিয়ে থাকে। তাছাড়া বর্তমান সময়ে দেশে-বিদেশে ফুলের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় শুরু হয়েছে ফুলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ। ফলে গড়ে উঠেছে ফুল চাষকেন্দ্রিক কর্মসংস্থান ও বাজারজাত ব্যবস্থা এবং সুগম হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ। এ জন্য গড়ে উঠেছে বহু দোকানপাট। ফুলের বহুবিধ ব্যবহার লক্ষ্যণীয় যেমন- বিয়ে, গায়ে হলুদ, বিদেশী মেহমান বা রাষ্ট্র-সরকার প্রধানকে বরণ, বিয়ের গেট সাজানো, বিয়ের গাড়ি সাজানো, মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তিকে শ্রদ্ধা জানানো, মালা গাঁথায়, বাসর সাজানো, ঘর সাজানো, নতুন অতিথি বা গণ্যমান্য ব্যক্তি বরণে, সভা-সেমিনারে, ভালবাসা বিনিময়ে, মাল্যদানে, বিভিন্ন দিবস উদযাপন, সংবর্ধনা জানাতে এবং ভেষজ ওষুধপথ্য তৈরিতে, আতরসহ বিভিন্ন রকম সুগন্ধি ও পারফিউম তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ফুল। ফুলবাগান নানা প্রকার ও জাতের হয়ে থাকে, তবে ফুলবাগান ও চাষাবাদের ভিত্তিতে স্থান নির্বাচন জরুরী বিষয়। তাই তো প্রকৃতি-পরিবেশ, স্থান ও ফুলের জাত, জমির আয়তন ভেদে বাগান পরিকল্পনা করা দরকার। সৌন্দর্য ও বিশ্ব ভালোবাসার অনন্য উপহার উপকরণ ফুল এবং আমাদের দেশের প্রকৃতি-পরিবেশে অবহেলা-অবজ্ঞার কারণে দেশী প্রজাতির নানান জাতের ফুলের মাঝে যেসব ফুল হারিয়ে যাচ্ছে, সেসব ফুলের সঠিক মূল্যায়ন তথা এ-জাতীয় ফুলকে বিদেশী ফুলের মতো যতœ-পরিচর্যা ও গবেষণার মাধ্যমে লালন-পালন আর বাজারজাত করা গেলে দেশী ফুল ও ফুলের জাত টিকে থাকবে। আর এই ফুলই মানুষের জীবনে চলার পথ বের করে দেয়। ফুল বিক্রি করেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন মাদারীপুরের পরিতোষ কু-ু। ফুল বিক্রি করে যাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এতিম পরিতোষ ২৫ বছর আগে ভাইদের বকুনি খেয়ে অভিমান করে বাড়ি থেকে ফেরারী হন। তার পৈত্রিক বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপার তিতলীকান্দি গ্রামে। বাবার নাম যজ্ঞেশ্বর কুন্ডু। পরিতোষ ঘুরতে ঘুরতে এক সময় মাদারীপুরে চরমুগরিয়া বন্দরে আত্মীয় বাদল কুন্ডুর বাসায় ওঠে। ১৫ বছর বয়সী পরিতোষ প্রথম জীবনে নানা খুঁটিনাটি কাজ শুরু করেন। বাদল কুন্ডুর সহযোগিতায় মাদারীপুর পুরান বাজারের ব্যবসায়ী নারায়ণ চন্দ্র সাহার দোকানে কাজ এবং কাজের ফাঁকে ফুটপাথে বসে ফুল বিক্রি শুরু করেন। তার পুঁজি শুধু মুখের হাসি আর সদ্ব্যবহার। ধীরে ধীরে আলোর পথে ধাবিত হয় তার ব্যবসা। অল্পদিনের মধ্যে শহরে দোকান দিয়ে বসেন সংগ্রামী পরিতোষ। নাম রাখেন ইয়াং চু ফুল ঘর। বর্তমানে পরিতোষ মাদারীপুর শহরের অভিজাত বিপণি বিতান মেলবোর্ন প্লাজায় দোকান নিয়ে ব্যবসা করছেন। দোকানের নাম পাল্টে নতুন নাম রেখেছেন ‘শিল্পা ফুল ঘর’। অন্য দশ ফুলের দোকানদারের চেয়ে তার লক্ষ্য আলাদা। মূলত পরিতোষ এখন প্রতিষ্ঠিত ফুল ব্যবসায়ী। এক সময় দু’মুঠো ভাতের জন্য জীবনের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে শিশু বয়সে বাড়ি ছাড়েন পরিতোষ। অথচ পরিতোষ আজ সংগ্রামী জীবনের উদাহরণ। ফুল বিক্রি করে সুখে সাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছেন। শুধু তাই নয়, ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে মাদারীপুর শহরে বাড়ি করেছেন। চার জনের ছোট সংসারে পরিতোষের বড় মেয়ে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। সুখ পাখি নিজেই উড়ে এসে পরিতোষের হাতে ধরা দিয়েছে। ১৮ বছর ধরে ফুলের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পরিতোষ। শুধু বাড়ি-ঘরই নয়, তিনি এখন ফুল বাগানে দাদন দিয়ে থাকেন। প্রতিদিন সকালে বাগান থেকে ফুল এনে তাঁর দোকানে পৌঁছে দেয় চাষীরা। ফুল বিক্রির পাশাপাশি ফুলের অর্ডার সরবরাহ করা হয় দোকান থেকে। একুশে ফেব্রুয়ারি ডালা বাঁধানো, বুকেট তোড়া, বিয়ের গাড়ি সাজানো, জন্মদিনের স্টেজ সাজানো, ভিআইপিদের ফুলের তোড়া, বিয়ের বাসর ঘর সাজানো, ট্রে তোড়া, কর্কসিট বোর্ড, হলুদের গহনা সেট, বর-কনের মালা, গায় হলুদের স্টেজ সাজানো, হাততোড়া, ঝুড়ি তোড়া নববধূ ও মেয়েদের খোঁপার মালাসহ ফুলের সব ধরনের শৌখিন দ্রব্য পাওয়া যায় তার দোকানে। এছাড়া রজনীগন্ধা স্টিক, গোলাপ ফুল, ভুট্টা ফুল, পাপড়ি, গাঁদা ফুল, পাঁচরঙা গ্যালারী ফুল, জারবারা, জিপ্সি ইত্যাদি ফুল নিয়মিত বিক্রি হয়। ফুল বিক্রি করে প্রতি মাসে তার দোকানে আয় হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×