ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফুল এখন বাণিজ্যিক পণ্য

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

ফুল এখন বাণিজ্যিক পণ্য

ভালবাসার প্রতীক ফুল। শুভেচ্ছা বিনিময়েও ফুল প্রধান উপকরণ। সেই ফুল হয়ে উঠেছে এখন বাণিজ্যিক পণ্য। তারই নানা কথা নিয়ে এবার লিখেছেন- সমুদ্র হক, মামুন-অর-রশিদ, সুবল বিশ্বাস, বিশ্বজিৎ মনি, মহিউদ্দিন মুরাদ ও আবদুর রউফ সরকার। বাগানে ঢুকে ফুল ছিঁড়ে আনার অভিজ্ঞতা আজকের বয়োজ্যেষ্ঠদের কমবেশি সকলেরই আছে। ফুল হৃদয় কেড়ে নেয় না, এমন মানুষের সংখ্যা নেই বললেই চলে। সম্রাট নেপোলিয়ন বলেছিলেন যেখানে ফুল নেই, তা বসবাসের অযোগ্য। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মমত্ববোধ, প্রেমের অর্ঘ্য ফুল। ফুলের কদর চিরন্তন। যে ফুল ভালবাসে না, তাকে মানুষ তো বলা যাবেই না অন্য কোন প্রাণী বলতেও মনে দ্বিধা আসে। পৃথিবীতে এমন কোন পশু পাখি নেই, যারা ফুলকে পায়ে দলেছে বা নষ্ট করেছে। মানব হৃদয় জয় করতে ফুলের বিকল্প নেই। দূর অতীতে ফুল ছিল শখের বাগানে। ব্যক্তি উদ্যোগে বাড়ির উঠানে ফুলের গাছ লাগানো হতো। ফুল ছিঁড়ে কাউকে দেয়ার মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। গ্রামীণ জীবনে ফুলের মালা গেঁথেছে মেয়েরা। শরতের সকালে শিউলী ফুল কুড়িয়ে এনে মালা গাঁথা ছিল কিশোরীদের আনন্দের কাজ। সত্তর দশকের শুরুতে রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ছোট ছেলেমেয়েরা বেলি ফুলের মালা গেঁথে বিক্রি করেছে। ফুটপাথে গোলাপ রজনীগন্ধা গাঁদা ফুল ছিল বেশি। শহরে ও গ্রামে কোন বাড়িতে শিউলি ও জবা ফুলের লম্বা গাছ দেখা গেছে। সত্তর দশকের শেষে ঢাকা মহানগরীতে বিচ্ছিন্নভাবে ফুটপাথে ফুলের বেচাকেনা শুরু হয়। ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে রাস্তার ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাতে গোনা কয়েক দোকানি ফুল নিয়ে বসে। একের দেখাদেখি আরেকজন, এভাবে ফুলের ব্যবসা শুরু হয়। বগুড়া শহরে হেড পোস্ট অফিসের সামনে নবাববাড়ি সড়কের ধারে ফুটপাথে ফুল বেচাকেনা শুরু হয় ৮০’র দশকের মধ্যভাগে। তখন মাত্র একটি দোকান ছিল। নব্বইয়ে দশকে প্রথম দিকে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) রজনীগন্ধা ফুলের চাষ শুরু করে। আরডিএর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শেরপুর গাড়িদহ দশমাইল এলাকায় কৃষক রজনীগন্ধার আবাদ করে। মূলত তখনই রজনীগন্ধা ফুল বেচাকেনা বেড়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যে নবাববাড়ি সড়কের ফুটপাথে ফুল বেচাকেনা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। এরপর ফুল উল্কার গতিতে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। বগুড়ায় ফুলের বেচাকেনা বেড়ে যাওয়ায় বিক্রেতারা তাদের বসার জন্য চিরস্থায়ী ব্যবস্থার অনুমতি চায় পৌরসভার মেয়রের কাছে। ওই সময়ে বগুড়া পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন এ্যাডভোকেট রেজাউল করিম মন্টু। তিনি নবাববাড়ি সড়কের ধারে যে লিংক রোডটি শহীদ খোকন পার্কের পাশ দিয়ে টেম্পল রোডে মিশেছে সেই লিংক রোডের এক ধারে পুরোটাই ফুলের দোকানিদের জন্য পাকা ঘর নির্মাণ করে দেন। বগুড়ায় এটাই এখন ফুল মার্কেট। যেখানে ১৮টি ফুলের দোকান আছে এক সারিতে। দোকানিরা জানান, প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ ফুল বিক্রি হয়। রজনীগন্ধা, গোলাপ, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, ¯েœাবল, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, সন্ধ্যামালতী ফুল ছাড়াও নাম না জানা ফুল বিক্রি হয় এই মার্কেটে। ধানের শীষের মতো এক ধরনের ফুলের নাম দেয়া হয়েছে জিপসি। হালে কিছু বিদেশী ফুলের আগমন ঘটেছে। দেখতে সুন্দর কোন নাম বলতে পারে না দোকানিরা। ফুল ব্যবসায়ী রমজান আলী বললেন, বগুড়ার বিভিন্ন এলাকা ও নার্সারি থেকে যে ফুল পাওয়া যায় তা দিয়ে চাহিদা মেটে না। ফুলের রাজধানী যশোরের গদখালি থেকে প্রতিদিন ভোরে ও বিকালে দুইবার রজনীগন্ধা, গোলাপসহ নানা ধরণের ফুল আসে। একটা সময় ফুল বেচাকেনার মৌসুম ছিল। শীত ও বসন্তে ফুল বেচাকেনা হতো বেশি। বর্তমানে শীত বসন্ত নেই। প্রতিদিন ফুল বেচাকেনা হয়। ফুল বেচাকেনার পাশাপশি দোকানিরা ‘ইভেন্ট ম্যানেজেমেন্টের’ মতো দায়িত্ব পালন করে। ব্যক্তি গোষ্ঠী পরিবার সরকারী বেসরকারী অফিস বাসাবাড়িতে ফুল সরবরাহ তো করেই পাশাপাশি ফুলের মালা, তোড়া, ঘর সাজানো, বিয়ের গাড়ি সাজানো, হলুদের স্টেজ, বাসরঘরসহ সাজানোর যাবতীয় কাজ করে দেয়। প্রতিটি দোকানে ফুল সাজানোর জন্য বাড়তি লোকবল আছে। বর্তমানে সরকারী বেসরকারী সামাজিক এমন কোন অনুষ্ঠান নেই, যেখানে ফুলের দরকার হয় না। তারুণ্যে মানব মানবীর কাছে প্রণয়ের অর্ঘ্য নিবেদনে ফুলের বিকল্প পৃথিবীতে নেই। ফুলকে তাজা রাখতে দোকানিরা সার্বক্ষণিক পানি ছিটানোর ব্যবস্থা রেখেছে। বর্তমানে ফুলের কোন সিজন নেই। ফাল্গুনের প্রথম কয়েকদিন, ভ্যালেন্টাইনস ডেতে ফুল বিক্রি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ঈদের আগের দিন ফুল বিক্রি বাড়ে। জাতীয় দিবসগুলোতে বড় ও মাঝারি ফুলের তোড়া বেশি বিক্রি হয়। সপ্তাহের মঙ্গলবার থেকে শুক্রবার বেশি ফুল বিক্রি হয়। বর্ষাকালে ফুলের বিক্রি কিছুটা কমে। প্রতিটি দোকানে ফুলের তোড়া ও ব্যুকেট বানাবার সরঞ্জাম আছে। ফুলকে ঘিরে প্রতিটি জেলায় নার্সারি গড়ে উঠেছে। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×