ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

টেস্টে বাংলাদেশের স্বপ্নময় একটি দিন

প্রকাশিত: ০৪:১২, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

টেস্টে বাংলাদেশের স্বপ্নময় একটি দিন

মিথুন আশরাফ ॥ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টের প্রথমদিনেই দুর্দান্ত খেলেছে বাংলাদেশ। ৩ উইকেট হারিয়ে ১৫৪ রান করেছিল। এরপরও কি কেউ ভেবেছিল, দ্বিতীয়দিনে ৭ উইকেট হারিয়ে ৫৪২ রানে থেকে দিন শেষ করবে বাংলাদেশ? আবার গুটিয়েও যাবে না? ওয়ানডে ও টি২০ সিরিজে ধবলধোলাই হওয়ার পর আসলে এতটা ভাবনা কারও মধ্যেই আসেনি। আসার কথাও না। কিন্তু সেই কাজটিই করে দেখাল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। বিশেষ করে দুই ব্যাটসম্যান, সাকিব ও মুশফিক। দুইজন মিলে পঞ্চম উইকেটে ৩৫৯ রানের রেকর্ড জুটি গড়ে বাংলাদেশকে একটি স্বপ্নময় দিনই উপহার দিলেন। সাকিব আবার ক্যারিয়ারের সেরা (২১৭) ইনিংস খেললেন। যা বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সেরা ইনিংসও। মুশফিকও (১৫৯) শতক করে দেখালেন। তাতে বিদেশের মাটিতে প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্কোরও গড়ল মুশফিকবাহিনী। এরআগে বিদেশের মাটিতে ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে কখনই ৪৫০ রানও করতে পারেনি বাংলাদেশ। এবার তা করে দেখাল। সঙ্গে একদিনে বিদেশের মাটিতে সর্বোচ্চ রানটিও করল। প্রথমদিনের সঙ্গে দ্বিতীয়দিন ৩৮৮ রান যোগ করল বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে ৫০০ রানের বেশি করে একদিনে এত রান এরআগে কখনই করতে পারেনি বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কায় ২০১৩ সালে দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৩৮ রান করেছিল বাংলাদেশ। সেই ইনিংসে দ্বিতীয়দিনে ১৩৫ রান করার পর তৃতীয়দিনে আরও ৩০৩ রান যোগ করেছিল বাংলাদেশ। এবার সেই রানকেও ছাড়িয়ে গেল দল। সেটি সম্ভব হলো সাকিব ও মুশফিকের দৃঢ়তায়। আগেরদিন ৩ উইকেটে ১৫৪ রান করেছিল বাংলাদেশ। মুমিনুল হক ৬৪ রানে অপরাজিত ছিলেন। শুক্রবার দ্বিতীয়দিনে মুমিনুল আর কোন রানই স্কোরবোর্ডে যোগ করতে পারেননি। এরপর সাকিব ও মুশফিক মিলে যে ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে থাকেন, আর থামেন না। দলের ২০০ রান হয়। ২৫০ রান হয়। ৩০০ রান হয়। ৪০০ রান হয়। ৫০০ রান হয়। দুইজনকে থামাতেই পারেননি নিউজিল্যান্ড বোলাররা। সাকিব শতক করেন। দেড় শ’ করেন। দুই শ’ রানও করে ফেলেন। মুশফিক অর্ধশতক করেন। শতক করেন। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটাররা তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। দুইজন যেন মহাকাব্যই রচনা করে ফেলেন। দুইজন মিলে ৩৫৯ রানের জুটি গড়েন। ৫১৯ রানে গিয়ে মুশফিক আউট হয়ে যান। সাজঘরে ফেরার আগে ২৬০ বলে ২৩ চার ও ১ ছক্কায় ১৫৯ রান করেন মুশফিক। ক্যারিয়ারের চতুর্থ টেস্ট শতক তুলে নেন। সাকিবের আগেই আউট হয়ে যান মুশফিক। তবে সাকিবের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এগিয়ে যান। ১৭৯ বলে ১০০ রান করেন। ২৪০ বলে করেন ১৫০ রান। সাকিব একদিকে ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং করতে থাকেন। আরেকদিকে মুশফিক ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেন। সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগান। শেষ পর্যন্ত সাকিবের আগেই আউট হন মুশফিক। টেস্ট অধিনায়ক যখন আউট হন, তখন সাকিবের স্কোরে ২০৫ রান থাকে। দেখতে দেখতে সাকিব টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোরটিই গড়ে ফেলেন। মুশফিক আউট হওয়ার কিছুক্ষণ পরই সাকিবও আউট হয়ে যান। ৫৩৬ রানে গিয়ে ২৭৬ বলে ৩১ চারে ২১৭ রান করে থামেন সাকিব। ততক্ষণে এরআগে বাংলাদেশের হয়ে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান করা তামিম ইকবালকেও (২০৬) পেছনে ফেলে দেন সাকিব। টেস্টে এরআগে কখন দেড় শ’ রানই করতে পারেননি। তবে তিনটি শতক ছিল। সর্বোচ্চ ছিল ১৪৪ রান। সাকিব এদিন সবাইকেই পেছনে ফেলে দিলেন। টেস্টে বাংলাদেশের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটিই নিজের দখলে নিয়ে ফেললেন। আগেরদিন ৫ রানে ছিলেন অপরাজিত। টেস্টের দ্বিতীয়দিনে আরও ২১২ রান যোগ করলেন। ১৫০ বলে ১০০ রান করেছেন। ১৯১ বলে করেছেন ১৫০ রান। ২০০ রান করতে ২৫৩ বল খেলেন। যখন দুই শ’ রান করে ফেলেন সাকিব, তখন তামিম ও মুশফিকের পর বাংলাদেশের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে ডাবল শতক উপহার দেন এ অলরাউন্ডার। আবার বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের মধ্যে হাবিবুল বাশার (৩০২৬ রান) ও তামিম ইকবালের (৩৪০৫ রান) পর তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনহাজার রানে পৌঁছান সাকিব। তিন হাজার রান ছুঁতে ৭১ রানের প্রয়োজন ছিল সাকিবের। প্রথমদিনে করেন ৫ রান। দ্বিতীয়দিনে তিন হাজার রান ছুঁয়ে ফেলেন শতক করার আগেই। সাকিবের রান এখন ৩১৪৬। দুর্দান্ত এ ইনিংস খেলার পথে আবার সর্বোচ্চ বাউন্ডারি হাঁকান সাকিব। এরআগে ২০১৩ সালে দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই ১৮১ রানের ইনিংস খেলার পথে সর্বোচ্চ ২৭টি বাউন্ডারি হাঁকিয়েছিলেন মুমিনুল। সাকিব তাও ছাড়িয়ে গেলেন। উপমহাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে নিউজিল্যান্ডে সাকিবের আগে আরও পাঁচ ব্যাটসম্যানের ডাবল শতক আছে। তিনজনই পাকিস্তানের ও দুইজন শ্রীলঙ্কার। তারা হচ্ছেনÑ পাকিস্তানের মুশতাক মোহাম্মদ, জাভেদ মিয়াদাদ ও মোহাম্মদ ইউসুফ, শ্রীলঙ্কার অরবিন্দ ডি সিলভা ও কুমার সাঙ্গাকারা। সেই তালিকায় সাকিব যুক্ত হলেন। শুধু যুক্তই হলেন না ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে শতক করলেই যে ‘অনার্স বোর্ডে’ নাম লেখান যায়, সাকিব তাতেও যুক্ত হয়েছেন। সেই তালিকায় মুশফিকুর রহীমেরও নামটি যুক্ত হলো। স্বপ্নময় এমন একটি দিনে এমন একটি প্রাপ্তিও অনেক আনন্দ দেয়। সাকিব ও মুশফিককে সেই আনন্দ ছুঁয়ে গেছে ভালভাবেই। দেশের জন্য কিছু করতে পারাতে সাকিব গর্ববোধ করছেন। আর মুশফিকতো নেতা। তারতো আনন্দের শেষ নেই। সাকিব যেমন দিনটি শেষ হতেই বলেছেন, ‘আমরা ওয়ানডে ও টি২০তে ভাল করতে পারিনি। অন্তত কাগজে-কলমে সে রকমই মনে হবে। টেস্টে ভাল কিছু করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তো অবশ্যই। দেশের জন্যও। আমার এই ইনিংস দলকে ভাল জায়গায় নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, সেই তৃপ্তি আছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি এমন একটা ইনিংস খেলতে পেরেছি।’ তামিমের সঙ্গে সাকিবের প্রায়ই প্রতিযোগিতা হচ্ছে। কখনও তামিম সর্বোচ্চ রানে এগিয়ে যাচ্ছেন। কখনও সাকিব। যখন ডাবল শতক হলো, তখন কি সর্বোচ্চ রান না তামিমকে নিয়ে ভেবেছেন সাকিব? নিজেই জানালেন, ‘আমরা আমাদের মতো করে খেলতে চেয়েছি। ওয়েলিংটনের উইকেট ব্যাটিং করার উপযোগী ছিল। কিন্তু এটাও সত্যি, ওদের দুর্দান্ত কিছু বোলার আছে। কিছু কিছু বল খেলার জন্য কঠিনও ছিল। আর আউট হতে তো একটা মাত্রই বল লাগে। আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম বলের ধরন বুঝে খেলব। আমি নিজে বল খুব ভাল দেখছিলাম। নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম, মাথা ঠা-া করে খেললে রান আসবেই।’ মুশফিকের তৃপ্তি অনেক বেশি। ইনজুরি থেকে ফিরেই এত ভাল একটা ইনিংস খেললেন। দলও ভাল অবস্থায় থাকল। মুশফিক বললেন, ‘মাত্র দুইদিনের খেলা শেষ হলো। এখনও তিনদিন আর তিন ইনিংস বাকি। আমাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তাতে অনেক তৃপ্তি তো আছেই। উইকেট অনেক ভাল আচরণ করছে। তবে এই উইকেটে নিয়ন্ত্রিত বোলিং করলে নিউজিল্যান্ডের জন্য কাজটা অনেক কঠিন হয়ে যাবে।’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘আমাদের শুরুটা ভাল হয়েছিল। যেভাবে ওরা (তামিম, মুমিনুল, মাহমুদুল্লাহ) শুরুটা এনে দিয়েছিল, সেটা আমাদের মধ্যে সাহস আর আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে দেয়। আমরা তার ওপর ভর করেই খেলেছি।’ সেই সাহস দেখিয়েতো দুইজন মিলে রেকর্ড জুটিই গড়ে ফেললেন। ৪৪ বছরের পুরনো রেকর্ডই ভেঙ্গে ফেললেন সাকিব ও মুশফিক। দেশের হয়েও সর্বোচ্চ জুটি গড়লেন। বাংলাদেশের পক্ষে যে কোন উইকেটে এটিই এখন সর্বোচ্চ জুটি। ২০১৫ সালে খুলনা টেস্টে তামিম-ইমরুলের গড়া ৩১২ রানের জুটির রেকর্ড ভেঙ্গে ৩৫৯ রানের জুটি গড়লেন দুইজন। নিউজিল্যান্ডের মাঠে এটি সফরকারী দলগুলোর যে কোন উইকেট জুটিতে নতুন রেকর্ডও। সাকিব-মুশফিক ভাঙ্গলেন ৪৪ বছরের পুরনো রেকর্ড। ১৯৭৩ সালে ডানেডিন টেস্টে চতুর্থ উইকেটে ৩৫০ রান যোগ করেছিলেন পাকিস্তানের আসিফ ইকবাল ও মুশতাক মোহাম্মদ। সেটিই ছিল নিউজিল্যান্ডে ভিনদেশী দলগুলোর সর্বোচ্চ জুটি। সাকিব-মুশফিক সেই জুটিও ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়লেন। আর এ রেকর্ডময় জুটি বাংলাদেশকে স্বপ্নময় একটি দিনই উপহার দিল।
×