ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামী-সম্ভ্রম হারানোর স্বীকৃতি মেলেনি ৪৫ বছরেও

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

স্বামী-সম্ভ্রম হারানোর স্বীকৃতি মেলেনি ৪৫ বছরেও

নিজস্ব সংবাদদাতা, নাটোর, ১৩ জানুয়ারি ॥ আমার স্বামী শহীদ রবীন্দ্রনাথ পাল তৎকালীন লোচনগড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও মুক্তিকামী হওয়ায় আমাদের বাসায় মুক্তিবাহিনীর কয়েক সদস্যের যাতায়াত ছিল। তারা আমার স্বামীর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করতেন। তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন। বিষয়টি জানাজানি হলে ১৯৭১সালের ৫মে রাজাকার-আলবদররা আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে ধরে নিয়ে গিয়ে পাকবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে। পাকবাহিনী তৎক্ষণাৎ রাজাকারদের জিজ্ঞেস করে ‘ইয়া হিন্দু না মুসলিম হায়’? রাজাকাররা বলে, ‘হিন্দু হায়’। উত্তর শোনামাত্রই কোনপ্রকার কাকুতিমিনতির তোয়াক্কা না করে পাকবাহিনী আমার স্বামীকে গুলি করে মেরে ফেলে। বলতে বলতে গলার স্বর মোটা হয়ে আসছিল শহীদ রবীন্দ্রনাথ পালের স্ত্রী আশালতা পালের। ’৭১’র ৯ মাসব্যাপী চলমান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে দেশের জন্য অনেক মা-বোন তাদের ইজ্জত-সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। আশালতা পাল তাদের মধ্যে একজন। শহরের বড়গাছা পালপাড়ায় একমাত্র পুত্র বিশ্বনাথ পালের সাথে থাকেন তিনি। পাকবাহিনীর আঘাতে শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে তার। ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনও চোখের কোণে জল আসে। সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা যে তার কোনদিনই ভোলার নয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামীকে হারানোর পর তিন ছেলেমেয়েকে বুকে আঁকড়ে ধরে কোন রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিলেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীকে হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছিলেন তিন সন্তানের জননী আশালতা। ছেলেমেয়ে নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে, লুকিয়ে কখনও আতœগোপনে থেকে বেঁচে থাকাটাই যেন অসম্ভব ছিল তার কাছে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এদেশীয় পাকিস্তানী দোসর, হায়েনাদের দৃষ্টি এড়াতে পারেননি আশালতা। পাক-চামচারা আশালতাকে ধরে নিয়ে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। সেখানে ৩দিন ধরে পাকবাহিনীরা তার ওপর চালাতে থাকে নির্যাতন। শুধু তাই নয়, তারা তার তিন সন্তানকে মেরে ফেলতে চায়। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে যান। বাঁচলেন বটে তবে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে। রাজাকাররা পাশাবিক নির্যাতন চালানোর পরে ১৯৭১সালের ১৩অক্টোবর ২৪ বছর বয়সে জোরপূর্বক এফিডেভিটের মাধ্যমে আশালতাকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। এ সময় তার নাম দেয়া হয় শামীমা বেওয়া। ধর্মান্তরিত হবার পর কোন রকমে তার দিন কাটছিল। এরপর দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২সালের ১৮নবেম্বর স্থানীয়দের সহায়তায় পুনরায় এফিডেভিটের মাধ্যমে স্বনামে স্বধর্মে ফিরে আসেন তিনি। আশালতা এখন কানে কম শোনেন। মস্তিষ্কের ভারসাম্য দিনে দিনে হারিয়ে ফেলছেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে স্বামী-সম্ভ্রম হারানো আশালতাকে স্বাধীনতার ৪৫বছর পরেও কেউ মনে রাখেনি। আড়ালেই রয়ে গেছে তার স্বামী-সম্ভম হারানোর ইতিহাস। ২০১৬সালের ১১জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ বিভিন্ন দফতরে ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে নিজেকে আওতাভুক্ত করার আবেদন জানান তিনি। তার একটাই দাবি, জীবনের প্রন্তিক সময়ে যেন দু’মুঠো ভাত ও সামান্য কাপড়ের ব্যবস্থা করা হয়।
×