ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : মার্গালিট ফক্স;###;অনুবাদ : এনামুল হক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবার খবর যিনি প্রথম দিয়েছিলেন

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবার খবর যিনি প্রথম দিয়েছিলেন

হঠাৎ দমকা বাতাসের ঝাপ্টা আর তা থেকেই ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ শতাব্দীর সেরা স্কুপ সংবাদটি আহরণ করে নিয়েছিলেন। সেই স্কুপ সংবাদটি ছিল জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণ ঘটতে যাওয়ার এবং এর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যাওয়ার। সমর সংবাদদাতাদের মধ্যে যার পেশাদারী অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা ছিল অবিসংবাদিত সেই ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ গত মঙ্গলবার হংকংয়ে ১০৫ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। শুরুতে যে দিনটির কথা বলা হলো সেটি ছিল ১৯৩৯ সালের ২৮ আগস্ট। ব্রিটিশ সংবাদপত্র দি ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্টার হিসেবে তার চাকরির এক সপ্তাহও হয়নি। জীবনে ওটাই ছিল তার প্রথম চাকরি সেই বায়ুতাড়িত দিনটিতে তিনি তৎকালীন জার্মানির গ্লেইউইজ থেকে পোল্যান্ডের কাটোভিচ পর্যন্ত ২০ মাইলের সড়কে একাই গাড়ি ড্রাইভ করে চলেছিলেন। তাঁকে পাঠানো হয়েছিল ইউরোপের অবনতিশীল উত্তেজনাকর পরিস্থিতির ওপর রিপোর্ট করতে। তারই অংশ হিসেবে তিনি তথ্যানুসন্ধানী মিশনে গাড়ি নিয়ে জার্মানিতে যান। আলোচিত দিনটায় তিনি জার্মান-পোলিশ সীমান্তবর্তী রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দমকা হাওয়ার ঝটকায় ভারি অদ্ভুত এক দৃশ্য ধরা পড়ল হলিংওয়ার্থের চোখে। সীমান্তের জার্মানির দিকের অংশটা তার পোলিশের পর্দায় ঢাকা ছিল, যাতে উপত্যকার এই দৃশ্যাবলী নিচ থেকে কিছু না দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু বাতাসের এক ঝটকায় তারপোলিন উঠে যাওয়ায় হলিংওয়ার্থ দেখতে পেলেন বিপুলসংখ্যক জার্মান সৈন্য, আক্ষরিক অর্থে শত শত ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান ও কামান ঐ উপত্যকায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে। হলিংওয়ার্থ তখন বুঝতে পারলেন যে জার্মানি এক বড় ধরনের সামরিক হামলা চালাতে উদ্যত হয়েছে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পোনিশ অংশে এসে তিনি তড়িঘড়ি টেলিফোন করলেন তার এডিটরকে। জানালেন সংবাদটাÑ যা ছিল বিশ্বব্যাপী একান্তই এক্সক্লুসিভ খবর। তাঁর লেখাটা পরদিন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এ সম্পর্কে আরেক ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দি গার্ডিয়ান’ ২০১৫ সালে মন্তব্য করে যে, ‘সম্ভবত এটি আধুনিককালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্কুপ সংবাদ।’ তিনদিন পর ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের বাহিনী পোল্যান্ড আক্রমণ করে। আর এর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। পরবর্তী চার দশক হলিংওয়ার্থ পূর্ব ইউরোপ, বলকান অঞ্চল ও উত্তর আফ্রিকা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গ্রীক ও আলজিরীয় গৃহযুদ্ধের, ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের শেষ দিনগুলোতে আরব ও ইহুদীদের বৈরিতা এবং সংঘাতের, ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং অন্যান্য সংঘাতের খবরাখবর পরিবেশন করেছিলেন। কখনও তাকে সমালোচিত হতে হয়েছে কখনও গ্রেফতার হতে হয়েছে। গোপন সংবাদের ব্যাপারে তার ঘ্রাণেন্দ্রীয় এত প্রখর ছিল যেÑ তার জন্য কখনও কখনও ব্রিটিশরা তাকে গুপ্তচর বলে অভিযুক্ত করেছে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বিশ্বে ক্ষমতাসীন ক্ষমতাধর প্রত্যেকের কাছে হলিংওয়ার্থ বাহ্যত ছিলেন হয় বন্ধু, না হয় শত্রু। মোহাম্মদ রেজা পাহলভী ১৯৪১ সালে ইরানের শাহ হওয়ার পর তিনিই তাঁর প্রথম সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন এবং ১৯৭৯ সালে শাহ উৎখাত হওয়ার পর যারা তার শেষ সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন তার মধ্যে তিনিও সম্ভবত ছিলেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কভার করতে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু রিপোর্টারদের ফ্রন্টে যেতে দেয়া হচ্ছে না দেখতে পেয়ে তিনি তাঁর পুরনো ঘনিষ্ঠজন তৎকালীন ভারতের তথ্য ও বেতারমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে নিয়েছিলেন। চীন থেকে প্রথম যে ক’জন পশ্চিমা সাংবাদিক নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন করতেন হলিংওয়ার্থ ছিলেন তাদের একজন। তাঁর ঐ সংবাদ পরিবেশনার পরিণতিতেই ১৯৭৩ সালে দি টেলিগ্রাফের বেজিং ব্যুরো খোলা হয়। তাঁর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্কুপ সংবাদের মধ্যে ছিল ১৯৬৩ সালে দি গার্ডিয়ানের পক্ষে লিখিত একটি নিবন্ধ, যেখানে তিনি সোভিয়েত গুপ্তচর বলয়ে ‘তৃতীয় ব্যক্তি’ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে যাকে খুঁজে বেড়ানো হচ্ছিল সেই ব্রিটিশ গোয়েন্দা এজেন্ট কিম ফিলবিকে সতর্কতার সঙ্গে চিহ্নিত করেছিলেন। তার আগেই ঐ বলয়ে যে দুই ব্যক্তির পরিচয় জানতে পারা গিয়েছিল তারা হলেন ইংরেজ নাগরিক ডোনাল্ড ম্যাকক্লিন ও গাই বার্জেস। তাঁর আরেকটি স্কুপ ছিল দি টেলিগ্রাফের পক্ষে লেখা আরেকটি নিবন্ধ, যা লেখা হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। যেখানে তিনি ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রারম্ভিক শান্তি পরিকল্পনা তুলে ধরেছিলেন। (শান্তি আলোচনা ঐ বছরের শেষদিকে শুরু হয় এবং ১৯৭৩ সালে শেষ হয়) হলিংওয়ার্থ প্রায়শই বলতেন যে, একটা টুথব্রাশ, একটা টাইপরাইটার ও দরকার হলে একটা রিভলবার ছাড়া আর বেশি কিছু না নিয়ে তিনি যখন গোটা বিশ্ব ঘুরে বেড়াতেন তখন এর চেয়ে সুখী তিনি আর কখনই থাকতেন না। তিনি ট্রাকে ঘুমিয়েছেন ট্রেনেও ঘুমিয়েছেন, মরুভূমির বুকে রাতের শীতে উষ্ণতার সন্ধানে তিনি মাঝে মাঝে গলা পর্যন্ত বালুতে ডুবিয়ে রাখতেন। তিনি একবার আলজিরিয়ার এক সশস্ত্র পুলিশকে জুতা দিয়ে মাথায় আঘাত করার হুমকি দিয়ে নিবৃত্ত রেখেছিলেন। হিলিংওয়ার্থ পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে, প্রায় বিশ বছর আগে দৃষ্টিশক্তি হারাতে শুরু না করলে তার যে জীবন ছিল সেই জীবন তিনি তার শেষ দিনগুলো পর্যন্ত মহানন্দেই চালিয়ে যেতেন। শততম জন্মদিনের প্রাক্কালে ২০১১ সালে তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফকে বলেছিলেন ‘আমি অবশ্যই স্বীকার করব যে, যুদ্ধের মধ্যে কাটানোই আমার কাছে পরম উপভোগ্য।’ ১৯৮৯ সালে তিয়েন আন মেনের রক্তাক্ত ঘটনার সময় তাকে সেখানে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। তখন তার বয়স প্রায় ৮০ বছর। নামেমাত্র অবসরে গেছেন। ৬০ বছর ধরে তাঁর কর্মকালীন সময়ের পোশাক সাফারি স্যুটে তিনি একটি ল্যাম্পপোস্টে দাঁড়িয়ে অসামরিক বিক্ষোভকারীদের ওপর সরকারের সহিংস দমন অভিযান এক নজর দেখেছিলেন। বয়স ৯০-এর কোঠায় থাকাকালেও তিনি মাঝে মাঝে তাঁর হংকংয়ের বাড়ির মেঝেতে শয্যাযাপন করতেন। উদ্দেশ্য আর কিছু নয় নরম কোন কিছু থেকে দূরে থাকা। তবে যত কিছু করুন আর যেখানেই ঘুরে বেড়ান একটা ব্যাপার তিনি মেনে চলতে পারতেন না। সেটা নিয়মিত স্নান করা। এক সপ্তাহ কি তারও বেশি সময় স্নান না করে কাটালেও তার তেমন খারাপ লাগত না। তবে চুলে উকুন হওয়া তিনি সহ্য করতে পারতেন না। সেই টাইপরাইটার, রিভলবার নিয়ে তাঁর গ্রাহাম গ্রীন মার্কা অস্তিত্ব তাঁর জন্য ব্রিটিশ বাবা-মায়ের কল্পিত কেতাদুরস্ত সুপরিপাটি জীবন থেকে কতই না আলাদা। ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থের জন্ম ১৯১১ সালের ১০ অক্টোবর মধ্য ইংল্যান্ডের নাইটনে। শিশু বয়সে বাবার সঙ্গে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ঐতিহাসিক রণাঙ্গনগুলো ঘুরে বেড়াতে ভালবাসতেন। বাবা একটা পারিবারিক জুতার কারখানা চালাতেন। বাবা-মার পীড়াপীড়িতে হলিংওয়ার্থ তরুণ বয়সে লিসটারে গার্হস্থ্য বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানকার পড়াশোনার অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে ঘর-সংসার জীবনের সম্ভাবনা আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেনি। হলিংওয়ার্থ পরে লিখেছেন ‘ওমলেট বানাতে পারা যদিও একটা কাজের কাজ তথাপি গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের যে ট্রেনিং আমি পেয়েছিলাম তার কারণে ঘরসংসারের যে কোন কাজকে ঘৃণা করতে শিখেছি।’ তিনি যেভাবে লালিত হয়েছিলেন অংশত তার প্রতি বশ্যতা মেনেই একজন উপযুক্ত তরুণের সঙ্গে তার বাগদান হয়। কিন্তু অচিরেই বাগদান ভেঙ্গে যায়। পরে তিনি সাংবাদিক হওয়ার অভিপ্রায় ঘোষণা করে বাবা-মায়ের আরও মর্মপীড়ার কারণ ঘটান। ২০১১ সালে দি টেলিগ্রাফের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে হলিংওয়ার্থ বলেন, ‘মা ভাবতেন সাংবাদিকতা ব্যবসার মতোই ভয়ঙ্কর নিচু কাজ। সাংবাদিকরা যা লিখত তার কিছুই তিনি বিশ্বাস করতেন না।’ ১৯৩০ এর দশকে হলিংওয়ার্থ লন্ডনের স্কুল অব সøাভোনিক এ্যান্ড ইস্ট ইউরোপিয়ান স্টাডিজে ভর্তি হন। এরপর পড়াশোনা করেন তৎকালীন যুগোসøাভিয়ার ‘ইউনিভার্সিটি অব জাগ্রেব’-এ। ১৯১৮ সালে ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত শান্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার সংগঠন লীগ অব নেশনসের পক্ষে কর্মরত অবস্থায় তাঁকে ওয়ারশতে পাঠানো হয়। সেখানে ১৯৩৮ সালের অক্টোবরে নাৎসিদের দখল করে নেয়া চেকোসেøাভাকিয়ার সুডেটেনল্যান্ডের হাজার হাজার উদ্বাস্তুকে তিনি সহায়তা দেন। তাদের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পোল্যান্ডে যাওয়ার উপযোগী ভ্রমণ সংক্রান্ত নথিপত্রের ব্যবস্থা করে দেন। ব্রিটেনের ছোটখাটো পত্রপত্রিকায় তিনি তাদের দুঃখ-দুর্দশার ওপর লেখেন। দি টেলিগ্রাফ পোল্যান্ডে হলিংওয়ার্থের কাজকর্ম সম্পর্কে জানতে পারে এবং ১৯৩৯ সালের ২৫ আগস্ট তিনি যখন লন্ডন সফরে ছিলেন সে সময় তাঁকে তাদের সংবাদদাতা হিসেবে রিক্রুট করে। এ অঞ্চলে যুদ্ধের পূর্ববর্তী পরিস্থিতি কভার করার দায়িত্ব পেয়ে পরদিন তিনি বিমানে করে ওয়ারশতে চলে যান। ওয়ারশ থেকে তিনি সেখানকার ব্রিটিশ কনসুল জেনারেলের কাছ থেকে নেয়া সরকারী গাড়ি চালিয়ে কাটোভিসে চলে যান। ঐ গাড়িতে ইউনিয়ন জ্যাক সদর্পে উড়ছিল। সেই গাড়িটি তিনি নাৎসি সীমান্তরক্ষীদের বিস্মিত দৃষ্টির সামনে দিয়ে চালিয়ে নিয়ে ২৮ আগস্ট জার্মানিতে প্রবেশ করেন। হলিংওয়ার্থের স্কুপ কাহিনীর দুটো অংশ ছিল। প্রথমটি ছিল ২৯ আগস্টের, যেখানে যুদ্ধের ঘনঘটা বেজে ওঠার কাহিনী ছিল। দ্বিতীয়টি ছিল খোদ যুদ্ধ শুরু হওয়ার ওপর প্রতিবেদন। ১ সেপ্টেম্বর ভোরবেলা বিস্ফোরণের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেন হলিংওয়ার্থ। কাটোভিসে নিজের কোয়ার্টার থেকে তিনি দেখতে পান মাথার ওপর উড়ছে জার্মান বোমারু বিমান এবং দূরে কামানের গোলাবর্ষণের ঝলকানি। ওয়ারশতে ব্রিটিশ দূতাবাসে এক বন্ধুকে টেলিফোন করলেন তিনি। চিৎকার করে বললেন, ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে’, অপরপক্ষের কণ্ঠ : ‘তুমি ঠিক জেনে বলছো তো বুড়ি?’ হলিংওয়ার্থ পরে লিখেছেন তাঁর প্রকাশিত নিবন্ধগুলোতে যাই থাকুক ব্রিটিশ ‘সরকারী কর্মকর্তারা তখনও এই ভাবনায় ডুবে ছিল যে, যুদ্ধ লাগতে আরও কয়েক সপ্তাহ দেরি আছে। বাইরে জার্মান ট্যাঙ্কের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। তাই হলিংওয়ার্থ টেলিফোনের রিসিভারটা জানালার বাইরে মেলে ধরলেন। দূতাবাসকে প্রকৃত পরিস্থিতিটা বোঝানো হলো এবং অচিরেই বোঝানো হলো তাঁর সম্পাদককেও। যুদ্ধ শুরু হওয়া সম্পর্কিত হলিংওয়ার্থের রিপোর্টটি পরদিন দি টেলিগ্রাফে ছাপা হয়। এই সময় থেকে তাঁর লেখাগুলো স্বনামে ছাপা হতে থাকে। খুব কমসংখ্যক রিপোর্টারই তখন স্বনামে রিপোর্ট প্রকাশের সুযোগ পেত। এটাকে তিনি তাঁর সর্বোত্তম কাজের স্বীকৃতি হিসেবে উল্লেখ করতেন। এতে করে একই সঙ্গে তাঁর বাবা-মা পারিবারিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও সামাজিক অমর্যাদার হাত থেকে রেহাই পেলেন। এরপর যা হলো তা হচ্ছে ৪০ বছর ধরে বিপদের পিছনে ধাওয়া করে চলা। কারণ হলিংওয়ার্থ প্রায়ই বলতেন সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থানগুলোতেই সেরা সেরা কাহিনী লুকিয়ে থাকে। ব্রিটিশ সৈন্যদের সঙ্গে আফ্রিকা যাওয়ার পর সেখানে একবার এক রাতে জার্মান গোয়েন্দা দলের উপস্থিতির শব্দ পেয়ে তিনি নিজেকে বালির নিচে চাপা দিয়ে রাখেন। পরে এই ঘটনা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘সামান্য একটা হাঁচি আমাদের সবার মৃত্যু ডেকে আনতে পারত।’ অন্ধকারে তিনি নিঃশ্বাস বন্ধ করেছিলেন। জার্মান দলটি কোন কিছু না দেখতে পেয়ে চলে যায়। ভিয়েতনামে এক স্নাইপারের বুলেট অল্পের জন্য তাঁর মাথায় লাগেনি। হলিংওয়ার্থের প্রথম স্বামী ভ্যানদেলিউর রবিনসন। তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ১৯৩৬ সালে। এক সঙ্গে দীর্ঘদিন না থাকার কারণে ১৫ বছর পর স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেন। ২০০৪ সালে ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকার কাছে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যখন কোন কাহিনীর পিছনে থাকি তখন কাহিনীর পিছনেই থাকিÑ তখন গোল্লায় যাক আমার স্বামী, পরিবার ও অন্য কেউ।’ তাঁর দ্বিতীয় স্বামী জিওফ্রে হোয়ের ছিলেন সাংবাদিক। ১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিকে তিনি হলিংওয়ার্থকে বিয়ে করেন। ১৯৬৫ সালে মারা যান। কালক্রমে ব্রিটিশ সংবাদপত্রের কিছু সদস্য হলিংওয়ার্থের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও কর্তৃত্ববাদী আচরণের জন্য তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যান। ব্রিটিশ সাংবাদিক বরার্ট ফিস্ক তার ১৯৯০ সালের স্মৃতিকথা ফ্রন্টলাইনের পর্যালোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন : হলিংওয়ার্থের গরিবের প্রতি তাচ্ছিল্য ভাব বড়লোকী ভাব অতি বিরক্তিকর। ব্রিটিশ দূতাবাসগুলোর সঙ্গে মাখামাখি সম্পর্ক বড্ড পীড়াদায়ক। তথাপি তিনি বহুল প্রশংসিত, এমনকি শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব হিসেবে রয়ে গেছেন। ১৯৮২ সালে তিনি অর্ডার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ারে ভূষিত হন। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘থ্রি উইকস ইন পোল্যান্ড’ (১৯৪০), ‘দেয়ার ইজ এ জার্মান জাস্ট বিহাইন্ড মি’ (১৯৪২), ‘দি এরাবস এ্যান্ড দি ওয়েস্ট’ (১৯৫২) এবং ‘মাও এ্যান্ড দি মেন এগেইনস্ট হিম’ (১৯৮৫)। হলিংওয়ার্থ অনেক বুড়িয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধেরও কোন অভাব ছিল না। তথাপি সেগুলো কভার করার মতো বয়স তাঁর ছিল না। কভার করার ডাকও তিনি কারোর পক্ষ থেকে পাননি। অথচ শেষ দিকে যখন ঘুমাতেন তাঁর পাসপোর্ট ও জুতাজোড়া থাকত নাগালের মধ্যেই। সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
×