ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নওগাঁর রাতোয়াল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হাই স্কুল ১৩২ বছর ধরে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আসছে

প্রকাশিত: ০০:৫৪, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

নওগাঁর রাতোয়াল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হাই স্কুল ১৩২ বছর ধরে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আসছে

বিশ্বজিৎ মনি, নওগাঁ ॥ “ধ্যানের চর্চা হয় গুহায়, ধর্মের চর্চা হয় উপাসনালয়ে (মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডা), নীতির চর্চা হয় নিজ পরিবারে আর বিদ্যার চর্চা হয় বিদ্যালয়ে”। জগতের চিরন্তন সত্য কথাগুলোর মধ্যে উপরোক্ত কথাগুলো অন্যতম। আর ঠিক এমনই একটি বিদ্যা চর্চার স্থান নওগাঁর রানীনগর উপজেলার রাতোয়াল গ্রামে ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী বিদ্যাপিঠ ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়’টি দীর্ঘ ১৩২ বছর ধরে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আসছে। বিদ্যালয়টি রবীন্দ্র নিদর্শন এবং সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে তৎকালিন সময়ে স্থাপিত একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮৮৫ সালে স্থাপিত এই বিদ্যালয়টি ১৯১৩ সালে একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে। বিদ্যালয়টিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা প্রদান করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৩ শ’ ৮০জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এরমধ্যে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩শ’ জন শিক্ষার্থী পাঠগ্রহণ করে থাকে। বিদ্যালয়ে মোট ৮জন শিক্ষক ও ৪জন কর্মচারী কর্মরত আছেন। বিদ্যালয়ে নতুন ও পুরনো মিলে মোট ৭টি কক্ষে চলে পাঠদান কার্যক্রম। বিদ্যালয়ের উত্তর দিকের দুই তলা ভবনটি তৈরী হয়েছিল ১৯৯৫ সালে, পূর্বদিকের দুই তলা ভবনটি তৈরী হয়েছিল ২০০৬ সালে ও পশ্চিম দিকের টিন শেডের জোড়া তালি দেয়া পুরনো কক্ষগুলোতেই চলছে পাঠদান কার্যক্রম। বিদ্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৮৮৫ সালের শুরুর দিকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া কালীগ্রাম পরগনার জমিদারি দেখাশুনার জন্য রাতোয়াল গ্রামে আসতেন। তিনি (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) বিশ্বাস করতেন, প্রজাদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষার আলো ছাড়া প্রজাদের সার্বিক উন্নয়ন একেবারেই সম্ভব নয়। সে উপলব্ধি থেকেই সেই সময়ের কিছু পন্ডিতদের সহায়তায় এই রাতোয়াল গ্রামে বিশ্বকবির নামে আদর্শ এই বিদ্যাপিঠের পথ চলা। সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ম্যানেজার শ্যামানন্দ গুহ কালিগ্রাম পরগনার এই মূল জমিদারি (পতিসর ষ্ট্রেট) দেখাশুনা করতেন এবং তার ছেলে নিত্যানন্দ গুহ ( নিতাই বাবু) দেখাশুনা করতেন (সাবষ্টেট) তথা এই এলাকা। তাদের সার্বিক সহযোগিতায় তৎকালিন রাতোয়াল গ্রামের আক্কাছ আলী পন্ডিত, শমসের আলী আকন্দ, কফিল আলী আকন্দ এবং এরফান আলী আকন্দকে সঙ্গে নিয়ে এই ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টির পথচলা শুরু হয়। বিদ্যালয়টি তৎকালিন সময়ে আজিজুল্লাহ আকন্দের বৈঠকখানায় শুরু হলেও পরবর্তীতে রবীন্দ্র ষ্টেটের নিজস্ব সম্পত্তির ওপড় মাটির ক’টি ঘর তৈরি করে ১৮৮৫ সালে প্রাথমিক ভাবে শিক্ষাদান শুরু হয়। তখন হেড পন্ডিত হিসেবে রাতোয়াল গ্রামের আক্কাছ আলী পন্ডিতের ওপড় বিদ্যালয়টির দায়িত্ব অর্পন করা হয়। পরবর্তীতে আরও অনেকেই ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়টির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশ্বকবির স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়টি আধুনিকতার ছোঁয়া থেকে আজো অনেক পিছিয়ে আছে। আদর্শ এই বিদ্যাপিঠ থেকে শিক্ষা নিয়ে এলাকার অনেকেই আজ দেশ-বিদেশসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগে উর্দ্ধতন পদে কর্মরত থেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলছেন। আর সেইসঙ্গে বিশ্বের মাঝে আলোকিত করেছেন এই অজপাড়া গাঁয়ের এই আদর্শ বিদ্যালয়টির নাম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক জুলু চৌধুরী, প্রকৌশলী মুজিবুর রহমান ছিলেন বিসিআইসির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী, ৫ম শ্রেণির গণিত বইয়ের লেখক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ লুৎফুত জামান ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মোখলেছুর রহমানসহ আরোও অনেকেই ছিলেন এই আদর্শ বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থী। পরবর্তী সময়ে বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছেন, ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং শান্তি নিকেতনের প্রতিনিধিবৃন্দ। এছাড়াও দেশের মন্ত্রী, এমপি, সরকারি উর্ধতন কর্মকর্তা, রবীন্দ্র গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিকসহ নানা গুনিজন। কিন্তু শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে গৌরব উজ্জ্বল মুকুট মাথায় পড়ে দাঁড়িয়ে আছে যে বিদ্যাপিঠ, সেই ঐতিহাসিক বিদ্যালয়টিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগানোর কোন পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত কেউ গ্রহন করেনি। বিশ্বকবিকে প্রত্যক্ষভাবে দেখার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী রাতোয়াল গ্রামের শরফরাজ আলী আকন্দ (১০০) স্মৃতিচারন করতে গিয়ে বলেন, বিশ্বকবি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর শেষ বারের মত যখন তার পতিসরের জমিদারি দেখতে আসেন, তখন তিনি (শরফরাজ আলী আকন্দ) এই বিদ্যালয়টিতে ৫ম শ্রেণিতে পড়তেন। বিশ্বকবিকে প্রত্যক্ষ ভাবে দেখার জন্য এই বিদ্যালয় থেকে তিনি সহ আরও অনেক ছাত্ররা পতিসরে পায়ে হেঁটে গিয়েছেন। বিশ্ব কবিকে দেখতে পতিসরে গেলে সেখানে আগত মানুষদের যে খাবার খাওয়ানো হয়েছিল, তার স্বাদ এখনো জিহ্বায় লেগে রয়েছে বলে জানান তিনি । এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোঃ আকতার আহমেদ বলেন, আমি এই আদর্শ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম বলে গর্বিত। আমি বর্তমানে এই বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি এই ঐতিহ্যবাহী আদর্শ বিদ্যাপিঠের সার্বিক উন্নয়ন করার জন্য। বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমান প্রধান শিক্ষক মোঃ শুকবর আলী জানান, আমি কখনো ভাবতে পারিনি যে আমি এই ঐতিহ্যবাহী আদর্শ বিদ্যাপিঠের ছাত্র থেকে শিক্ষক হবো। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমি সবসময় চেষ্টা করে থাকি, এই বিদ্যাপিঠ থেকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে শিক্ষার্থীদের আগামীর জন্য তৈরি করতে।
×