ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থী আইয়ানা

অমরাবতী

প্রকাশিত: ০৭:০১, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

অমরাবতী

: হ্যাঁ। অতির মা আমার দিকে হতাশ হয়ে তাকাল। বেচারির দিকে তাকিয়েই আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আহারে, কী অসহায় দেখাচ্ছে ওনাকে। আমি রাত দশটা থেকে রোগী দেখা বন্ধ করে দিই। চেম্বারে থাকি সাড়ে দশটা পর্যন্ত। বই-টই পড়ি। এখন বাজে দশটা চুয়াল্লিশ মিনিট। আমি শেষ রোগীটা দেখে যখন ভাবছি আজকের মতো চুকিয়ে দিব তখন এই ভদ্রমহিলা হন্তদন্ত হয়ে আমার রুমে ঢুকেন- ‘স্যার আপনাকে এতো রাতে বিরক্ত করার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি, কিন্তু বেশি সময় নিব না।’ এনাদেরকে কেও আটকাননি। আমিও আগ্রহ নিয়ে গত পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে এনাদের মা-মেয়ের কথা শুনছি। ভদ্রমহিলার মেয়ের নাম অমরাবতী। ছোট করে ডাকে অতি। অদ্ভুত সুন্দর নাম। অতির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় এই চেম্বারে এক বছর আগে। আমি একজন সাইকোলজিস্ট। অতির কেসটা ছিল সে প্রতি রাতে একটা নীল শাড়ি পরা মেয়েকে দেখতে পায়। হ্যালুসিনেশন। গত এক বছর কাউন্সিলিং করে আমি তাকে বেশ সারিয়ে তুলেছিলাম। তার মা বলতে চাইছে এই কিছুদিন ধরে তার অসুখটা আবার শুরু হয়েছে। অতির মা মিসেস রেহনুমা কথা না বলা ছাড়া বোধহয় এক মুহূর্তও থাকতে পারেন না। আমি তাকে বিনীতভাবে অনুরোধ করলাম বাইরে অপেক্ষা করার জন্য। আমি অতির সঙ্গে একা কিছু কথা বলতে চাই। : তাকে তুমি আবার দেখেছ, তাই না অমরাবতী? : হ্যাঁ। : কী করে সে? : সবসময় যা করে। পরনে নীল শাড়ি, কপালে নীল টিপ, পায়েল পরা.. চুপচাপ বসে থাকে। : হাতে লাল কাঁচের চুড়ি? : ও হ্যাঁ.....লাল কাঁচের চুড়ি। গত এক বছর এতো গবেষণা করেছি এই কেসটা নিয়ে যে খুঁটিনাটি ডিটেইল আমার মুখস্থ। অতি তার এক পুরনো বন্ধুকে হ্যালুসিনেইট করে এটা নিশ্চিত। ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ার সময় অতির খুব একজন ভাল বন্ধু এভাবে সেজেছিল। পুরনো ছবি দেখে আবিষ্কার করি। তারপর ওই মেয়েটার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। মেয়েটার নাম সৃষ্টি। সে মারা গেছে ছ’বছর আগে। প্রথমত ধারণা করি সেই শোকেই অতির খেয়াল গেছে। কিন্তু বিষয়টা তার চেয়েও গভীর। অতি বিশ্বাস করে সৃষ্টি বেঁচে আছে.... কিন্তু অনেক দূরে কোথাও সে আছে। অতির একটা গোপন ভয়ও আমি আবিষ্কার করি। সে ‘ভুলে যাওয়াকে’ ভয় করে। সে কোন প্রিয় বন্ধুকে ভুলে যেতে চায় না। তার ধারণা সময়ের পরিক্রমায় বন্ধুত্ব হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। স্মৃতি হয়ত বন্ধুকে মনে রাখে কিন্তু বন্ধুত্বটা ধীরে ধীরে মুছে যায়। এই অদ্ভুত মানসিক পীড়ন তার এই অসুখের জন্ম দেয়। সে তার ছেলেবেলার বন্ধুকে হ্যালুসিনেইট করা শুরু করে। অতিকে আমি যত দেখি তত অবাক হই। এই দীর্ঘ কারিয়ারে কখনও এমন কারোর সম্মুখীন হইনি। আশ্চর্য মানবী। ভুল বললাম। সে তো অমরাবতী। ওর চোখের দিকে তাকাতে আমার কেমন যেন ভয় করে। একজন সুস্থ মানুষের কর্মকা-ের পিছে যতটা না গভীর কারণ থাকে একজন অসুস্থ মানুষের প্রতিটি কাজের পিছে খুব গভীর কারণ থাকে। লোকে বলে ‘পাগল’ কিংবা ‘পাগলামি’। আমার দীর্ঘ দিনের পড়াশোনা তা বলে না। তারা আবেগপ্রবণ হয় এটা সত্যি কিন্তু কতখানি আবেগপ্রবণ তা এই মেয়েটাকে দেখার আগে আন্দাজও করতে পারিনি। : অমরাবতী তুমি কি বিশ্বাস কর পৃথিবীতে কোন রহস্য নেই? মিসির আলি পড়ো না? ‘প্রতিটি আলৌকিক ঘটনার পেছনে একটা লৌকিক ব্যাখ্যা আছে’- হুমায়ূন আহমেদের কথা। অমরাবতী ঠিক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি কবে আপনাকে আলৌকিক কাহিনী শুনিয়েছি?’ এটা বলে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আর একটা কথা না বলে দরজার দিকে এগুলো। ‘তবে আমায় একদিন ওই নীল শাড়ি পরা মেয়েটার সঙ্গে দেখা করিও’- আমি পেছন থেকে বললাম। অমরাবতী থমকে দাঁড়ালো। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুনুন, ওকে নীল শাড়ি পরা মেয়ে বলে ডাকা বন্ধ করুন। ওর নাম সৃষ্টি। আমি জানি ওকে নীল শাড়ি পরে খুব মিষ্টি দেখায় কিন্তু তার মানে এই না যেয়ে ওর নাম নীল শাড়ি পরা মেয়ে।’ এই বলে সে বেরিয়ে গেল। ॥ ২ ॥ রহিম নামের ছেলেটার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। ভয়ে মুখটা ছোট হয়ে গিয়েছে। সে অনেক দিন ধরে অতিদের বাসায় আছে। দশ-বারো বছর। রান্নার কাজে তাকে রাখা হয়েছে। এতো ছোট বয়সেও চমৎকার রান্নার হাত। সে বিড় বিড় করে কিছু একটা বলছে। আমি শোনার চেষ্টা করলাম- আফা পাগল না..... আফা পাগল না..... না. .. না। চোখ নিচের দিকে। : বাসার সবাই কোথায় রহিম? : জানি না। : বাইরে গিয়েছে? : জ্বে। : তাহলে তো কিছুক্ষণ বসতেই হবে। এক কাপ ফাটাফাটি চা বানিয়ে আন তো রহিম মিয়া। রহিম নড়লো না। মনে হচ্ছে আমাকে কিছু বলতে চাইছে। : কিছু বলবে? : হুঁম। : তোমার গল্পটা চা খেতে খেতেই শুনি তবে? অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আমি অতিদের বাসায় এসেছি রহিমের সঙ্গেই কথা বলতে। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও সন্দেহজনক দেখালে চলবে না। তাই একটু ধীরে এগোচ্ছি। গতকাল অতির মা আবার আমার চেম্বারে আসেন। মুখ ফ্যাকাশে। রক্তশূন্য চোখ। : কোন সমস্যা হয়েছে আবার? : ডাক্তার সাহেব..... আমি মানে..... ইয়ে... : বলুন শুনছি। : আমি..... : নির্ভয়ে কথাটা বলে ফেলুন। অতি বেশি পাগলামি করছে? : ডাক্তার সাহেব..... আমি... আমি ওই নীল শাড়ি পরা মেয়েটাকে দেখেছি। থতমত খেয়ে গেলাম। ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না এই কথাটার জন্য। ‘বিশ্বাস করুন আমায়- নিজের চোখে দেখেছি’, অতির মা’র করুণ আবেদন। ‘বুঝলাম। একটু খোলসা করে বলুন’, আমি গলার স্বর যথাসম্ভব ঠাণ্ডা রেখে বললাম। ‘কাল রাতে একটুও ঘুম আসছিল না। পানি খেতে উঠে-দেখি অতির ঘরের আলো জ্বালানো। দরজা একটু খোলা ছিল। সেই ফাঁক দিয়ে দেখি বিছানার ওপর একটা নীল শাড়ি পরা মেয়ে বসে আছে। তার পাশে অতি’- অতির মা এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল। ‘বেশ বেশ। আমার কথাটা একটু মন দিয়ে শুনুন। অতি দীর্ঘদিন অসুস্থ। আপনি এই দীর্ঘদিন তার পাশেই ছিলেন- ওর অসুখের সময়টা। তার প্রভাব আপনার উপর পড়েছে। সহজ করে বলি- একজন ব্যক্তি যখন কোন কিছু খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে তার আশপাশের মানুষেরাও তা দেখাদেখি বিশ্বাস করা শুরু করে। ক্লিনিকাল ভাষায় আমরা বলি- ‘রহফঁপবফ যধষষঁপরহধঃরড়হ’। একটা কথা আছে ‘ংবব ধহফ ংঁৎসরংব ড়ৎ ংঁৎসরংব ধহফ ংবব’- এটার উত্তরই সব রহস্যের সমাধান। বুঝতে পেরেছেন?’ উনি বিনা প্রতিবাদে সেদিন চলে যান। আমি ধরে নিয়েছি, তিনি আমার কথা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু আমার নিজের মধ্যে কেমন জানি একটা খুত খুত ভাব হচ্ছে। তাই অতিদের বাড়িতে আসা। এই সময়টায় ওরা কেও বাসায় থাকে না আমি জানি। রহিম চা এনে আমার সামনে রেখেছে। চা মুখে দিলাম- অসাধারণ! চা বানানোর জন্য যদি কোনদিন নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়- তবে তা রহিমের প্রাপ্য। আমি সহজভাবেই শুরু করলাম- : রহিম আমায় কিছু বলতে চাচ্ছিলে? : জ্বে। এই বাড়িতে ভূত আছে। : তাই নাকি? কয়টা ভূত? মেয়ে নাকি ছেলে? : একটাই মাইয়া। নীল শাড়ি পিন্দা থাকে। প্রতিদিন রাত্তিরিতে ঘুমাইতে যাবার পর আসে। : আমায় কেন বলছ এসব? : অতি আফার অসুখের কথা আমি জানি ডাক্তার বাবু। কোন সমস্যা হইলেই খালাম্মা আপনার কাছে ছুইটা যায়। আপনি কি ভূত তাড়াইতে জানেন? : না বাবা। তুমি বললে ঘুমোতে যাবার পর আসে। তুমি তাকে দেখলে কোথায়? : একদিন রাত্রে মশারি লাগায় ঘুমাইতে গেছি মাত্র। বাতি নিভানো। হঠাৎ দেখি ঘরে কার ছায়া। আমি তো ভয়ে মইরা যাইতেছি। চোখ বন্ধ করে রাখছি। একটু পর দেখি আর নাই। কিন্তু আমার ঘরের লগের বারান্দার বাতি জ্বালানো ছিল। দেখি বারান্দায় একটা নীল শাড়ি পরা মাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দার আরেক প্রান্তে অতি আপার ঘর। দেখি ওই ঘরের দিকেই যাইতেছে। এরপর কয়েক রাত্রি এমন জিনিস দেখছি। রহিম সামান্য কাঁপছে। আমি প্রসঙ্গ বদলালাম, ‘ওরা তো এখনও আসছে না দেখি। তোমাদের বাড়ির পেছনে নাকি অনেক ফুলের গাছ। আমায় দেখাবে?’ রহিম একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। উৎসাহিত গলায় বলল, ‘চলুন দেখাই। কয়েকটা গাছ আমি লাগাইছি, কয়েকটা অতি আপা।’ আমার বাগান দেখার এই মুহূর্তে কোন শখ নেই। আমি ওখানে যাচ্ছি কারণ- বাড়ির পেছনে মানে রহিম যেই বারান্দাটার কথা বলছে সেইটা ওখান দিয়ে দেখা যাবে। কিছু বারান্দা বিষয়ক হাইপোথিসিস আছে আমার। অতিদের বাড়িটা পুরনো একতলা একটা বাড়ি। আশপাশে প্রচুর গাছ। রহিম আমাকে গাছ দেখাচ্ছে আর ফুলগুলোর নাম বলছে। রহিমের সেই বারান্দাটা ঠিক আমার সামনে। বারান্দার সঙ্গেই লাগানো রহিমের ঘর। আরেকটু দূরে আরেকটা ঘর। ওটা নিশ্চই অতির। এবং যা ভেবেছিলাম তাই। একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করলাম। যথা সময়ে বলা হবে। ॥৩ ॥ আজ চেম্বারে যাইনি। সকাল থেকে বাসায়। শরীর ভাল। কিন্তু খুব অস্থির ভাব হচ্ছে। দুয়েকবার ঘরের পায়চারি করেছি। একটু পরপর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি। আমায় দেখে যে কেও ভাববে আমি কারোর জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু আমি কারোর জন্যই অপেক্ষা করছি না। না কি করছি? আশ্চর্য। এভাবেই বিকেল গড়িয়ে আসল। চারদিকে একটা গুমুট ভাব। একটুও বাতাস নেই। কলিং বেল বাজল। একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। স্বস্তির? কী জানি। দরজা খুলে হতাশ হলাম। পরিচিত কেউ নয়। পেশেন্ট হবার সম্ভাবনা। আমার স্টুডেন্টও হতে পারে। ইদানীং কারোর চেহারা মনে রাখতে পারি না। মেয়েটা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি ডাক্তার সাহেব?’ : হ্যাঁ। কিন্তু আজকে চেম্বারে বসব না। শরীর ভাল নেই। রোগী দেখব না। আমি স্পষ্ট মেয়েটার মুখে একটা হাসি দেখতে পেলাম। বড়রা যখন ছোটদের মিথ্যে ধরে ফেলে, তখন যেভাবে হাসে। আমি কোথায় মিথ্যা বললাম? আমার রোগী দেখতে না ইচ্ছা করতেই পারে। ওর কি? : আপনি ভুল ভাবছেন। আমি রোগী দেখাতে আসিনি। আপনার সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল স্যার। : ঠিক আছে। ভেতরে এসো। আমরা বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে বসলাম। মাঝখানের টেবিলের দু’পাশে দু’কাপ চা। আজব ব্যাপার তো! আমি নিজের জন্য সারাদিন অনেকবার চা বানাই। হয়ত এটা একটু আগে আমিই বানিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু দু’কাপ? আজকের দিনটাই আজব। : বলুন কি বলতে চান। ক্ষমা করবেন আপনাকে ঠিক চিনতে পারিনি। : অবাক হইনি কিন্তু একটু মন খারাপ করেছি। আমায় নিয়ে সারাদিন এত গবেষণা করেন। : আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি কে? : সৃষ্টি। আমি একটুও বিচলিত হলাম না। এই দিনটার জন্য অনেক প্রস্তুতি নিয়েছি। তাহলে, আমার ইনটিউশন সকাল থেকে ভালই কাজ করছিল। : সৃষ্টি, শোনো। তুমি করে বলছি। তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। আমার মেয়ের বয়সী। রাগ করনি তো? : মোটেও না। আপনি বলুন যা বলার আছে, আমি শুনছি। মেয়েটার কথার ভঙ্গিতে এক রকম বিদ্রুপ লক্ষ্য করলাম। সামান্য বিরক্ত হলাম। : হুঁম। যা বলছিলাম। তুমি আমার সম্পর্কে সম্ভবত দুটা জিনিস জানো না। এক আমায় যতটা বোকা ভাবছ আমি ততটা বোকা নই। দুই আমি কখনও কোন রহস্যে বিশ্বাস করি না। রহস্য যারা তৈরি করে, তারা অন্ধকারে থাকতে ভালবাসে। : জ্বি অবশ্যই। আর কিছু? : তুমি যে মারা যাওনি এটা আমি জানি। আই মিন, সম্প্রতি আবিষ্কার করেছি। অতি তোমাকে হ্যালুসিনেইট করত এটা সত্যি। কিন্তু তুমি রিসেন্টলি তার সিজোফ্রেনিয়াকে উশকায় দেয়ার জন্য তার বাড়িতে প্রতি রাতে যেতে। ঠিক ওই সাজেÑ নীল শাড়ি এ্যান্ড অল রাবিশ। বাড়িতে ঢুকতে পেছনের দরজা দিয়ে যেটা রহিম কখনই লক করত না। প্রমাণ চাও? অমরাবতীর হ্যালুসিনেশনের খুঁটিনাটি ডিটেইল আমার মুখস্থ। সে যেই মেয়েটাকে দেখত তার পায়ে পায়েল পরা থাকত। হাঁটলে ঝুম ঝুম শব্দ হতো। কিন্তু তুমি সেই রিস্ক নিতে না কারণ নূপুরের আওয়াজ হলে বাড়ির অন্যরা ঘুম থেকে উঠে যাবে। সেই জন্য, অতির এই ক’দিনের হ্যালুসিনেশনের মেয়েটার পায়ে কোন পায়েল থাকত না অতি আমাকে তাই বলেছে। আমি সৃষ্টির দিকে তাকালাম। কিন্তু ওর চোখের দিকে না। চোখের দিকে তাকাতে সাহস লাগে। কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটা আমার দিকে তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকিয়ে আছে। সৃষ্টি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি কি করি না করি আপনি সব জেনে বসে আছেন। একবারের জন্যও জানতে ইচ্ছে করেনি আমি কেন এসব করেছি? না কি ভয় পেয়েছিলেন এমন কোন রহস্যে আষ্টেপৃষ্ঠে যাবেন যার সমাধান আপনি জানেন না?’ আমি সামান্য ভয় পেলাম। হ্যাঁ ভয় পেলাম। এই মেয়েটার কথা বলার মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমাকে ভীত করছে। : তবে বলুন। কেন করেছেন এসব? আমি অতিকে সাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করছিলাম। যদি আপনি সত্যিই অতির সেই হারানো বন্ধু হয়ে থাকেন, তবে আমরা দুজনে মিলে অতিকে সাহায্য করতে পারতাম। কেন আপনি অতির হ্যালুসিনেশন উশকায় দিতেন? বলুন। সৃষ্টি কণ্ঠে সেই বিদ্রƒপ নিয়েই বলল, ‘তুমি করে আর বলছেন না দেখি? ভয় পেয়েছেন বুঝি?’ : সৃষ্টি কথা ঘুরাবেন না : বেশ। সৃষ্টি চায়ে চুমুক দিল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল চায়ে চিনি দেয়া হয়নি। : সবাই জানে আমি মরে গিয়েছি। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম। দেশে ফিরে অতির অবস্থার কথা জানতে পারি। আমি সঙ্গে সঙ্গেই অতিকে সাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করি। আমি জানতাম অতি একমাত্র আমাকে দেখলেই এই হ্যালুসিনেশন থেকে মুক্ত হবে। অতির সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করি। ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ও আমাকে চিনতে পারে না। একেবারেই না। তখন আমি বুঝতে পারি ও সত্যিই অসুস্থ। ওর পুরো চেতনাজুড়ে আমার হ্যালুসিনেশন। ও আমাকে আর কখনই চিনবে না। কারণ চিনতে হলে ওকে আগে ওর হ্যালুসিনেশন ভুলতে হবে। যেটা কোনভাবেই সম্ভব না। কোনভাবেই সম্ভব না.... সৃষ্টির গলা ভারি হয়ে আসে। ও বলে যায়Ñ : তখন আমার মধ্যে এক ধরনের গোপন অভিমান হয়। আমি.... আমি ওর হয়ে কথা শেষ করি- : আপনি তখন বুঝতে পারেন অমরাবতীর সঙ্গে বন্ধুত্ব ফিরে পাওয়ার এক মাত্র পন্থা হচ্ছে তার হ্যালুসিনেশনে প্রবেশ করা। তাই আপনি রোজ রাতে ঠিক ওই সাজে অমরাবতীর কাছে যেতেন। বারান্দায় সামান্য বাতাস খেলছে। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। সামান্য মেঘ করেছে। : জীবনটা আপনার কাছে ছেলেখেলা মনে হয় তাই, তাই না সৃষ্টি? ‘আরেকটু সোজাসুজি বলুন-জীবনটা আপনার কাছে পাগলামি মনে হয় তাই না সৃষ্টি’, সৃষ্টি আমাকে নকল করে বলল। : একজন সাইকোলজিস্ট হয়ে আমি কখনই ওই শব্দটা বলব না। : ‘পাগলামি’? ও তাই না? আপনাদের তো আবার সাইন্টেফিক শব্দের বাহার। শেষে যে তো একই অর্থ হয়। কোথায় জানি পড়েছিলাম- খারাপ কথা ভদ্রভাবে বললে ভাল হয়ে যায় না, খারাপই থাকে। আমি কিছু বললাম না। : ডাক্তার সাহেব, আপনি বিশ্বাস করেন এই জগতে কোন রহস্য নেই, তাই না? আপনি খুব বোকা। পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় জিনিসটা নিয়েই আপনি কাজ করেন, তা কি আপনি জানেন? না জানেন না। মানুষের মন। বন্ধত্ব কি- ব্যাখ্যা করুন তো। আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এসব কি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে ও আমাকে? : যখন দুজন ব্যক্তি একে অপরকে ভালবাসে এবং তাদের মধ্যে যেই ঁহফবৎংঃধহফরহম মৎড়ি করে সেটাকেই বন্ধুত্ব বলে। : বেশ, এবার ব্যাখ্যা করুন ভালবাসা কি। : ভাল লাগা, আকৃষ্টতা, কারোর কোন গুণ দেখে চমৎকৃত হওয়া, ফবংরৎব ভড়ৎ ভৎরবহফংযরঢ় ড়ৎ ঢ়ধৎঃহবৎংযরঢ়ৃৃ. এই তো। : আহা, ভুল করছেন। ভাল তো কত কিছুকেই লাগে। সেটা বস্তুও হতে পারে। তার জন্য কি আমরা এত পাগলামি করি? আমি হাল ছেড়ে দিলাম। কিছুটা বিরক্ত হলাম। : পারছেন না? একটা সামান্য প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনার ঘাম ছুটছে? বাহ- এ জগতে আসলেই কোন রহস্য নেই। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। সৃষ্টি উঠে দাঁড়ালো। আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, ‘কি করছ? বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বের হবে নাকি?’ বলতে বলতে আমার মনে পড়লো আমার মেয়ে ছোটবেলায় বৃষ্টিতে ভিজতে খুব পছন্দ করত। এখন এ কথা মনে হবার কি কারণ- অপ্রাসঙ্গিক কথা যত সব। আমি বললাম, ‘মেঘবতী বসো, চা শেষ করে যাও।’ সৃষ্টি হাসি লুকিয়ে বলল, ‘এ জগতে সত্যি কোন রহস্য নেই।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘এখন কোন্ রহস্যের কথা বলছ?’ সৃষ্টি বলল, ‘কিছু না’। এই বলে সে চলে গেল। আমি বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছি। ফুটপাতের শানে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। একটা মেয়ে নীরবে হেঁটে চলছে। ওর পা থেকে নূপুরের ঝুম ঝুম আওয়াজ হচ্ছে। ঠোঁট হালকা নড়ছে অস্ফুট আওয়াজৃৃ ‘বাবা’। অমরাবতী জানালার ধারে বসে বৃষ্টি দেখছে। ওর চোখে হালকা কাজল, পায়ে পায়েল। ও কখনও সাজে না। আজকে কি মনে করে কে জানে। এ জগতে আসলেই কোন রহস্য নেই।
×