ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধারাবাহিক উপন্যাস

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

ধারাবাহিক উপন্যাস

(পূর্ব প্রকাশের পর) ‘ আমি শতভাগ নিশ্চিত এই চিঠি নকল করা। এই দেখুন, আমি ‘নুন’-এর নোকতা বা ফোঁটাটা ঠিক বাঁকানো অংশের উপরে দেই, এভাবে পাশে দেই না আর আমার হাতের লেখার নকশাবন্দী খোদ জাঁহাপনা প্রশংসা করেছেন। এতো দুর্বল হাতে লেখা আমার হতেই পারে না। এটা পরিষ্কার জোচ্চুরি। আমার উপর বিনা দোষে জুলুম করা হচ্ছে জনাব।’ আবেগে কেঁপে উঠলো আলী নকীর নরম কণ্ঠস্বর। মুরাদ বৃদ্ধ আলী নকীর আবেদন গ্রাহ্যেই নিলেন না। - আরে রাখ তোর আসল-নকল! দারা একজন হিন্দু বৈদ্য দিয়ে বাদশাহর চিকিৎসা করাচ্ছেন আর সাম্রাজ্যের সমস্ত হিন্দু প্রজাদের মন জয় করতে চাচ্ছেন এই সংবাদটাও তুই জেনে-শুনে চেপে রেখেছিস কেন? কি তোর স্বার্থ? -আমি তো এর কিছুই জানি না? দিল্লীতে ভালো হেকিমের অভাব নেই আমি যতদূর জানি। তবে কেন বাদশাহ হিন্দু বৈদ্যের চিকিৎসা নেবেন? আপনি এসব কি বলছেন আমি তো এর কিছুই বুঝছি না... রীতিমতো অসহায় দেখাল তাঁকে। বুকের মধ্যে চাপ অনুভব করতে থাকলেন আলী নকী। মনে মনে উপরওয়ালাকে স্মরণ করলেন এই পরিস্থিতি হতে তাঁকে মুক্তি দেবার জন্য। মনস্থির করতে পাঁচ সেকেণ্ড সময় নিলেন তিনি। লম্বা দম নিয়ে ঠিক করলেন সমস্ত অভিযোগের উত্তর মাথা উঁচু করেই দেবেন। লাঠিতে ভর দিয়ে আবার উঠে দাঁড়ালেন হিন্দুস্তানের অর্থমন্ত্রী। যদিও পানির পিপাসায় গলা শুকিয়ে আসছে, কিন্তু উপায় নেই। আলী নকী ঋজু কণ্ঠে বলে চললেন, - অভয় দিলে কিছু কথা আপনাকে পেশ করতে চাই জনাব। আমি টানা চল্লিশটা বছর মুঘল সাম্রাজ্যের খেদমত করে এসেছি। বিশ্রাম নেইনি। বরফে ঢাকা কান্দাহার হতে বঙ্গ দেশের জঙ্গল পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছি শুধু সাম্রাজ্যের মঙ্গল কামনায়। জানি এর বিনিময়ে আমি কিছু কুচক্রী শয়তানের চক্ষুশূল হয়েছি যারা চায় আমি এই দুনিয়াতে না থাকি। গুজরাটে তো নিজের ইচ্ছেয় আসিনি, মহামান্য সম্রাটের আদেশেই এসেছি। কিন্তু এখানে এসে কি দেখলাম? দেখলাম বাদশাহের সুপুত্র কতগুলো লম্পট, সুবিধাবাদী চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের সুনাম ব্যাহত করছেন। আমি শাহজাদার শুভাকাক্সক্ষী হয়ে শুরু হতে বারবার বলে আসছিলাম কে আপনার বন্ধু আর কে আপনার শত্রু। কিন্তু মহামান্য কখনোই আমার কথা কর্ণপাত করেননি। উল্টো আজ আমাকেই বিশ্বাসঘাতকের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। অবিশ্বাস্য সব অভিযোগ আনা হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে। স্বয়ং সম্রাট যদি আজ উপস্থিত থাকতেন তিনি নিজেও আমার এই পরিস্থিতি দেখে আফসোস করতেন। শুধু তাই নয়, আপনি বা যারাই আমার বিরুদ্ধে এই জাতীয় অভিযোগ এনেছেন তার প্রেক্ষিতে আমি বরং মনে করি- আমি নই, আপনারাই এই সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আমার সম্রাটের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন...’ হাতের ছড়িটা মাটিতে ঠুঁকে মুরাদের দিকে মুষ্টি নির্দেশ করে বলতে থাকলেন আলী নকী। মুরাদ রাগে-ক্রোধে দিগি¦দিকশূন্য হয়ে খঞ্জর হাতে তেড়ে এলেন মন্ত্রীর দিকে। - হায় খোদা! শাহজাদা তো আলী নকী হুজুরকে মেরে ফেলবেন! আর্তনাদ করে বুলন্দের কুর্তা খামচে ধরলেন মেহজাবীন। নিমিষে বাগানের দিকে ছুটে যেতে চাওয়া মেহজাবীনকে ঝটিকায় জড়িয়ে ধরে তার মুখ চেপে ধরলো বুলন্দ। - না সোনা, এটা আমাদের ব্যাপার না। যা হচ্ছে হতে দাও। দয়া করে শান্ত থাকো। দু’জনেই মুরাদের উন্মত্ত চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল। - বেজন্মার বাচ্চা চোগলখোর বুড়া শয়তান! আমাকে শাসানো হচ্ছে। আমাদের খেয়ে আমাদের বিরুদ্ধে গলাবাজী করছিস। নে! মর তা হলে ...’ মুহূর্তেই আলী নকীর ভয়ার্ত কণ্ঠের ‘ইয়া আল্লাহহহহহ’ চিৎকার শোনা গেল। বুলন্দ স্পষ্ট দেখলো মুরাদের বাঁকানো খঞ্জর ভোরের আলোয় ঝিলিক মেরে আলী নকীর পেটে ঢুকে যেতে। হেঁচকা টান মেরে ছুরিটা বের করে আরো একবার সজোরে আঘাত করলেন মুরাদ। বিশাল এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মাটিতে পড়ে গেলেন বৃদ্ধ মানুষটি। একই সঙ্গে মেহজাবীন জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন বুলন্দের কোলে। হাত তালি দিয়ে মুরাদ ডাকলেন প্রহরীদের। হাতের রুমালে মুছে নিলেন খঞ্জরে লেগে থাকা রক্ত। সবুজ ঘাসে মুখ হাঁ করে পড়ে থাকা মন্ত্রীর নিথর দেহটাকে নির্দেশ করে বললেন, - বাগানের মাটিতে রক্ত লাগার আগেই আমার চোখের সামনে থেকে লাশটা সরিয়ে নিয়ে যাও। প্রাসাদে যেতে যেতে মুরাদ শ্রাগ করে নির্দেশ দিলেন সুদূর ইস্পাহান হতে আনা তাঁর প্রিয় ‘আরগ’ সুরার পাত্র নিয়ে আসতে। ইচ্ছে ছিল বড় কোন উদযাপনের দিন তা পান করবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে অনেক তৃষ্ণাবোধ করছেন তিনি। বাদশাহ শাহজাহানের বিশিষ্ট মন্ত্রী আলী নকীর সততার পুরস্কার মুরাদ কিভাবে দিলেন সেই খবর বাতাসের বেগে দিল্লীতে দারা ও দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের কাছে পৌঁছে গেল। তাঁরা দু’জনেই বুঝে নিলেন গুজরাটের রাজকোষের চাবি এখন একক ভাবে মুরাদের হাতে। কিন্তু আলী নকীর হত্যাকাণ্ড ও মুরাদের অভিলিপ্সা বা বাদশাহের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কিছুই তখনো অবগত হননি আরেক ভাই শাহ সুজা। ইছামতী-ধলেশ্বরী-বুড়িগঙ্গা বিধৌত ঢাকা অঞ্চলে নিয়োগ পাওয়া বাংলার সুবেদার স্বাধীনচেতা শাহ সুজা তখনো জানেন না তাঁর জন্য কি অপেক্ষা করছে। যাবতীয় সংবাদ নিয়ে তাঁর গুপ্তচর যখন ঢাকার বড় কাটরায় পৌঁছালো তখন কয়েক দিনের দূরত্বে আদরের পুত্র জয়নুল আবেদীনের সম্মানে শাহজাদা শাহ সুজা সদলবলে শিকারে বেরিয়েছেন। (চলবে)
×