ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শতাব্দীর সেরা বই;###;আকিল জামান ইনু

এ পোর্ট্রটে অব দ্যা আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়্যাং ম্যান

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

এ পোর্ট্রটে অব দ্যা আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়্যাং ম্যান

জেমস জয়েস। বিশ্ব সাহিত্যের শুদ্ধতম কণ্ঠ। বিংশ্ব শতাব্দির ইংরেজি গদ্যের মুক্তিদাতা। পাঠকের জন্য যিনি খুলে দিয়েছেন চিন্তার নতুন দুয়ার। নিজ সময় তাকে মূল্যায়ন করেনি। অথচ শতাব্দী শেষে জীবদ্দশায় প্রকাশিত সাতটি গ্রন্থ নিয়ে তিনি উঠে এসেছেন সেরা শতগ্রন্থ তালিকায়। যথাক্রমে এক, তিন ও সাতাত্তরে। টাইম ম্যাগাজিন ১৯৯৯ এ জয়েসকে নিয়ে প্রকাশিত মন্তব্যে জানায় পুলিৎজার, ম্যান বুকার, নোবেল দূরে থাক জীবিতাবস্থায় প্রকাশকের সহানুভূতিটুকুও জোটেনি তার ভাগ্যে। আর আজ জেমসের উপন্যাসই শতাব্দীর সেরা। প্রথম, তৃতীয় ও সাতাত্তরতম স্থানে! পৃথিবীজুড়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের উত্তাল হাওয়া বইছে তখন। সাহিত্যজগতও এর বাইরে নয়। সমুদ্রের দু’পাশে টোয়েন-পাউন্ড আর তলস্তোয়-চেখভরা সাহিত্যের সীমারেখা আঁকতে ব্যস্ত। বিশ্ব সাহিত্যে সৃষ্টিশীলতার ঝড় বইছে। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়। চিন্তার জগত চমকে যাচ্ছে নতুন নতুন ভাবনায়। এসবের মাঝেও পুয়োর জেমস কি করে যেন হয়ে উঠেছেন তৃতীয় কণ্ঠ। যাকে অনুসরণ করা যায়, অনুকরণ নয়। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনার গদ্যরীতি এত জটিল কেন?’ তার সহজ জবাব, ‘মূর্খ সমালোচকদে’র তিন শ’ বছর ব্যস্ত রাখার জন্য!’ তিনি এমনই অকপট, স্পষ্ট, ব্যতিক্রম। আইরিশ কবি ব্রেন্দানবেহানের মতে, ‘শেক্সপিয়ার এঁকেছেন যেটুকু সম্ভব। যা বাদ ছিল তা পূরণ করেছেন জেমস জয়েস।’ আর তাকে নিয়ে শেষ কথা বোধ করি নোবেল জয়ী স্যামুয়েল বেকেট উচ্চারণ করেছেন এভাবে, ‘আমাদেরকে না দেখলেও তার চলত, কিন্তু তাকে ছাড়া আমরা অচল।’ জীবদ্দশায় প্রকাশক আর সাধারণ পাঠকের সহানুভূতি জোটেনি তার। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে দুভাগ হয়ে গিয়েছিল সাহিত্যজগত। হেমিংওয়ে, এইচ জি ওয়েলসয়ের মতো সুহৃদেরা সরে গিয়েছিলেন। যদিও সাহিত্যের নতুন স্রষ্টা ইয়েটস, দেরিদা, ফকনার, বেকেটরা তাকে ঠাঁই দিয়েছেন হৃদয়ে। প্রচলিত ধর্মে বিদ্রোহী হয়েও তিনি নাস্তিক নন। তাকে দলে ভেড়াতে ব্যর্থ লেনিন। প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতি তার কখনই শ্রদ্ধা ছিল না। তাই তিনি আজন্ম নিঃসঙ্গ, দলহীন। আর খুব সহজ সত্য হচ্ছে জেমস জয়েসের কোন দলভুক্ত হওয়ার দরকার পড়ে না। তিনি তার মতো কিংবা বিশ্বসাহিত্যে কেউ তার মতো নন। ‘এ পোর্ট্রটে অব এ আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়ং ম্যান’ তার প্রথম উপন্যাস, তৃতীয় গ্রন্থ। প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ১৯১৬। প্রথম বই কবিতার ‘চেম্বার মিউজিক’ তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ডাবলিনার্স’। চির উদ্বাস্তু জয়েস হৃদয়ে বয়ে বেরিয়েছেন স্বদেশ। তার যা কিছু রচনা ডাবলিনকে ঘিরে। এ বইও তার ব্যতিক্রম নয়। বইয়ের শিরোনাম এটি স্পষ্ট করেÑএ গল্প এক কিশোরের তারুণ্য ছুঁয়ে যৌবনে পা রাখার পথে শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প। নায়ক স্টিফেন ডিডেলাস হয়ে লেখক বলেছেন তার কথা। সাহিত্যযশকামীদের জন্য এ বই সবচেয়ে কাম্য হতে পারে কেবল একটি কারণে। সেটি হলো স্টিফেনের পাঠের ব্যাপ্তি ও গভীরতা। এই উপন্যাসে তার পাঠ্য তালিকায় কে কে আছেন সেই তালিকা না দিয়ে এক কথায় বলা যায় কে নেই? সৃষ্টিশীলতার কোন ক্ষেত্রটি তিনি ছুঁয়ে যাননি? সঙ্গীত, শিল্প, চিত্রকলা, বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্বÑ কোথায় পা রাখেননি? এবং নায়ক স্টিফেন সবই দেখেছেন, শুনেছেন, শেষ পর্যন্ত স্থির হয়েছেন নিজের মতে। আশ্চর্য গদ্যরীতি। জয়েস সম্পর্কে বলা হয়, তিনি যা লিখেছেন সেখান থেকে বর্জন করেছেন বেশি। বারো বছর ঘষামাজা করে প্রকাশিত এগ্রন্থও তাই। সভ্যতার মহান স্রষ্টাদের তিনি ছুঁয়েছেন তার মতো করে খুব অল্পে, আর পর মুহূর্তে হেঁয়ালিভরে ছুড়ে দিয়েছেন তার মন্তব্য। জয়েসের গদ্যরীতি জটিল কিন্তু তার উপমার সৌন্দর্য, প্রতি লাইনে চমকে দেয়া ছবি জয়েস পাঠে ক্লান্তি আসে না। তিনি যখন বলেন, ‘ফরাসীরা ঈশ্বরকে বলেন দিউ। কেউ যদি দিউ বলে ডাকেÑঈশ্বর ঠিক বুঝবেন, প্রার্থনা করছে একজন ফরাসী! আর যে নামেই ডাকা হোক ঈশ্বর তো ঈশ্বরই থাকেন।’ এ গ্রন্থ কিশোর স্টিফেনের অনুসন্ধানের গল্প। তার দ্বিধা, সংকোচ, গ্লানি, হতাশা, কাম, প্রেম, ধর্ম-অধর্ম, সৃষ্টিশীলতা, মনোজগত, সাহিত্য, বিদ্রোহ, উপেক্ষা সবকিছু পেরিয়ে এসে নন্দনতত্ত্বের উত্তর অনুসন্ধানের গল্প। এখানে সব চরিত্রই এসেছে নায়ক স্টিফেনের ভাবনার প্রয়োজনে। অন্য সমালোচকরা যাই বলুক, এই উপন্যাসে কোন চরিত্রই গুরুত্বপূর্ণ নয় এমনকি নায়ক স্টিফেনও! গুরুত্বপূর্ণ কেবল তার দৃষ্টিভঙ্গী। নিজেকে প্রতি মুহূর্তে পুড়িয়ে খাঁটি হয়ে ওঠার যাতনা। পাঠকের কাছেও শেষ পর্যন্ত প্রধান হয়ে দাঁড়ায় নায়ক স্টিফেন নয় বরং তার খুঁজে ফেরা নন্দনতত্ত্বের সংজ্ঞা। আর জয়েস সংজ্ঞা তৈরি করেছেন নিজের মতো করে। বিশ্লেষণ করেছেন আবেগ, কামনা আর ঘৃণার। তুলে এনেছেন শিল্পের সংজ্ঞা। আলোচনা করেছেন মৌলিক স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মকালীন মানসিক অবস্থা। আবার সত্যিকারের শিল্পের স্পর্শে তার নিজের মানসিক অবস্থা বর্ণনায় বলেছেন ‘মোনালিসার ছবি তার চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করে।’ যাজক হওয়ার যাত্রা পথে স্টিফেনের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব এ উপন্যাসে উঠে এসেছে বার বার। এবং তিনি সরে এসেছেন প্রচলিত ধর্মীয় পথ থেকে। জয়েস অন্য সব বিষয়ের মতো এখানেও স্পষ্ট নয়। তবে ঠিকই বলেছেন যা বলার। তিনি যখন বলেন, ‘ধর্ম তো একগাদা বিছানাওয়ালা কোন হাসপাতাল নয়।’ অথবা নয়, ‘পাপের দরজা দিয়ে গির্জা ত্যাগ আর অনুশোচনার জানালা দিয়ে পুনঃপ্রবেশ।’ তখন তা পাঠককে ছিটকে দেয় জেমসের জগতে। শেষ পর্যন্ত এসে আমরা দেখি এমন এক স্টিফেন যে প্রিয় স্বদেশ ছেড়ে যাত্রা করছে অজানায়। আর সেই যাত্রার পূর্বে উচ্চারিত সহজ সত্য বর্তমান গিলে খায় অতীত। আর ভবিষ্যতকে জন্ম দেবে বলেই বর্তমানের বেঁচে থাকা। এক কথায় এই গল্প এক কিশোরের শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প যার নামÑ জেমস জয়েস। তিনি যা হতে চেয়েছেন কিংবা হয়েছেন অথবা হতে চেয়েও পারেননি তা এঁকেছেন স্টিফেন ডিডেলাসের তুলিতে। এ উপন্যাস শিল্পের বেদিতে শিল্পের সংজ্ঞা খুঁজে ফেরা এক মহান শিল্প স্রষ্টার অনন্য নিবেদন। পাঠ শেষে নিমগ্ন পাঠক নিশ্চিতভাবেই হাঁটুগেড়ে বসবেন জয়েসের সঙ্গে প্রার্থনায়, ‘হে আদি পিতা, তুমি আমার সঙ্গে থেকো অপার করূনায়।’
×