ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

প্রজ্ঞাদীপ মুহিতমানস

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ১৩ জানুয়ারি ২০১৭

প্রজ্ঞাদীপ মুহিতমানস

‘প্রজ্ঞাদীপ মুহিতমানস’ গ্রন্থটি মূলত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্মানন গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশ করা হয় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তার ৮০তম জন্মবার্ষিকী পার করার যুগসন্ধিক্ষণে তাকে নিয়ে বিশেষ কিছু করার সিদ্ধান্ত হিসেবে একটি গ্রন্থ বের করার কথা ভাবা হয়। বইটি আসলে মন্ত্রীর পূর্ণাঙ্গ জীবনালেখ্য। তাকে নিয়ে লিখেছেন দেশের খ্যাতিমান বিজ্ঞজনেরা। বৃহদাকার এই বইটিতে আছে তার সম্পর্কে অনেকের গুরুত্বপূর্ণ অভিব্যক্তি। প্রচুর প্রবন্ধের সন্নিবেশনে বইটির সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন আবুল ফতেহ ফাত্তাহ। মূল্যবান এই বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন তামিম বিন ইমদান। এ সম্মাননের পরিসরটি সাজানো হয়েছে আটটি অধ্যায়ের সুসংবাদ উপস্থাপনে। তারও আগে আছে আবদুল মুহিতের সুবর্ণ সময়গুলো স্মরণ করে ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের একটি সুচিন্তিত প্রবন্ধ ‘মুহিত জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় সময় ১৯৭১’ শিরোনামে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের আবদুল মুহিতের ছাত্র জীবনের প্রতিভাদীপ্ত পর্যায়গুলোর একটি সুশৃঙ্খল উপস্থাপন পাঠককে তার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দেয়। তীক্ষè মেধাবী আবদুল মুহিত অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে পাঠ্যক্রমের সমস্ত পর্যায় অতিক্রম করে যান। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কারণে অনিবার্যভাবে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল স্রোতে নিজেকে জড়িয়ে নেন। রাজনৈতিক সচেতনতা তাকে প্রলুব্ধ করে অল্প বয়স থেকেই। কারণ মাতা সৈয়দ শাহার বানু ছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক সচেতন একজন দক্ষ সংগঠক। ফলে পারিবারিক এই প্রতিবেশ শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত সময়গুলোতে ভিন্নমাত্রা যোগ করে। সঙ্গত কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং ’৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলন তাঁর দেশাত্মবোধের সত্তাকে নানামাত্রিকে আন্দোলিত করে যা আজও তাঁর মাঝে বহমান। ভাষা আন্দোলনে সরাসরি অংশ নেন এবং তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতায় কারাবরণের মতো দুর্ভোগেরও শিকার হতে হয়। যা ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্রের পরবর্তীতে সরকারী উচ্চপদস্থ আমলা হওয়ার এক যুগান্তকারী স্বপ্নের ভিত তৈরি করে দেয়। প্রসঙ্গক্রমে এই আলোচনায়ও আসা যাবে। সম্পাদক আবুল ফতেহ ফাত্তাহর আলোচনা ‘বাঙালির নবচেতনার ধারাপাত : একজন মুহিত’ গ্রন্থটির উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধসমূহ নিয়ে একটি সুসংবদ্ধ অভিমত। যা ব্যক্তি আবদুল মুহিতের জীবন ও কর্মযজ্ঞের ওপর একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা তৈরি হতে পাঠকের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সংস্কৃতি চর্চায় নিবেদিত এই ব্যক্তিত্বের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে ছাত্র জীবনের শুরুতেই। বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং বলিষ্ঠ ভূমিকা সবাইর দৃষ্টি আকর্ষণ করত। বিভিন্ন লেখকের লেখায় তা সুস্পষ্টভাবে বিধৃত হয়ে আছে। সৎ, আদর্শনিষ্ঠ সাহসী, সংগ্রামী এবং দেশের প্রতি নিবেদিত আবদুল মুহিত ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছিলেন মার্কিন মুল্লুকে বসে তা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তিনি পাকিস্তানী দূতাবাসের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লেখায় এসেছে একজন অর্থমন্ত্রী কিভাবে নান্দনিক চর্চায় নিজেকে সংযুক্ত করেছেন। তাঁর লেখা থেকে উঠে আসে বাংলা একাডেমির বিভিন্ন স্থান, বইমেলা, শিল্পকলা একাডেমির নানা আয়োজন এবং ১ বৈশাখের রমনা বটমূলে তাঁর হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি দর্শকদের মুগ্ধ করেছে, আনন্দ দিয়েছে। যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। তার ওপর প-িত ব্যক্তিদের বিস্তারিত আলোচনা তাঁকে শুধু চেনাবেই না তাঁর আদর্শ নিষ্ঠার প্রতিও পাঠকদের দৃষ্টি কাড়বে। বিশিষ্ট সাংবাদিক স্বদেশ রায়ের লেখা ‘অর্থনীতির সংস্কারক আবুল মাল আবদুল মুহিত’ আলোচনাটিতে স্পষ্ট হয় একজন বিচক্ষণ বাজেট প্রণেতা হিসেবে অর্থমন্ত্রীর যুগান্তকারী ভূমিকা যা দেশের সমৃদ্ধির সূচক। স্বদেশ রায় তাঁকে মূল্যায়ন করেছেন একজন সফল অর্থনীতির সংস্কারক হিসেবে। রাজনৈতিক টানাপোড়েনের দুঃসময়েও তাঁর দেয়া বাজেটের রূপরেখার গতি নির্ণয় সঠিকভাবেই হয়েছিল বলে এই সাংবাদিকের ধারণা, যার নির্ণায়ক আশাতীত বার্ষিক প্রবৃদ্ধি। যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর মূল ভিত্তিকে মজবুত করে দেয়। ইংরেজী সাহিত্যে শিক্ষা জীবন শেষ করলেও তাঁর স্বপ্ন ছিল বিচারক হওয়ার। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে তিনি এ কথা বলেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে তাঁকে জেলে আটকে রাখা হয় প্রায় ৪২ দিন। সেখানে বসেই তিনি প্রত্যক্ষ করেন সরকারী কর্মচারীদের দাপট এবং সক্রিয় ভূমিকা যা দেশ সেবায় এক যুগান্তকারী অবদান রাখতে বিশেষ সহায়ক হতে পারে। স্বপ্নের মোড় পরিবর্তন হয়। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে পরীক্ষা দেয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন। এক সময় সে পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। নতুন স্বপ্নের তাড়নায় শিক্ষানবিস থেকে আরম্ভ করে সব ধরনের প্রশিক্ষণ নেয়া শেষ হলে তাঁর কর্মজীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয় সরকারী পদস্থ অফিসার হিসেবে। এরপর তিনি ক্রমাগত এগিয়েই যান। আমলা থেকে শুরু করে সব ধরনের সর্বোচ্চ পদে আসীন থেকে বর্তমানে অর্থমন্ত্রী হিসেবে কর্মজীবনের ক্রান্তিলগ্ন পার করছেন। উল্লেখ্য, তিনিই একমাত্র বাংলাদেশী যিনি ম্যানিলায় এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে অভিষিক্ত হন। এ ছাড়াও তিনি প্রথম বাংলাদেশী যিনি বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের এসব সফল সংযোজন প্রবন্ধকাররা পাঠকদের সামনে তুলে ধরেন। স্বপ্ন পূরণে প্রতিটি ধাপ তিনি সফলভাবে অতিক্রম করেছেন, যা বিভিন্ন প্রবন্ধকারের সুস্পষ্ট উপস্থাপনায় প্রকাশ পেয়েছে। বিচিত্র কর্মপ্রবাহের পথ পরিক্রমায় বিচ্যুতি আর ছন্দপতন বলতে যা তা হলো তৎকালীন এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভায় নিজেকে সম্পৃক্ত করা। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বলয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতের সদর্প বিচরণের সফল আখ্যান গ্রন্থটিতে পরিচ্ছন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে। যা শুধু তার জীবনালেখ্যই নয়, একটি সমাজ ব্যবস্থার স্বচ্ছ অবয়বও। গ্রন্থটি পাঠক সমাজকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করবে। বইটির সর্বাঙ্গীন সফলতা কামনা করছি।
×